ক্রাইমবার্তা ডেস্ক রিপোট:অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সিঙ্গাপুর এবং থাইল্যান্ডে তিনি কার্লোস নামে পরিচিত। এসব দেশের মাদক মাফিয়াদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। বিদেশে সবাই তাকে চেনে ‘ঢাকার ইয়াবা ডন’ হিসেবে। মাদক ব্যবসার অভিযোগে অস্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুর সরকার যার বিরুদ্ধে হুলিয়া জরি করে ২০১৪ সালে। বর্তমানে তার ইয়াবা নেটওয়ার্ক সক্রিয় রয়েছে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক ঘিরে। এত নেতিবাচক বিশেষণে যিনি পরিচিত তার পুরো নাম আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ ওরফে সালেহ চৌধুরী ওরফে কার্লোস। অবশ্য প্রকৃত পরিচয় গোপন করে ঢাকার পরিচিত মহলে তিনি নিজেকে সামুদ্রিক পণ্য ও কোমল পানীয়র ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দেন।
জানা যায়, উচ্চাভিলাষী নেশা তাকে পেয়ে বসে। তাই অল্প বয়সেই পাড়ি জমান অস্ট্রেলিয়ায়। কিন্তু রাতারাতি বড় হওয়ার নেশায় শুরুতে তিনি ঢুকে পড়েন অপরাধ জগতে। আর অপরাধ বলতে ছোটখাটো কোনো অপরাধ নয়, একেবারে আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালান সিন্ডিকেটের সদস্যের খাতায় নাম লেখান। এরপর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। মাত্র ১০ বছরেই হয়ে যান শত কোটি টাকার মালিক। সেই টাকার জোরে রাজধানীর অভিজাত সমাজে ওঠাবসার টিকিট পেয়ে যান।শক্তিশালী ইয়াবা নেটওয়ার্ক : সূত্র জানায়, আবু জাফর মোহাম্মদ কার্লোস সরাসরি ইয়াবা ব্যবসায় নাম লেখানোর আগে ওষুধ কোম্পানিতে ব্যবহৃত কয়েকটি রাসায়নিক উপাদান আমদানির ব্যবসা শুরু করেন। এর একপর্যায়ে তিনি ইয়াবা তৈরিতে ব্যবহৃত মিথাইল এমফিটামিন নামের রাসায়নিক আমদানির চেষ্টা করেন। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় তিনি ঢাকার একটি নামকরা ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে বিশেষ সখ্য গড়ে তোলেন। এক পর্যায়ে ওই কোম্পানির মাধ্যমে ওষুধ তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত সিইডো এফিড্রিন নামের এক ধরনের রাসায়নিক আমদানি শুরু করেন। এই সিউডো এফিড্রিনকে মিথাইল এমফিটামিনে রূপান্তর করে তিনি ইয়াবা বড়ি তৈরির ব্যবসা শুরু করেন।
সূত্র বলছে, সিউডো এফিড্রিনকে বিশেষভাবে প্রক্রিয়াজাত করে মিথাইল এমফিটামিনে রূপান্তর করা হয়। ইয়াবা তৈরির মূল উপাদান হচ্ছে এই মিথাইল এমফিটামিন। তবে কার্লোসের সহযোগিতায় সিউডো এফিড্রিন আমদানির পর সেটি কোথায় মিথাইল এমফিটামিনে রূপান্তর করা হচ্ছে তা এ পর্যায়ে জানা যায়নি। গুরুত্বপূর্ণ এ তথ্যটি জানার চেষ্টা করছে পুলিশ। সক্রিয় আছে যুগান্তরের অনুসন্ধানী টিম।
সূত্র জানায়, একটি চক্র ওষুধ কোম্পানির নামে সিউডো এফিড্রিন আমদানি করে অতি গোপনে তা কালোবাজারে বিক্রি করে আসছিল। স্পর্শকাতর এই রাসায়নিক উপাদানের এমন অপব্যবহারের খবর প্রথম সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নজরে আসে ২০১৩ সালে। সে সময় একটি গোয়েন্দা সংস্থা এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গোপনীয় প্রতিবেদন পাঠায়। ঘটনা জানার পর নড়েচড়ে বসে ওষুধ প্রশাসন ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। এ বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটিও করা হয়। কমিটির সদস্যরা দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর সিউডো এফিড্রিনের অপব্যবহারের প্রমাণ পায়। তারা এই রাসায়নিক আমদানি নিষিদ্ধের সুপারিশ করে।
সিউডো এফিড্রিনের অপব্যবহার সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ঢাকা গোয়েন্দা অঞ্চলের সাবেক উপপরিচালক মজিবুর রহমান পাটোয়ারী। বর্তমানে তিনি অতিরিক্ত পরিচালক হিসেবে রাজশাহী অঞ্চলে কর্মরত। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মঙ্গলবার টেলিফোনে তিনি যুগান্তরকে বলেন, সিউডো এফিড্রিনের অপব্যবহার বন্ধ করতে আমরা কঠোর ব্যবস্থার সুপারিশ করেছিলাম। সে অনুযায়ী সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশে এই রাসায়নিক উপাদানটির আমদানি এখন সম্পূর্ণ বন্ধ। চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে। তবে কালোবাজারে এখনও এটি পাওয়া যাচ্ছে কিনা তা গভীরভাবে ক্ষতিয়ে দেখা দরকার।
প্রধান সহযোগী এক মন্ত্রীর ছেলে : সালেহ আহমেদের ইয়াবা নেটওয়ার্কের প্রধান সহযোগী ও ব্যবসায়িক পার্টনার জনৈক প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর ছেলে। তার ডাকনামের আদ্যাক্ষর ‘র’। বিভিন্ন জায়গায় কার্লোস নিজেকেও ওই প্রভাবশালী মন্ত্রীর ছোট ছেলে বলে পরিচয় দেন। এক সময় তিনি মন্ত্রীর নামের সঙ্গে মিলিয়ে নিজের নাম বলা শুরু করেন- সালেহ চৌধুরী। মন্ত্রীর ছেলে ছাড়াও কার্লোসের সঙ্গে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরও ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। এসব কর্মকর্তাদের অনেককে তিনি বিদেশে বেড়াতে নিয়ে যান। সেখানে কার্লোসের টাকায় ওইসব কর্মকর্তারা নাইট ক্লাব ও পাবে (বারের আধুনিক সংস্করণ) গিয়ে ফুর্তিতে সময় কাটান। বিনিময়ে তারাই কার্লোসের ইয়াবা নেটওয়ার্ক সুরক্ষিত রাখার সব বন্দোবস্ত করে দেন।
সূত্র জানায়, অজ্ঞাত কারণে ঢাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ থানা পুলিশের সঙ্গে তিনি সব সময় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতেন। এজন্য থানার ওসিকে খুশি রাখতেন কার্লোস। প্রতি মাসেই ওসির সঙ্গে দেখা করে মোটা অংকের বকশিশ দিতেন। ওসির স্ত্রীদের জন্য বিদেশ থেকে আনতেন নামিদামি উপহার। এছাড়া মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গেও তার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। কয়েক মাস আগেই দু’জন পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা তার সঙ্গে বিদেশ ভ্রমণ করেন। কার্লোসের সাবেক এক বান্ধবী যুগান্তরকে বলেন, বিদেশে থেকে এলেই কার্লোস সংশ্লিষ্ট থানায় চা খেতে যেতেন। ওসির সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় তিনি সব সময় বলতেন থানা তার হাতের মুঠোয়। পুলিশ তাকে কখনই গ্রেফতার করবে না। একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার কাছ থেকেও এ রকম তথ্য পাওয়া যায়। কার্লোস গ্রেফতারের পর তারাও বিশেষ অনুসন্ধান শুরু করেছেন।
অস্ট্রেলিয়া-সিঙ্গাপুর থেকে বহিষ্কার : নারী নির্যাতন ও মাদক ব্যবসার অভিযোগে অস্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুর থেকে কার্লোসকে বহিষ্কার করা হয়। ২০১৪ সালের পর তিনি এ দুটি দেশে আর প্রবেশ করতে পারেননি। সূত্র জানায়, অস্ট্রেলিয়ায় থাকার সময় তিনি এক অস্ট্রেলীয় নারীকে বিয়ে করেন। সেখানে তার এক ছেলেও আছে। কিন্তু মাদকাসক্ত কার্লোস স্ত্রী সন্তানের ওপর নির্যাতন চালাতেন। পুলিশের কাছে এ সংক্রান্ত অভিযোগ গেলে অস্ট্রেলীয় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। এক পর্যায়ে তাকে সেদেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
জানা যায়, অস্ট্রেলিয়া থেকে বহিষ্কারের পর তিনি সিঙ্গাপুরে আস্তানা গাড়েন। কিন্তু সেখানেও একই ঘটনা ঘটে। সিঙ্গাপুরে সেলিনা লিন নামের এক তরুণীর সঙ্গে তিনি সম্পর্কে জড়ান। পরে সেলিনা লিন জানতে পারেন, কার্লোস একজন বড় মাদক ব্যবসায়ী। পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন তিনি। এরপর সিঙ্গাপুর সরকার তাকে সে দেশে আজীবন নিষিদ্ধ করে।
সূত্র জানায়, কার্লোস সব সময় একাধিক অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র বহন করেন। তার ফ্ল্যাটেও অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র আছে। একটি রিভলবার ও একটি পিস্তল তিনি সব সময় সঙ্গে রাখেন। কারও সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হলেই এ দুটো অস্ত্র বের করে তিনি ভয় দেখান।
শুধু তাই নয়, কার্লোসের তিনটি বিলাসবহুল গাড়ি রয়েছে। কিন্তু এসব গাড়ি চোরাই মার্কেট থেকে কেনা। তাই এসবের বৈধ কাগজপত্র কিছুই নেই। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে প্রতিটি গাড়িতেই সংসদ সদস্যের স্টিকার লাগানো। গাড়িগুলোর মধ্যে একটি মার্সিডিজ বেঞ্জ, একটি ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো ও একটি নিশান পাজেরো জিপ। তিনটি গাড়িই সাদা। এসব গাড়ির মধ্যে শনিবার মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িটি জব্দ করেছে র্যাব-৩। বাকি দুটি গাড়ির সন্ধানে অভিযান চালাচ্ছে র্যাব।
এখানেও সাফাত-রনি গ্রুপ : বনানীতে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদ ও জনৈক মন্ত্রীর ছেলের সঙ্গে কার্লোসের ঘনিষ্ঠতা একেবারেই ওপেন সিক্রেট। তাদের সঙ্গে আছেন দেশের একজন নামকরা ক্রিকেটার। কার্লোস এদের সঙ্গে নিয়ে নিয়মিত তার ফ্ল্যাটে ‘রুমপার্টি’ করতেন। সেখানে যোগ দিতেন শোবিজ জগতের নামিদামি মডেল ও অভিনেত্রীরা। কার্লোসের এক বন্ধু যুগান্তরকে বলেন, অঢেল টাকার সুবাদে কার্লোসের কালো হাতের ছায়া পড়ে বাংলা সিনেমার জগতেও। কিছুদিন আগে ‘অস্তিত্ব’ নামের সিনেমায় টাকা লগ্নি করেন তিনি। তার প্রোডাকশন হাউস ড্রিম বক্স-এর ব্যানারে এ ছবি নির্মিত হয়। তবে বাংলা সিনেমায় টাকা লগ্নি করার পেছনে তার উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। সিনেমা বানানোর আড়ালে দেশের প্রতিষ্ঠিত ও নামকরা অভিনেত্রী থেকে শুরু করে উঠতি মডেলদের নিয়ে তিনি দেশ-বিদেশে ঘুরতেন। এদের মধ্যে আছেন জনৈক মডেল ও অভিনেত্রী পিয়া বিপাশা, তানভিয়া জামান মিথিলা এবং আরেকজন বিতর্কিত পিয়াসা। এদের মধ্যে ফ্যাশন হাউস এক্সটেসির মডেল তানভিয়া জামান মিথিলার সঙ্গে তার লিভটুগেদার চলছিল বলে জানা গেছে। এসব মডেল অভিনেত্রীর একান্ত সান্নিধ্য উপভোগ ছাড়াও ব্যাংককের বড় বড় ডিস্কোতে তিনি মধ্যমণির আসন দখল করে রাখতেন। বিশেষ করে থাইল্যান্ডের পর্যটননগরী পাতায়ার রাশিয়ান ক্যাবারে ড্যান্সারদের নাচ দেখে তিনি দু’হাতে ডলারের বান্ডেল ছুড়ে দিতেন। এ ছাড়া ঢাকার গুলশান-১ এলাকায় অবস্থিত মিরেজ নামের একটি শিশা বারে নিয়মিত আড্ডা জমাতেন কার্লোস। সেখানে গার্লফ্রেন্ডদের নিয়ে হ্যাংআউট (মদ ও ইয়াবা সেবন) পার্টি করতেন।
সূত্র জানায়, অস্তিত্ব সিনেমা বানানোর পর কার্লোস ঢাকার সিনেমা পাড়ার নামিদামি নায়িকাদের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। এসব নায়িকার অনেককে নিয়ে তিনি থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় যাতায়াত শুরু করেন। এদের কয়েকজনের সঙ্গে তিনি লিভটুগেদারও করছিলেন। রাজধানীর পরীবাগের ফ্ল্যাটে চিত্রনায়িকা সাবিনা রিমাকে নিয়ে তিনি লিভটুগেদারে মেতেছিলেন বছর খানেক ধরে। সাবিনা রিমাকে পাওয়ার জন্য তিনি ওই ফ্ল্যাট কেনেন ১০ কোটি টাকায়। ফ্ল্যাটের সাজসজ্জায় ব্যয় করেন আরও অন্তত ৩ কোটি টাকা। এমন প্রাচুর্য আর আভিজাত্য দেখে সাবিনা রিমা নিজেকে কার্লোসের হাতে সঁপে দেন। কিন্তু কিছুদিন পরই তার ভুল ভাঙে। ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু কার্লোসের হাত থেকে এত সহজে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ ছিল না। শুক্রবার যৌন উত্তেজক ইনজেকশন নিয়ে তিনি একই সঙ্গে বাসার গৃহকর্মী ও সাবিনা রিমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। নির্যাতন শেষে গৃহকর্মীকে সাত তলার ছাদে নিয়ে নিচে ফেলে দেন কার্লোস। পরে পুলিশ গুরুতর আহত গৃহকর্মীর সঙ্গে সাবিনা রিমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। পরে অবশ্য সামাজিক মর্যাদাহানির ভয়ে সাবিনা হাসপাতালের বিছানা থেকে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যান।
সূত্র বলছে, সিনেমা পাড়ায় কার্লোসে ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন অনন্য মামুন নামের এক চিত্র পরিচালক। অনন্য মামুনকে গ্রেফতার করতে পারলে কার্লোসের ইয়াবা নেটওয়ার্কের অনেক তথ্য মিলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।