ক্রাইমবার্তা রিপোট:আলমগীর হোসেন ,লক্ষ্মীপুর থেকে: লক্ষ্মীপুরে আনাচে কানাচে চলছে বাল্য বিয়ের হিড়িক। প্রশাসনের পক্ষ থেকে লক্ষ্মীপুরকে বাল্য বিয়ে মুক্ত ঘোষনা করা হলেও কমছে না বাল্য বিয়ের সংখ্যা। স্থানীয় জন প্রতিনিধি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, আইনজীবি, কাজী ও ইমামদের কারসাজিতে এখনো অহরহ বাল্য বিয়ে হচ্ছে। এসব বাল্য বিয়ে দেওয়ার পূর্বে প্রশাসনকে অবহিত করা হলেও তারা নিরব ভূমিকা পালন করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে করে স্থানীয় এলাকাবাসী ও সচেতন মহলের মাঝে চরম ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১ মে ২০১৭ তারিখে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ১নং উত্তর হামছাদী ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের মন্ডলতলী বাজার এলাকায় ৯ম শ্রেনীর ছাত্রী মমতাজ আক্তার (১৫) কে রায়পুর উপজেলার উত্তর কেরোয়া গ্রামের আব্দুর রহিমের ছেলে মো: ফিরোজ আলমের সাথে এড. মিজানুর রহমান স্বাক্ষরকৃত নোটারী পাবলিক নং ১১২৮ বাল্য বিয়ে দেয়া হয়। এই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা গত বৃহস্পতিবার (২৯ জুন) সম্পন্ন হয়।
এ ব্যাপারে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও ৩নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্যকে অবহিত করা হলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এতে করে স্থানীয় এলকাবাসী ও সচেতন মহলের মাঝে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে এবং স্থানীয় প্রশাসনের প্রতি আস্থা হারিয়ে যাচ্ছে।
জানা যায়, পবিত্র ঈদুল ফিতরের পর পরই জেলার সকল উপজেলায় প্রত্যান্ত অঞ্চলে দিন দিন একের পর এক বাড়ছে বাল্য বিয়ের প্রতিযোগিতা। এ সকল বিয়ে হচ্ছে বেশীর ভাগ ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণির অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রেজিষ্টার অনুযায়ী এদের বয়স ১১ থেকে ১৪ বছর হলেও ইউপি চেয়ারম্যান কর্তৃক প্রদত্ত জন্ম সনদে তাদের বয়স দেখানো হচ্ছে ১৮ থেকে ২০ বছর। আবার কখনো ইউনিয়ন পরিষদ জন্ম সনদ না দিলেও আইনজীবিদের মাধ্যমে নোটারী পাবলিক এফিডেভিট দিয়ে হচ্ছে এসব বাল্য বিয়ে। গত ৭ দিনের ব্যবধানে সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি বাল্য বিয়ে সংঘটিত হয়েছে। প্রশাসন নিরব থাকায় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে বাল্য বিয়ের সংখ্যা। আইন না মেনে অবাধে বাল্য বিয়ে হওয়াতে একদিকে যেমন স্কুল-মাদরাসা থেকে ঝড়ে পড়ছে শিক্ষার্থী অন্যদিকে বাল্য বিয়ের বহু কুফল পরিলক্ষিত হচ্ছে সর্বত্র। অপরিণত বয়সে বিয়ের কারণে সু-স্বাস্থ্য, উচ্চ শিক্ষা পরিপূর্ণ সংসার গঠন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অনেক মেয়েরাই। ফলে সরকারের লক্ষ্য উদ্দ্যেশ্য ব্যহত হচ্ছে। দিন দিন ভেঙ্গে পড়ছে ওদের স্বাস্থ্য। বিয়ের পর স্বামীসহ শশুরালয়ের লোকজনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পাড়ায় তালাক প্রাপ্তা হচ্ছে অনেকেই।
জানতে চাইলে ১নং উত্তর হামছাদী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এমরান হোসেন নান্নু জানান, শ্যামগঞ্জ গ্রামের মন্ডলতলী বাজার এলাকায় মমতাজ আক্তারের বাল্য বিয়ের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ইউপি সদস্য সুমন ও গ্রাম পুলিশকে পাঠানো হয়েছে। মেয়ের পরিবারবর্গ আমাদের কোনো কথায় কর্ণপাত করেন নাই। তারা নোটারী পাবলিক এফিডেভিট করে বিয়ে পড়াইছেন। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কোনো জন্ম নিবন্ধন নেয়নি বলেও জানান তিনি।
সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো: লোকমান হোসেন বলেন, ছুটিতে থাকার কারনে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। খোজ খবর নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ নুরুজ্জামান বলেন, এ বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এসব বিষয়ে লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক হুমায়রা বেগমের সুদৃষ্টি কামনা করছেন সচেতন মহল।
উল্লেখ্য: বিগত ১৯ নভেম্বর ২০১৪ইং সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বাল্য বিবাহ নিরোধ ভূমিকা সংক্রান্ত এক সভায় নোটারী পাবলিক এফিডেভিটের মাধ্যমে বিয়ে পড়ানো ও নিবন্ধন করতে পারবেনা বলে সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। এতে ১৯৭৪ এর তিন ধারা বিধান মোতাবেক দেশে প্রত্যেকটি মুসলিম বিবাহ রেজিষ্ট্রেশন বাধ্যতামূলক এবং অনুমোদিত কেবল মাত্র মুসলিম বিবাহ রেজিষ্ট্রারগণকে বিবাহ রেজিষ্ট্রেশন করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে গত ২৯ মে ২০১৫ তারিখে সিনিয়র সহকারী সচিব নুরুল আলম সিদ্দিক কতৃক স্বাক্ষরকৃত স্বারক নং- মব-৬/৭এর ৮/২০১৫-১৭৫ এর আলোকে এফিডেভিটের মাধ্যমে বিয়ে পড়ানো ও নিবন্ধন করা সম্পূর্ণরুপে নিষেধ করে আইন মন্ত্রণালয় আদেশ জারি করেন। আদেশে বলা হয়েছে নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে কেবলমাত্র একটি ঘোষনা সম্বলিত এফিডেভিট দিয়ে তথা কথিত বিয়ে পড়ানো হ্েচ্ছ, যাহা আইনে মোটেও স্বীকৃত নয়। এব্যারে নোটারী পাবলিকগণকে এফিডেভিটের মাধ্যমে যাতে বিয়ে পড়াতে বা নিবন্ধন না সেজন্য নির্দেশ দেন। কিন্তু লক্ষ্মীপুরে সরকারের সকল আদেশ নির্দেশকে তোয়াক্কা না করে অর্থের বিনিময়ে প্রতিনিয়ত নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে অহরহ বাল্য বিয়ে হচ্ছে। বিগত এক আইনশৃঙ্খলা মিটিং এ সদর উপজেলার ২নং হামছাদী ইউপি চেয়ারম্যান মীর শাহ আলম বাল্য বিয়ের ৬/৭টি নোটারী পাবলিক এফিডেভিটের কপি উপস্থাপন করেন। কিন্তু আজও এব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় বাল্য বিয়ে রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।