ক্রাইমবার্তা রিপোট:বিশেষ প্রতিনিধি , শ্যামনগর থেকে ফিরে :: শ্যমনগরের ফুলকি মুন্ডা তার পোষা তিনটি গবাদি পশু নিয়ে এখন এক সাথে রাত কাটাচ্ছেন। সকাল হলেই পশুগুলিকে ঘরের পেছনে একটি আলগা জায়গায় রাখেন। সন্ধ্যায় আবার ঘরে তোলেন। একটি গোয়ালের অভাবই ফুলকিকে তার বসতঘরে পরিবারের অন্য সব সদস্যের সাথে গবাদি পশুগুলিকে নিয়ে থাকতে বাধ্য করেছে।
আদিবাসি ফুলকি মুন্ডা জানান গত বৈশাখে তার গোয়াল ঘরটি ঝড়ে ভেঙ্গে পড়ে। এ সময় গরু তিনটিও চাপা পড়েছিল। পড়শিরা এসে পশুগুলিকে উদ্ধার করে। এরপর থেকে চুরির ভয়ে গরুগুলিকে নিয়ে রাতে একই ঘরে তাদের থাকা খাওয়া বসত। তিনি বলেন তার প্রতিবেশি রাশেদুলের দাপটে গোয়াল ঘরটি সেই স্থানে তৈরি করতে পারছি না। রাশেদুল বলছে ও জমি নাকি তার কেনা।
শতবর্ষী ফুলকি মুন্ডা জানান সেই বছর পঁচিশেক আগে শ্যামনগর উপজেলার বাদোঘাটা গ্রামে সরকারের এই খাসজমিতে বসতি গাড়েন তার স্বামী ভরত মুন্ডা। আশপাশে একে একে আরও ৩৬ টি ভূমিহীন পরিবার বাদোঘাটা গ্রামের খাসজমিতে ঘর তোলে। কোনো অশান্তি ছিলনা এতোদিন। সরকারি দফতর থেকে প্রতি বছর ডিসিআর নিয়ে বেশ চলছিল তাদের। কিন্তু হঠাৎ তাতে বাধ সাধে প্রতিবেশি রাশেদুল ইসলাম। রাশেদুল ফুলকি মুন্ডার খাস জমির পাশে সাত শতক জমি ক্রয় করেছেন। সেই জমির পার্শ্ব আইল ঠেলে এখন তিনি ফুলকিদের জমিতে ঢুকে পড়েছেন।
ফুলকির ছেলে আদিবাসী চারু মুন্ডা জানান এখানে ৬ শতাংশ জমি তার নিজের নামে ডিসিআর কাটা। তার মেয়াদ এখনও শেষ হয়নি। কিন্তু মাপজরিপের নামে প্রশাসনকে ব্যবহার করে রাশেদুল তার জমিতে ঢুকে পড়ছে জোর করেই। আমাদের ভেঙ্গে পড়া গোয়াল ঘরটি কিছুতেই নির্মান করতে দিচ্ছেন না রাশেদুল। রাশেদুল পুলিশ এনে তাদের বাড়ির বেড়া ভেঙ্গে দিয়েছে। তাদের জমিতে থাকা গাছপালাও কেটে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। বলে দিয়েছেন গাছ কাটলে জেলে যেতে হবে। তিনি জমির সীমানা নির্ণয় করে লাল পতাকা উঠিয়ে দিয়েছেন। তিনি জানান সম্প্রতি মুন্ডাপাড়া পরিদর্শনে আসা শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. কামরুজ্জামান বলেছেন ‘ বসত ঘরে ফুলকি মুন্ডা সহ গরুর ছবি তুলে কাউকে দিয়ে প্রচার করালে তোমাদের খাসজমি যেটুকু আছে তাও থাকবেনা’। তিনি বলেছেন চারুদের দখলে থাকা খাস জমি থেকে পাঁচ ফুট রাস্তা বের করে দিতে হবে। আর পুরনো জায়গায় গোয়াল ঘর তোলা যাবে না। চারু মুন্ডার পাশের আইলে জমির ক্রেতা রাশেদুল উপজেলা অফিসে চাকরি করেন। ইউএনও এবং সহকারি কমিশনার (ভূমি) সহ সরকারি কর্মকর্তারা তার দ্বারা প্রভাবিত বলে অভিযোগ করেন চারু মুন্ডা।
জানতে চাইলে জমির ক্রেতা শ্যামনগর উপজেলা আইসিটি বিভাগের টেকনিসিয়ান রাশেদুল ইসলাম বলেন আমি জমি কিনেছি বলাই ও হরেন মন্ডলের কাছ থেকে। তারা আমার জমি বুঝিয়ে দিতে চায়। মাপজরিপে পাওয়া গেছে যে চারু মুন্ডা বলাইদের রেকর্ডীয় জমি দখলে রেখেছেন। সেই জমি বের করে নেওয়া জরুরি। তবে আমি চারু মুন্ডাদের গোয়াল নির্মানে বাধা দেইনি।
বাদোঘাটা গ্রামে সরকারি খাস জমিতে বসবাসকারী ভূমিহীন হামিদা মোল্লা বলেন রাশেদুল ইসলাম আদিবাসী মুন্ডাদের জমি নিয়ে নিতে চায়। সে পার্শ্ববর্তী পতুল দাসদের ১৪ শতাংশ খাস জমির বড় অংশ দখল করে নিয়েছে। সেখানে থাকা বড় বড়গাছও কেটে নেওয়ার পাঁয়তারা করছে সে। তিনি বলেন এখানে ভূমিহীনদের ওপর নির্যাতন চলছে। তিনি আরও বলেন মুন্ডাদের ব্যবহৃত একটি খাসজমির পুকুরও দখল করে নিয়েছে রাশেদুলের ঘনিষ্ঠ জন ইয়াসিন মুহুরি। মুন্ডা পরিবারের সদস্যরা আরও জানান তারা খাস জমি দখলে রাখতে পারছেন না।
ওই এলাকার মাজেদ মাঝি বলেন মুন্ডারা দীর্ঘকাল এখানে শান্তিপূর্ন পরিবেশে বসবাস করছে। তাদের উৎখাতের ষড়যন্ত্র চলছে। তিনি বলেন তাদের দখলীয় জমিতে যা তারা ডিসিআর মূলে বন্দোবস্ত নিয়েছেন সেখানে গোয়াল ঘর তোলা যাবে না কেনো। তিনি বলেন ওরা গায়ের জোরে মুন্ডাদের বসতিতে হানা দিচ্ছে।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. কামরুজ্জামান বলেন, আমি তাদের কোনোভাবে হুমকি দেইনি। আমি গিয়েছিলাম সমস্যার সমাধান করতে। বর্ষা মওসুম শেষে খাসজমি মাপজরিপ করে পৃথকীকরণ করে মুন্ডাদের গোয়াল ঘর নির্মানের সুযোগ করে দেওয়া হবে। তিনি বলেন এ বিষয়ে ফুলকি মুন্ডাকে তার পশুদের সাথে বসবাসের প্রচার দেওয়া সরকারের জন্য বিব্রতকর। সহকারি কমিশনার (ভূমি) শেখ আবদুল্লাহ সাদিদ বলেন, ইচ্ছা করলে ফুলকি মুন্ডা আগের স্থানেই গোয়াল ঘর নির্মান করতে পারেন । তবে পূর্নাঙ্গ মাপ জরিপের পর যদি দেখা যায় তিনি রেকর্ডীয় জমিতে রয়েছেন তবে তা ছাড়তে হবে।