নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার নিয়ে দেশের দুই বৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে পাল্টাপাল্টি বিতর্ক থাকলেও সংবিধানেই এই বিতর্ক নিরসনের পথ খোলা রয়েছে বলে মনে করেন বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক। তবে এ জন্য দুই দলকে সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে কিছু বিষয়ে অবশ্যই ছাড় দেওয়ার মানসিকতা দেখাতে হবে। নয়তো যে কোনো এক পক্ষের অবস্থানের ভিত্তিতে যদি জাতীয় নির্বাচন হয়, তাহলে অন্য পক্ষের কাছে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের বাইরে রেখে বিলুপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে অন্য কোনো রূপরেখা তৈরি করেও নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা সম্ভব বলে দাবি এই আইনজ্ঞের।
এ ব্যাপারে সমকালের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় ড. শাহদীন মালিক বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই জোটই তাদের নিজ অবস্থানে অনড়। বিএনপি জোটের দাবি, সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। অন্যদিকে সরকারে থাকা আওয়ামী লীগ বলছে, সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন নির্বাচনকালীন সরকারই হবে সহায়ক সরকার। এতে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন নিয়ে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগের ও পরের অস্থিরতা ফের দেখা দিতে পারে বলেও জনমনে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। দেশ ও সমাজের বৃহৎ স্বার্থে এই অস্থিরতার দ্রুত অবসান ঘটাতে হবে।
২০১১ সালের ১১ মে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট এক রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাসংবলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দেন। তবে প্রয়োজনীয় বিধান সংশোধন করে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের বাদ দিয়ে পরবর্তী দুটি নির্বাচন (দশম ও একাদশ) করা যাবে বলে ওই রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে বিচারপতিদের বাইরে রেখে বিলুপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে অন্য কোনো রূপরেখা তৈরি করে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা সম্ভব দাবি করে শাহদীন মালিক বলেন, আমাদের ১০টি সাধারণ নির্বাচনের মধ্যে ছয়টি হয়েছে দলীয় সরকারের অধীনে। এর মধ্যে ১৯৭৩ ও ২০১৪ সালের নির্বাচন আওয়ামী লীগ সরকার, ১৯৭৯ ও ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন বিএনপি এবং ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের নির্বাচন হয়েছে এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির অধীনে। নির্বাচনগুলোর ফল পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ক্ষমতাসীন দলগুলো অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সংসদীয় আসনে জয়ী হয়েছে। তাই বাস্তবতার নিরিখে নিঃসংকোচে বলা যায়, আগামী নির্বাচনও যদি দলীয় সরকারের অধীনে হয়, তাহলে ফল এখনও বলা সম্ভব। অন্যদিকে যে চারটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছিল, তা কিন্তু সম্পূর্ণ না হলেও প্রায় গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। এ জন্য সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুসারে বিলুপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা না গেলেও ভিন্ন রূপরেখা তৈরি করে তা কিন্তু পুনর্বহাল করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন দুই বৃহৎ জোটের ঐকমত্য।
কার উদ্যোগে কীভাবে এই রূপরেখা তৈরি হতে পারে- এমন প্রশ্নে ড. শাহদীন মালিক বলেন, দেশের স্বার্থে রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী যে কেউ এ উদ্যোগ নিতে পারেন। সংবিধানের ৪৮(৫) অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিতে পারেন। এর আলোকে রাষ্ট্রপতি অন্য দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা দিতে পারেন। প্রয়োজনে এই রূপরেখা সংসদেও পাস করা যাবে।
শাহদীন মালিক বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে বহাল রেখেও সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচনকালীন সরকার হতে পারে। অবশ্য অনেক দলের এতে পূর্ণ আস্থা স্থাপনে গররাজি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তা সত্ত্বেও নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পদে বেশিরভাগ দলের আস্থাভাজন ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার হতে পারে।
অনির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হলে তা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায়ের পরিপন্থী হবে। তা ছাড়া সংবিধান অনুসারে মন্ত্রিসভার ১০ শতাংশের বেশিও টেকনোক্র্যাট কোটায় কাউকে মন্ত্রিত্ব পদে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ নেই। ফলে সংসদে কোনো ধরনের প্রতিনিধিত্ব না থাকায় বিএনপি মনোনীত ব্যক্তিদের কীভাবে নির্বাচনকালীন সরকারে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে- জানতে চাইলে শাহদীন মালিক বলেন, খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হবে এটি সহায়ক সরকার বা নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের জন্য। এ জন্য উভয় পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে সমঝোতা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী চাইলে নির্বাচনের আগে কিছু আসনে উপনির্বাচন দিয়ে বিএনপি মনোনীত ব্যক্তিদের নির্বাচিত হয়ে আসার সুযোগ দিতে পারেন অথবা টেকনোক্র্যাট কোটায় বিএনপি মনোনীতদের গুরুত্বপূর্ণ পদে মন্ত্রিসভায় স্থান দিয়েও এর সমাধান করতে পারেন।
শাহদীন মালিক আরও বলেন, সংবিধানকে উপেক্ষা করে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাই নির্বাচন প্রশ্নে সমঝোতা না হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। কিন্তু আলাপ-আলোচনা না করে সংবিধান সংশোধন করেও কোনো সুফল আসবে না। আর এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর আলাপ-আলোচনা বা সংলাপ প্রয়োজন।
নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে অতীতের নানা সংকটের কথা উল্লেখ করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, এ সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্য নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সমঝোতা কমিশনও গঠন করা যেতে পারে। এই কমিশনের সদস্য সংখ্যা পাঁচ থেকে সাতজনের বেশি হবে না। এ ব্যাপারে সরকার একটি নীতি প্রণয়ন অথবা তিন থেকে ছয় মাসের কার্যকর একটি অস্থায়ী আইন করে সমঝোতা কমিশনের কার্যক্রমকে বৈধতা দিতে পারে। একইভাবে রাষ্ট্রপতিও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে এ ধরনের কমিশন গঠনের উদ্যোগ নিতে পারেন।
সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা প্রসঙ্গে শাহদীন মালিক বলেন, আগামী নির্বাচনের জন্য এ বছরের মধ্যে অথবা সর্বোচ্চ ২০১৮ সালের মার্চের মধ্যে নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করতে হবে। সংসদীয় সীমানা যেখানে প্রয়োজন, পুনর্নির্ধারণ করতে হবে। এ প্রক্রিয়া যদি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়, তাহলে প্রথম পরীক্ষায় নির্বাচন কমিশন উত্তীর্ণ হবে। পরের বিষয়গুলো রাজনৈতিক সমঝোতার বিষয়। তবে শেষ বিচারে অবশ্যই সরকার, রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন কমিশনকে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। এ ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্য কমিশনারদের দৃঢ়তা ও কাউকে ছাড় না দেওয়ার মানসিকতাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া শুধু নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা অসম্ভব।