খুলনা থেকে মোংলার দিকে যেতে দুই পাশের চিংড়িঘের ও ফসলের জমিতে রংবেরঙের সাইনবোর্ড চোখে পড়ল। কোনোটাতে লেখা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নাম, কোনোটাতে মালিকের নাম। মোংলা ঘাট পেরিয়ে চিলা ইউনিয়ন হয়ে জয়মনির ঘোল গ্রাম। সুন্দরবনের পাশ ঘেঁষে এই গ্রামে খাদ্য অধিদপ্তর নির্মাণ করেছে একটি সাইলো বা বড় খাদ্যগুদাম।
এসব কর্মকাণ্ড দেখে কারও মনে হতে পারে, সুন্দরবনের পাশ ঘেঁষে এ যেন শিল্পপল্লি। ভিরমি খেতে হলো মোংলা ঘাটে স্থাপন করা একটি বিশাল সাইনবোর্ড দেখে। বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ওই সাইনবোর্ডে লেখা এলাকাটি সরকারঘোষিত প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন (ইসিএ)। সেখানে লেখা, এখানকার মাটি, পানি, বায়ু ও শব্দদূষণকারী শিল্প বা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা যাবে না। ভূমি ও পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন এবং প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল ধ্বংস হয় এমন কর্মকাণ্ডও নিষেধ।
পরিবেশ অধিদপ্তরের খুলনা কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার ইসিএ এলাকায় মোট ১৮৬টি শিল্প ও প্রকল্পকে পরিবেশের প্রাথমিক (অবস্থানগত) ও চূড়ান্ত ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। সংস্থাটির সমীক্ষা থেকে ওই হিসাবটি পাওয়া গেছে। এতে দেখা গেছে, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার মোট ৯টি উপজেলায় ১৪০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও প্রকল্প ছাড়পত্র পেয়েছে। এ ছাড়া মোংলা রপ্তানি প্রক্রিয়াজাত এলাকায় (ইপিজেড) ২১টি, মোংলা বন্দর শিল্প অঞ্চলে ২০টি, মোংলা বন্দরসংলগ্ন এলাকায় ৫টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে। এর বাইরে আরও ১৬টি প্রতিষ্ঠান ছাড়পত্র পেতে পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে আবেদন করেছে।
গত মাসে সরেজমিনে মোংলা ইপিজেড ও শিল্পাঞ্চলে বিশাল সব শিল্পকারখানার সারি পেরিয়ে রামপালের দিকে যেতে দুই পাশে এমন কোনো জমি চোখে পড়ল না, যেখানে কোনো না কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির মালিকানা দাবি করে সাইনবোর্ড নেই। মোংলা থেকে দ্বিগরাজ ইউনিয়ন সদরের পাশ দিয়ে দেখা গেল, সদ্য নির্মিত বিশাল রাস্তা গ্রামের ভেতরে চলে গেছে। রাস্তার শেষ সীমানায় রয়েছে ইনডেক্স গ্রুপ নামের একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলপিজি) প্ল্যান্ট। সেখানে কিছুক্ষণ পরপর ট্রাক ঢুকছে আর গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে বেরিয়ে আসছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন বলছে, ইনডেক্স গ্রুপের প্ল্যান্টটি সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে পড়েছে। তবে সুন্দরবনের ২ কিলোমিটারের মধ্যে জয়মনি গ্রামে তাদের বেশ কয়েকটি শিল্প প্লট রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইনডেক্স গ্রুপের পরিচালক এহসান তানিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের শিল্প প্লটটি শুরু হয়েছে সুন্দরবনের ৯ দশমিক ৮ কিলোমিটার দূর থেকে। আর কারখানাটি ১০ কিলোমিটারের বাইরে।’ ‘সুন্দরবনের সীমানার মধ্যে আমরা কোনো শিল্প বা স্থাপনা করব না’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আমাদের উৎপাদিত এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার বেক্সিমকো পেট্রোলিয়াম থেকে বাজারজাত করা হয়।’
গত বছরের ৯ আগস্ট প্রথম আলোতে ‘সুন্দরবন ঘিরে ১৫০ শিল্প প্রকল্প!’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রথম আলোর ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর এ বিষয়ে জানতে চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিতে শিল্পকারখানা ও অবকাঠামো নির্মাণের জন্য নিষিদ্ধ ওই ইসিএ এলাকায় কী ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, তার একটি তালিকা দিতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে বলা হয়।
পরিবেশ অধিদপ্তরের খুলনা কার্যালয়ের তৎকালীন পরিচালক মল্লিক আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে ইসিএ এলাকার শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ওপর একটি সমীক্ষা চালানো হয়। সমীক্ষায় পাওয়া শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা, একটি প্রতিবেদন ও একটি তথ্যচিত্র তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়। এর আগে তারা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও স্থানীয় পরিবেশবিদদের সঙ্গে বৈঠক করে এ বিষয়ে মতামত নেয়। শিল্পকারখানার মালিক ও ব্যবস্থাপকদের সঙ্গেও বৈঠক করে পরিবেশ অধিদপ্তর। প্রতিবেদনের সুপারিশে পরিবেশ রক্ষার শর্ত সাপেক্ষে ও বিশেষ বিবেচনায় ইপিজেড ও মোংলা শিল্প অঞ্চলের কারখানাগুলোকে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার অনুমতির কথা বলা হয়। একই সঙ্গে চিংড়িঘের, হ্যাচারিগুলোকেও ছাড়পত্র নবায়ন করা যেতে পারে বলে মতামত দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে খুলনা পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক হাবিবুল হক খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের প্রতিবেদনটি সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তের জন্য পাঠিয়েছি। এখন তারা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিলে আমরা সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেব।’
গত বছরের আগস্টে প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ১৫০টি শিল্প প্রকল্প পরিবেশের অবস্থানগত ছাড়পত্র পেয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। দেড় বছরের মাথায় আরও ৩৬টি শিল্প প্রকল্প ছাড়পত্র পেয়েছে।
এ বিষয়ে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা পরিবেশ রক্ষা করতে চাই, আবার শিল্পকারখানাও আমাদের জন্য দরকার। শিল্পকারখানা যদি হয়ও, তাহলেও যাতে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি না হয় সে জন্য আমরা ব্যবস্থা নেব। এই দুটির মধ্যে সমন্বয় করেই আমাদের টেকসই উন্নয়ন করতে হবে।’
সুন্দরবনের এক কিলোমিটার সীমানায় মোংলা উপজেলার জয়মনির ঘোল গ্রামে প্রায় ২০০ একর জমি কিনেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ। তিনি সেখানে সানমেরিন শিপইয়ার্ড নামে একটি জাহাজ নির্মাণ কারখানা করার জন্য পরিবেশ ছাড়পত্র নিয়েছিলেন। তবে তিনি সেখানে জাহাজ নির্মাণ কারখানা করছেন না বলে প্রথম আলোকে জানান। সরেজমিনে দেখা গেছে, ওই জমিতে স্থানীয় দুজন ব্যক্তি ইজারা নিয়ে চিংড়ি চাষ করছেন।
এ ব্যাপারে মাহবুব উল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার ওই এলাকাকে শিল্পকারখানার জন্য নিষিদ্ধ এলাকা অর্থাৎ ইসিএ ঘোষণা করার পর আমরা সিদ্ধান্ত বদল করেছি। সেখানে কোনো শিল্পকারখানা করব না। জমিটি বিক্রি করে দেওয়ার জন্য ইতিমধ্যে বায়নাও করে ফেলেছি।’
বঙ্গবন্ধু বন্য প্রাণী অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রেজা খান প্রথম আলোকে বলেন, একসময় সুন্দরবন খুলনা-যশোর ও বাগেরহাট শহর হয়ে ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এখন তা কমে বাংলাদেশ অংশে প্রায় ৬ হাজার বর্গকিলোমিটারে নেমে এসেছে। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পৃথিবীর বেশির ভাগ বনের চারপাশের ১০ থেকে ২০ কিলোমিটার এলাকাকে সংরক্ষিত হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে বন্য প্রাণীদের যাতায়াতের উপযোগী পরিবেশ রাখতে হয়।
রেজা খান বলেন, সরকার সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটারকে ইসিএ ঘোষণা করে সংরক্ষণ করতে চাইছে। এটা যত কঠিনই হোক না কেন তা করতে হবে। সেখানে নতুন কোনো কারখানা তো করতে দেওয়া যাবেই না, যেগুলো আছে সেগুলো সরিয়ে নিতে হবে। নয়তো সরকার সুন্দরবন রক্ষার যে ঘোষণা দিয়েছে, তা কখনোই বাস্তবায়ন হবে না
প্রথম আলো