ক্ষুব্ধ পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের গত জুন মাসের বেতন স্থগিত হয়ে গেছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) বেতন-ভাতার বিল তৈরি করলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করছে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সিলেট সফর শেষে ঢাকায় ফিরে এসব ইস্যুতে সংবাদ সম্মেলন করতে পারেন বলে মন্ত্রণালয় সূত্র সমকালকে জানিয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্টের টাকা দিতে তাদের বেতন থেকে চাঁদা হিসেবে কেটে রাখা টাকার পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। গত ১৫ জুন এ-সংক্রান্ত গেজেট জারি হয়েছে। নতুন সিদ্ধান্তের ফলে বছরে অতিরিক্ত ৪২৫ কোটি টাকা পাওয়া যাবে। ফলে বেসরকারি শিক্ষকদের অবসর ও কল্যাণ ভাতার টাকা পাওয়ার জন্য আর বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হবে না। প্রতি বছরের আবেদন ওই বছরই পরিশোধ করা সম্ভব হবে। ইতিমধ্যে সৃষ্ট দীর্ঘ জটও কেটে যাবে।
বর্তমানে কল্যাণ ট্রাস্টের চাঁদা বাবদ একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষকের বেতন থেকে ২ শতাংশ টাকা কেটে রাখা হয়। তা বাড়িয়ে ৪ শতাংশ করা হয়েছে বলে জানান বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ মো. শাজাহান আলম সাজু। তিনি জানান, অবসর সুবিধা বাবদ বর্তমানে একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষকের বেতন থেকে ৪ শতাংশ টাকা কেটে রাখা হয়। তা বাড়িয়ে ৬ শতাংশ করা হয়েছে।
সমস্যার মূল যেখানে :প্রতি মাসে সারাদেশে পাঁচ শতাধিক বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী চাকরি থেকে অবসরে যান। তাদের অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্টের অর্থ দিতে প্রয়োজন হয় ৩৬ কোটি টাকা। অথচ এ সুবিধা দেওয়ার সরকারি দুটি প্রতিষ্ঠান বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড এবং বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের প্রতি মাসের আয় ১৮ কোটি টাকা। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রতি মাসে সরকারি বেতন-ভাতা বাবদ দেওয়া ৬৫৮ কোটি ৯৬ লাখ ৯৫ হাজার ৯০৬ টাকা থেকে ২ ও ৪ শতাংশ হারে কেটে রাখা চাঁদা ও ব্যাংকের মুনাফা থেকে এ পরিমাণ অর্থ আসে। ফলে প্রতি মাসে এ খাতে ঘাটতি থাকে ১৮ কোটি টাকা। যে কারণে প্রতি মাসে আবেদনকারী অবসরভোগী শিক্ষক-কর্মচারীদের মাত্র অর্ধেকের পাওনা শোধ করা যায়। এভাবে অনিষ্পন্ন আবেদনের সংখ্যা জমতে জমতে বর্তমানে তা ৭০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ২০১২ সালে অবসরে যাওয়া শিক্ষক-কর্মচারীদের আবেদন বর্তমানে নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। অর্থাৎ অবসরে যাওয়ার পরও সাড়ে তিন
থেকে চার বছর লাগছে এ অর্থ পেতে। শিক্ষকরা বলেন, ২০০২ সালে অবসর সুবিধা বোর্ড প্রতিষ্ঠার সময় কথা ছিল, শিক্ষকরা যে পরিমাণ অর্থ দেবেন, সরকারও সমপরিমাণ টাকা দেবে। বাস্তবে তা হয়নি। ২০০২ সালের পর ২০১৫ সাল পর্যন্ত সরকার এ খাতে কোনো টাকা দেয়নি। ২০১৬ সালে এসে সরকার এ দুটি প্রতিষ্ঠানকে ৬০০ কোটি টাকার সিডমানি দিয়েছে। এত দিন সরকার কোনো টাকা না দেওয়ায় এ সংকট তীব্র হয়েছে।
আন্দোলনে শিক্ষক সংগঠনগুলো :বেসরকারি শিক্ষকদের সংগঠনগুলো বলছে, নতুন গেজেটের কারণে তাদের বেতনের মোট ১০ শতাংশ টাকাই তারা ঘরে তুলতে পারছেন না। এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা না হলে পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীকে ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলনে নামার হুমকি দিয়েছেন তারা। ইতিমধ্যে ১২ জুলাই সারাদেশে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি। এতে দাবি পূরণ না হলে আরও কঠোর কর্মসূচি ও আইনের আশ্রয় নেওয়ার কথাও জানিয়েছে সংগঠনটি।
গত শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে ওই সংগঠনের নেতারা জানান, তথাকথিত শিক্ষক নেতা ও আমলারা যৌথভাবে বেতন থেকে ১০ শতাংশ টাকা কেটে রাখার এ অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে মাঠ পর্যায়ের একজন শিক্ষকের সঙ্গেও কথা বলা হয়নি। শিক্ষক সমিতির সভাপতি আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, অতিরিক্ত এ টাকা দেওয়ার পর ভবিষ্যতে একজন শিক্ষক বাড়তি কী সুবিধা পাবেন, এরও কোনো ব্যাখ্যা নেই। এর ব্যাখ্যা চান তিনি।
শিক্ষক নেতারা বলেন, অবসরে যাওয়া শিক্ষকদের দুর্ভোগ কমাতে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সরকার থোক বরাদ্দ হিসেবে অবসর বোর্ডকে ১০০ কোটি এবং কল্যাণ ট্রাস্টকে ৫০ কোটি টাকা দেয়। এই টাকা পেতে ১১ মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে দুই বোর্ডকে। কারণ আমলারা নতুন করে শর্ত জুড়ে দেয়, এ টাকা পেতে হলে শিক্ষকদের চাঁদার হার ছয় শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ করতে হবে। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায়ও এ ধরনের কোনো কথা ছিল না। চাঁদার হার না বাড়িয়ে থোক বরাদ্দ পেতে অনেক দৌড়ঝাঁপ করেও দুই বোর্ডের সদস্য সচিবরা ব্যর্থ হন। পরে বাধ্য হয়ে চাঁদার হার ১০ শতাংশ করার পর এই ১৫০ কোটি টাকা মেলে। এ ছাড়া অবসর বোর্ডে সিডমানি হিসেবে (যা খরচ করা যাবে না) দেওয়া হয়েছে কোটি টাকা। থোক বরাদ্দ, সিডমানির সুদ এবং চাঁদাসহ অন্যান্য অর্থ মিলিয়ে এক বছরে আট হাজার আবেদন নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়েছে।
এ ব্যাপারে অবসর সুবিধা বোর্ডের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ শরীফ আহমেদ সাদী বলেন, ‘২০১৫ সালে অষ্টম পে-স্কেল চালু হওয়ার পর একজন শিক্ষকের বেতন ও অবসর ভাতা দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু অবসর চাঁদার পরিমাণ বাড়েনি। এটা সমাধানের দুটি পথ ছিল_ হয় অতিরিক্ত চাঁদা আদায়, না হয় সরকার থেকে বিশেষ প্যাকেজ বরাদ্দ দেওয়া। সরকার দ্বিতীয়টির ব্যাপারে নেতিবাচক অবস্থান নেওয়ায় সবাই মিলে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এর পরও যদি বলা হয়, আমাদের উদ্যোগ ব্যর্থ, তাহলে আর কিছু করার নেই।’
কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ মো. শাজাহান আলম সাজু বলেন, ‘যেসব শিক্ষক নেতা সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি, তারা মিথ্যা বলছেন। আমি প্রমাণ দেখাতে পারব ওই সংগঠনের প্রতিনিধি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সভায় উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিতির স্বাক্ষর দিয়েছেন এবং সভার সম্মানীও নিয়েছেন। এ ইস্যুতে শিক্ষক নেতাদের দ্বৈত ভূমিকা পালনের কোনো সুযোগ নেই।’সমকাল