কেউ না কেঁদে পারলো না
জাকিয়া আহমেদঃ জুলাই ১২ , ২০১৭
ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্টঃ
বিরল রোগে আক্রান্ত মুক্তামনি
‘আমার ভাইটা যখন কাঁদে, তখন ওকে আমি কোলে নিতে পারি না। ভাইটাকে কোনোদিন কোলে নিতে পারলাম না আমি। আমার খুব কষ্ট হয়, খুব ব্যথা হয়’ বলেই বেডে শুয়ে থাকা মুক্তামনি কেঁদে দিল। কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকলো, ‘আমার মা যখন রান্না করে তখন মা ভাইকে কোলে নিতে পারে না, ভাইটা তখন কাঁদে, আর আমি শুয়ে শুয়ে কেবলই তা দেখি। ও আমার কাছে এসে আপি আপি করে, কিন্তু কোনোদিন ওকে একটু আদর করতে পারলাম না।’
মুক্তামনি যখন এসব বলছিল তখন পাশ থাকা বাবা ইব্রাহীম হোসেন, মা আছমা খাতুন আর মুক্তামনির জমজ বোন হীরামনি কেঁদে উঠলো শব্দ করে, আর এত এত পুড়ে যাওয়া রোগীকে নিত্যদিন দেখেও যেসব চিকিৎসক আর নার্সরা অভ্যস্ত তারাও সামলাতে পারলেন না নিজেদের। কেবিনে অবস্থান করা চিকিৎসক নার্সদের চোখও হয়ে ওঠে লাল, কারও চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো পানি। এক অদ্ভুত নীরবতার মধ্যে মুক্তামনি কান্নার সঙ্গে বলে চলে, ‘আমার খুব ব্যথা, আমি যেন ভালো হয়ে যাই, আমি স্কুলে যেতে চাই।’
পাশে থাকা বাবাকে কাঁদতে দেখে আরও জোরে কেঁদে মুক্তামনি বলে, ‘এতো বছরে আমার বাবা কোনোদিন আমার গায়ে হাত তোলে নাই, আমাকে আমার বাবা আম্মাজান বলে ডাকে।আমাকে সবার চেয়ে বেশি আদর করে, আমি ভালো হতে চাই। আর ভালো হয়ে প্রথমেই ছোট ভাইটাকে কোলে নেবো।’
আজ ১২ জুলাই সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি রোগে আক্রান্ত মুক্তামনির কেবিনে দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করে এমনটাই দেখা যায়। আজ সকাল থেকেই মুক্তামনির কেবিনে চিকিৎসক এবং নার্সদের ভিড়।গতকাল মুক্তামনির চিকিৎসায় গঠিত ৮ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ডের সদস্যরা এক এক করে কেবিনে এসে দেখে যাচ্ছেন মুক্তামনিকে।
তারা নিজেদের মতামত দিচ্ছেন,অপরদিকে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রক্ত নেওয়া হলো কয়েকবার। এতবার রক্ত কেন নেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে কর্তব্যরত নার্স রাখি জানালেন,‘কয়েকবার রক্ত নেওয়া হয়নি। ওর শরীরে এতো রক্তশূণ্যতা যে কোথাও পুশ করেই আমরা রক্ত পাচ্ছি না। তাই হাতের কয়েক জায়গায় ইনজেকশন পুশ করে চেষ্টা করা হচ্ছে।’
গতকাল গন্ধ ছিল না, কিন্তু আজ কেবিনসহ পুরো এলাকাটাই দুর্গন্ধময় হয়ে আছে কেন জানতে চাইলে রাখি বলেন,‘আজ সকালে মুক্তামনির হাতের সামান্য ড্রেসিং করা হয়েছে,ব্যান্ডেজ খোলা হয়েছে তাই এতো দুর্গন্ধ বেরিয়েছে।’ পাশে থাকা হীরামনি তখন বলে ওঠে,‘বাড়িতে সবসময় এমন গন্ধই বের হতো,তাই এলাকার মানুষ কেউ বেশি আসতো না আমাদের কাছে।’
মুক্তামনির কথা শুনে পাশে বসে কাঁদে তার যমজ বোন হীরামনি
এরই ফাঁকে মুক্তামনির চিকিৎসায় গঠিত ৮ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ডের সদস্য ও চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা.রাশেদ মোহাম্মদ খানকে নিয়ে মুক্তামনির কেবিনে ঢোকেন।মুক্তামনির কেসহিস্ট্রি নিয়ে তারা নিজেদের মতো করে আলোচনা করেন। এসময় ডা.সেন বলেন,রোগটা কম্প্লিকেটেড আর নেগলেকটেড কেস-হাতের এ অবস্থা কেন হয়েছে সেটা এখনও বলতে পারছি না।তবে মেয়েটি যদি সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা পেত তাহলে আজ তার এই অবস্থা হতো না,সে ভুল আর অপচিকিৎসার শিকার।মেয়েটির শরীরের সব রক্ত তার হাতের ঘায়ে চলে যাওয়াতে ওর শরীরে রক্ত নেই বললেই চলে।তবে এতো কিছুর পরও আশাবাদী মেডিক্যাল বোর্ড। ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, আমরা আশাবাদী ওর চিকিৎসার বিষয়ে,তার হাতের ফাংশন ঠিক রয়েছে, হাত মুঠি করতে পারে,বাকিটা দেখা যাক।http://m.banglatribune.com/
এভাবেই মেয়ে মুক্তামনির গুনগান গাচ্ছিলেন তার বাবা মুদি দোকানী ইব্রাহীম। ঢাকা মেডিকেলের বার্ণ ইউনিটের ৬০৮ নম্বর কেবিনে বসে তিনি যখন এসব কথা বলছিলেন, তখন তার পাশেই হাতে ব্যান্ডেস বাধা অবস্থায় শুয়ে ছিলো বহুমাত্রিক চর্ম রোগে আক্রান্ত সাতক্ষীরার শিশু মুক্তামনি। এসময় বাবার কথা শুনে মিটিমিটি হাসছিলো সে।
তিনি বলেন “আমার মেয়েটা এতো সুন্দর গজল গায়, ঘরে যখন শুয়ে থাকে, সময় কাটেনা তখন একা একাই সুন্দর করে গজল গায়। শুনলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন, এত সুন্দর কন্ঠ। ও সব পারে, যা দেখবে যা শুনবে ও সব করে দিতে পারবে।”
“ওর মনে অনেক আশা, আমারে বলে ‘আল্লাহ যদি আমারে ভাল করে দিতো, তাহলে আমি তোমাদের সাথে সব জায়গায় বেড়াতে যেতাম’।”
মেয়ের সুস্থ্যতার জন্য বাবা ইব্রাহীম সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেন, “জন্মের পর থেকে কোন স্বাদ আল্লাদ পূরণ করতে পারলোনা মেয়েটা, তুমি ওকে সুস্থ্য করে দাও, আমি যেন ওকে তোমার সুন্দর পৃথিবী ঘুরে দেখাতে পারি।”