যুগান্তর : নির্বাচনী ট্রেনে এখন রাজনীতি। বলা যায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সেই ট্রেনের ড্রাইভিং সিটেই আছে। আপনি কী মনে করেন?
ওবায়দুল কাদের : আমরা ট্রেনেই আছি। প্রস্তুতি আরও আগেই শুরু করেছি। এখন সেই প্রস্তুতি পুরোদমে এগিয়ে চলেছে। আমাদের একদিকে বিভিন্ন আসনে সংসদ সদস্যদের কার কী অবস্থা এ বিষয়ে জরিপ কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি বেশ কয়েকটি সংস্থা জরিপ করছে। জরিপে পেশাজীবীরা যেমন আছেন তেমনি সরকারি সংস্থাও আছে। এর পাশাপাশি আমরা দলীয় পর্যায়েও খোঁজখবর নিচ্ছি, ক্লোজলি মনিটর করছি। পাশাপাশি সাংগঠনিক কাজও এগিয়ে চলছে। আমরা বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে প্রতিনিধি সভা করছি। বরিশাল ও ময়মনসিংহ বিভাগে শিগগিরই প্রতিনিধি সভা হবে। জেলা পর্যায়ে আমরা অনেক প্রতিনিধি সভা করেছি। এটা শুধু আনুষ্ঠানিক সভা নয়, কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তৃতা-ভাষণে সবকিছু সীমাবদ্ধ রাখিনি আমরা, তৃণমূলে নেতাকর্মীদের বক্তব্যও শুনছি। তাদেরও প্রার্থী নিয়ে চিন্তাভাবনা আছে। সেটা তাদের আলোচনায় প্রকাশ পাচ্ছে। আবার নির্বাচনের সময় তৃণমূলকে একটা চয়েস দেয়া হবে প্রার্থী বাছাইয়ে। তারা প্রার্থী বাছাইয়ে তিনজন পর্যন্ত নাম পাঠাতে পারে। সেটা আমরা জরিপের সঙ্গে মিলিয়ে প্রার্থী বাছাই করব এবং মনোনয়ন দেব।
যুগান্তর : তৃণমূল পর্যায়ে অনেক সংসদ সদস্যই বিতর্কিত হয়ে পড়েছেন। অনেকের বিরুদ্ধে খুন, দুর্নীতিসহ মাদক পাচারের অভিযোগ আছে। কিছু কিছু জরিপেও এমন সংসদ সদস্য চিহ্নিত হয়েছে বলে জেনেছি। প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে এসব বিষয় আমলে নেবেন কিনা? নতুন মুখ কি আসবে?
ওবায়দুল কাদের : নতুন মুখ আসবে বেশকিছু আসনে। তবে কতটি আসনে পরিবর্তন হবে তা এখন বলতে পারছি না। এখন যারা আছেন, তাদের কর্মকাণ্ডে যদি কোনো ঘাটতি থাকে, জনমনে কাউকে নিয়ে যদি ইমেজ সংকট থাকে, তাদের আমরা শুদ্ধ হওয়ার জন্য সময়সীমা দিয়েছি- আগামী ছয় মাসের মধ্যে তোমরা নিজেদের ঠিক করে নাও। এ নির্দেশনা মোতাবেক যদি তারা নিজেদের শুদ্ধ করে নিতে পারে, তাহলে আমরা অবশ্যই বিজয়ী হতে পারে এমন প্রার্থীকে মনোনয়নের জন্য বিবেচনা করব।
যুগান্তর : সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতা, মন্ত্রী তাদের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। তারা কি এবার মনোনয়নবঞ্চিত হবেন?
ওবায়দুল কাদের : আমি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী- এলাকায় আমারও যদি জনপ্রিয়তা না থাকে, আমি যদি বিজয়ী হওয়ার মতো প্রার্থী না হই, তাহলে আমি নিজেও মনোনয়ন নেব না। জনগণ না চাইলে আমি কেন দাঁড়াব?
যুগান্তর : কোন প্রার্থী বিজয়ী হওয়ার যোগ্যতা রাখে- এর মাপকাঠি কী হবে?
ওবায়দুল কাদের : জনগণকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে প্রার্থীর কার্যকলাপ সম্পর্কে। আমি একটা এলাকায় পা দিলেই তো বুঝতে পারব ওখানকার এমপি সম্পর্কে জনগণের কী ধারণা। আজকাল মানুষ চুপচাপ থাকে না।
যুগান্তর : আওয়ামী লীগ পরপর দু’বার ক্ষমতায়। এবার তৃতীয়বারের জন্য লড়াইয়ে নামছে। সেক্ষেত্রে আবার বিজয় অর্জন কতটা চ্যালেঞ্জের হবে?
ওবায়দুল কাদের : সবকিছু তো ফেভারে থাকে না। আওয়ামী লীগ পরপর দু’বার ক্ষমতাসীন। তাই থার্ড টার্ম নির্বাচনে জেতা একটু কঠিন। এ সমস্যা সব দেশেই আছে। তুরস্কে এরদোগান প্রথমবার যেভাবে জিতেছেন, দ্বিতীয়বার কিন্তু তার ভোট কমেছে। তৃতীয়বারে গিয়ে তার ভোট আরও বেশি কমেছে। অতিরিক্ত ক্ষমতা ব্যবহারের জবাবে গণভোটে তার পক্ষে যে রায় এসেছে তা খুব বেশি ছিল না। তাই তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার ক্ষেত্রে একটা সমস্যা থাকে। তারপরও আমাদের একটা বিশ্বাস আছে। পঁচাত্তর-পরবর্তী ২৮ বছরে যে উন্নয়ন হয়নি, সে উন্নয়ন আমরা গত তিন-সাড়ে তিন বছরে করেছি। এর রেকর্ড আছে এবং এটা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ও প্রশংসিত। বাংলাদেশের লোকজনও জানে। শহরের ভোটারদের মধ্যে নানারকম টানাপোড়েন থাকে, একেকটা বিষয়ে আলোড়িত হয়, হলি আর্টিজান এটারও একটা প্রতিক্রিয়া থাকে, জীবনকে বদলে দেয় এরকম অনেক ঘটনা আছে। তবে গ্রামের চিত্র কিন্তু ভিন্ন। গ্রামের লোকরা উন্নয়নকে প্রাধান্য দেয় আর দেয় আচরণকে। উন্নয়নকে তারা নম্বর ওয়ান প্রায়োরিটি দেয়, নম্বর টু হচ্ছে আচরণ। এখন আচরণের জন্য আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারি যেহেতু আমরা ক্ষমতায়। ক্ষমতায় থেকে ক্ষমতার দাপট দেখানো- এটা ক্ষতি করে। বিভিন্ন আসনের ক্ষেত্রে অবশ্য এর পার্থক্য আছে। এরপরও আমাদের একটা হিসাব আমরা করেছি। সেই হিসাবে আমরা হয়তো গতবারের মতো অত আসন পাব না। তবে আসন কমলেও বিজয়ের ব্যাপারে আমরা সম্পূর্ণ আশাবাদী।
যুগান্তর : আপনারা ক্ষমতায় আছেন। তাই অনেক আসনে ক্ষমতার দ্বন্দ্বও আছে। এর বহিঃপ্রকাশ বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, দেখা যাচ্ছে। এ কোন্দল জিইয়ে থাকলে নির্বাচনে কি তা প্রভাব ফেলবে না?
ওবায়দুল কাদের : কোন্দল নিরসনে আমাদের তৎপরতা অব্যাহত আছে। যেখানে দ্বন্দ্ব-সংকট আছে সেখানকার নেতাদের নিয়ে দু-একদিন পরপরই বৈঠক চলছে। সংশ্লিষ্ট নেতাদের ডেকে নিয়ে মীমাংসা করছি, কথাবার্তা বলছি। এতে ফল পাচ্ছি। আমি যখনই ঢাকায় থাকি এবং আমাদের যারা সংশ্লিষ্ট যুগ্ম সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক আছেন, তাদের নিয়ে আমরা প্রতিদিনই সংকট নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছি। যাকে যা বলার বলে দিচ্ছি। আর কোথাও সাংগঠনিক সংকট থাকলে এর মীমাংসাটাও আমরা এ বৈঠক থেকে দিয়ে দিচ্ছি।
যুগান্তর : তবে কিছু জায়গায় দ্বন্দ্ব-সংকট লেগেই আছে। কোনো কিছুতেই এর সমাধান হচ্ছে না মনে হয়। চট্টগ্রাম এর উদাহরণ হতে পারে।
ওবায়দুল কাদের : বড় দলে বড় কিছু দ্বন্দ্ব থাকবেই। এটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের কর্মীরা সচেতন। এটা আমি এই অর্থে বলছি- কিছু নেতা আছে যারা নবাগত, টাকা-পয়সা আছে, নির্বাচন করতে চায়। আবার দলেরও অনেকের ইচ্ছা থাকতেই পারে নির্বাচনের। বড় দল, তাদেরও এমপি হওয়ার একটা স্বপ্ন থাকতে পারে, তারাও চেষ্টা করতে পারে। তবে আমরা সবাইকে বলে দিয়েছি, এখন কোনো প্রার্থী নেই, প্রার্থী হচ্ছে নৌকা। নৌকাকে প্রার্থী করে সবাইকে এগিয়ে যেতে হবে। যাকে মনোনয়ন দেয়া হবে সে-ই আমাদের প্রার্থী। তার পক্ষেই কাজ করতে হবে। আমাদের কর্মীদের এবার একটা বিষয় আছে- পেছনে ফিরে দেখার একটা তাগিদ আছে। সেটা হল ২০০১ সালে বিএনপি যখন ক্ষমতায় আসে তখন আমাদের হাজার হাজার কর্মী ঘরছাড়া হয়েছে। আমাদের ২১ হাজার নেতাকর্মী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। আজকে বিএনপি গুম-খুনের কথা বলে, সেই সময় আমাদের কতজন গুম হয়েছে এর হিসাব নেই। কিবরিয়া সাহেব, আহসান উল্লাহ মাস্টারের মতো আমাদের প্রথম সারির অনেক নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। এরপর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সেই হামলায় আইভি রহমানসহ ২৩ জন নিহত হয়েছেন। তবে এর প্রধান লক্ষ্য ছিল আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা। এ তথ্যগুলো সবাই জানে। সেই বিভীষিকা, সেই অন্ধকারের ছবি খুব বেশিদিন আগের নয়। তাই আমাদের নেতাকর্মীদের মনে আছে বিএনপি আগের মতো আবার ক্ষমতায় এলে কী হতে পারে। সেই ২০০১ সাল-পরবর্তী যে অবস্থা হয়েছিল এদেশে, তার চেয়ে ভয়াবহ দুঃসময় নেমে আসবে। কাজেই এ বিবেচনায় আমরা ঐক্যবদ্ধ। এটাও আমাদের ঐক্যের একটা অনুঘটক।
যুগান্তর : সাংগঠনিক ঐক্য বা কার্যক্রমের জায়গা থেকে দ্রুত সহ-সম্পাদক নিয়োগের দাবি আছে নেতাকর্মীদের। শিগগিরই কি এ তালিকা ঘোষণা করা হবে?
ওবায়দুল কাদের : এবার সহ-সম্পাদকের তালিকা আমি করে দিচ্ছি না। এক্ষেত্রে নেত্রীর নির্দেশ আছে। সহ-সম্পাদক আমাদের প্রত্যেক যুগ্ম সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদকের সঙ্গে তিনজন করে থাকবে। আট বিভাগে ২৪ জন। ১৯টি সম্পাদকীয় পদ আছে। এর মধ্যে গুরুত্ব ও কাজ বিবেচনায় রেখে প্রতিটি পদের বিপরীতে সহ-সম্পাদক পাঁচজনের মধ্যে সীমিত থাকবে। কেউ তিনজন পাবে, কেউ চারজন, কেউবা পাঁচজন পাবে। কিন্তু উপকমিটি হবে ২০ থেকে ৩০ জনের। এখানে এক্সপার্ট আসবে। আমাদের সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোতে যে সংসদ সদস্যরা আছেন, তারা এখানে চলে আসবেন। কাজেই এবার সদস্য থাকা নিয়ে কারও কোনো দ্বিধা থাকবে না। এসব ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমে তালিকা জমা পড়ছে। জমা দিলে আমরা অনুমোদন দিয়ে দিচ্ছি। এবার ওভাবে তালিকা দেব না। তবে বলতে পারি সহ-সম্পাদক একশ’র ভেতরে থাকবে। সদস্য অনেক থাকবে।
যুগান্তর : তবে গতবার সহ-সম্পাদকদের মান নিয়ে প্রশ্ন ছিল। তাদের কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ ছিল।
ওবায়দুল কাদের : গতবারেরটা গতবারের বিষয়। তখন বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে কৌশলগত কারণে সীমারেখাটা ধরে রাখতে পারিনি। এবার আমরা সীমারেখার বাইরে যাব না।
যুগান্তর : দল সংগঠিত করার পাশাপাশি জোট সম্প্রসারণে এবার আওয়ামী লীগের কৌশল কী? আওয়ামী লীগ ১৪ দলীয় জোটের নেতৃত্বে আছে। যেখানে বামপন্থী দলের প্রাধান্য। আবার বিপরীত মেরুর হেফাজতে ইসলামের সঙ্গেও সম্পর্ক তৈরি হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের। তাদের নানা দাবি মানা হয়েছে। নির্বাচন এগিয়ে এলে কি ইসলামী দলের দিকে আপনাদের ঝোঁক আরও বাড়বে?
ওবায়দুল কাদের : জোটের বিষয়টি কৌশলগত। আমি একটা বিষয় অত্যন্ত পরিষ্কার করতে বলতে চাই, যারা নানা সন্দেহ করছেন, তাদের জন্য স্পষ্ট করে বলতে চাই, সময়ের প্রয়োজনে আওয়ামী লীগের কৌশলগত পরিবর্তন হতে পারে; কিন্তু আওয়ামী লীগ তার শেকড় থেকে কখনও একবিন্দুও সরে যাবে না। আমরা আমাদের শেকড়ের বন্ধনে আবদ্ধ, এখান থেকে আমাদের সরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কৌশলগত পরিবর্তন আসবে। আমরা, জাতীয় পার্টি বা ১৪ দলের শরিকরা বা আমাদের সঙ্গে তরিকত ফেডারেশন আছে। এটাও তো ইসলামী দল। গতবার তারা আমাদের জোটে ছিল। এরকম আরও অনেকেই আসতে পারে। তাই বলতে চাই, নির্বাচনী যে জোট সেটা ভিন্ন জিনিস। জোটের একটা বড় প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব জনমনে থাকে। এখন বিএনপিও তো একটা বড় অ্যালায়েন্সের নেতৃত্বে আছে। এরশাদ সাহেবও একটা বড় জোটের কথা বলেছেন। এক্ষেত্রে একেকটি রাজনৈতিক দলের একেক হিসাব।
যুগান্তর : জাতীয় পার্টি মহাজোটের শরিক ছিল। আবার আপনাদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করছে। এরই মধ্যে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে তারা আলাদা জোট গঠন করেছে। তাহলে সমীকরণটা কী? বিএনপি নির্বাচনে এলেও কি জাতীয় পার্টি মহাজোটে না এসে আলাদাভাবে নির্বাচন করবে?
ওবায়দুল কাদের : জাতীয় পার্টি শেষ পর্যন্ত কোথায় থাকে সেটা হল বড় কথা। আলাদা আলাদা জোট অনেকেই করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কে কোন জোটে নির্বাচন করবেন সেটা বোধহয় বলার বাস্তব সময় এখনও আসেনি।
যুগান্তর : জোট সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে কী কৌশল বা নীতি হবে আওয়ামী লীগের? এখন দেখা যাচ্ছে বাম-ডান-চরম ডান সবাইকে একই ছাতার নিচে আনার প্রক্রিয়া চলছে।
ওবায়দুল কাদের : নির্বাচনী জোটের ক্ষেত্রে দুটি জায়গায় আমরা স্থির থাকব- সেটা হল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। যারাই আমাদের জোটে আসুক এদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধু- এ দুটি মৌলিক জায়গায় এক থাকতে হবে। এসব বিষয়ে আমাদের সম মনস্কতার একটা ব্যাপার আছে।
যুগান্তর : রাজনীতির এখন মূল আলোচনা- নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে? বিএনপি সহায়ক সরকারের কথা বলছে। আপনারা কী ভাবছেন? ফর্মুলা কী হবে?
ওবায়দুল কাদের : কোনো ফর্মুলা নেই। ফর্মুলা আমাদের সংবিধান। সংবিধানের ১১৮ ও ১১৯ ধারা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। সে অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন পরিচালিত হবে, অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনকালীন সরকার অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে হয়, বাংলাদেশেও ঠিক সেভাবে হবে। আমরা এখানে ভিন্নতর কিছু কেন আশা করছি? যে নির্বাচন কমিশনের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে, সেই নির্বাচন কমিশনকে আমরা গ্রহণ করেছি। বিএনপি গ্রহণ করেছে। তাই নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন নেই। কোনো কথাও হচ্ছে না। এর মানে বিএনপি একে মেনে নিয়েছে। যদি মেনে নেয়, তাহলে আগামী নির্বাচন এ কমিশনের অধীনেই যৌক্তিক। তখন যে সরকার থাকবে সেই সরকার একটা রুটিনমাফিক দায়িত্ব পালনের জন্য থাকবে। সেই সরকার নির্বাচনসংশ্লিষ্ট যে সংস্থা-প্রতিষ্ঠান আছে, এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করবে। ক্ষমতাসীন সরকারের সহায়তা করা ছাড়া অন্য কোনো দায়িত্ব থাকবে না। কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না, শুধু রুটিন ওয়ার্ক করবে। নির্বাচনের জন্য যা যা দরকার সেগুলো নির্বাচন কমিশনের অধীনে ন্যস্ত থাকবে। যেমন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজ তখন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার- সেটা তখন নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকবে। সেনাবাহিনীর যে দায়িত্ব, সেটা নির্বাচন কমিশনই ঠিক করবে। তাই সে সময় যে সরকার থাকবে সেই সরকারের নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো ভূমিকা থাকবে না। তাহলে বিএনপির এখানে ভয় কীসের। আমি বুঝি না তারা কেন ভয় পাচ্ছে? তাদের আমলে তারা কীভাবে নির্বাচন করতে চেয়েছে সেটা আমরা জানি। আজিজ মার্কা কমিশন সে সময় আমরা দেখেছি। ১ কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটারের ইতিহাস এদেশে আছে, সেটা অন্তত আমাদের সময়ে হবে না।
যুগান্তর : বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য ২০১৪ সালে মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেটা সংবিধানের অধীনেই ছিল। এবারও কি বিএনপিকে মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব দেয়া হবে? নির্বাচনকালীন মন্ত্রিপরিষদ কি ছোট হবে?
ওবায়দুল কাদের : অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সাধারণত ছোট হয়। তাই বলা যায় তখন মন্ত্রিপরিষদ ছোট হয়ে যাবে- বড় রাখার দরকার তো নেই। আরেকটি বিষয় যেটি বলছেন, নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপির অংশগ্রহণ থাকবে কিনা? আমি বলতে চাই, প্রধানমন্ত্রী সেই প্রস্তাব দেবেন কিনা এখনও সে প্রয়োজন আমরা অনুভব করছি না। কারণ বিএনপিকে গতবার ডেকে আমরা পজিটিভ কোনো সাড়া পাইনি। শুধু গালিগালাজ পেয়েছি। খালেদা জিয়া প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত টেলিফোনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নোংরা ভাষায় কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীকে ভালোভাবে সম্বোধনও তিনি করেননি। এখনও তার মুখে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে সম্মানজনক কথা শোনা যায় না। এভাবে রাজনীতিতে কী সমঝোতা হতে পারে? আপনার ছেলে মারা গেছে, আমি আপনার বাড়ির দরজায় গেলাম, সেখানে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন- এটা যাদের মানসিকতা, তাদের সঙ্গে সমঝোতা কী করে হয়?
যুগান্তর : তবে বিএনপির সেই মানসিকতার কি কিছুটা পরিবর্তন হয়নি? তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির কারণে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যায়নি। কিন্তু এখন তারা সহায়ক সরকারের কথা বলছে- ছাড় দিচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকেও এমন কোনো ছাড় দেয়া হবে কিনা?
ওবায়দুল কাদের : ছাড় দিচ্ছে কারণ তারা এখন নোহায়্যার হয়ে গেছে। তারা কোথাও নেই। তাই এখন নানান কথা বলছে। তাদের নেতারা একেক দিন একেক কথা বলে। এক নেতা বলে, যত বাধা আসুক, নির্যাতন আসুক, বিএনপি নির্বাচনে যাবেই। আবার আরেক নেতা খালেদা জিয়ার নির্দেশের কথা বলে হুমকি দেয়, সহায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। তাদের কথা যদি ধরি, তাহলে সহায়ক সরকার তো থাকছে। সরকারের হাতে তো কিছু থাকবে না, নামমাত্র দায়িত্ব পালন করবে।
যুগান্তর : কিন্তু বিএনপি বলছে, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা অসীম। তাই বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়।
ওবায়দুল কাদের : নির্বাচনের সময় প্রধানমন্ত্রীর কোনো ক্ষমতা থাকবে না। প্রধানমন্ত্রী তখন ইচ্ছে করলেও মেট্রোরেল উদ্বোধন করতে পারবেন না। নির্বাচনকালীন মেট্রোরেলের মতো প্রকল্পের কাজ যদি শেষও হয়ে যায়, প্রধানমন্ত্রীর তখন তা উদ্বোধন করার সুযোগ নেই। রুটিন ওয়ার্ক করা ছাড়া তার কিছুই করার থাকবে না। কোনো নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী নিতে পারবেন না।
যুগান্তর : এরপরও তারা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার কথা বলছে। সহায়ক সরকারের কথা বলছে।
ওবায়দুল কাদের : আমরা নির্বাচনের আগে সংবিধান পরিবর্তনের চিন্তাভাবনা করছি না। কারণ বারবার এসব আশকারা দিলে দেশের শৃঙ্খলা, স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিনি। তিনি কারচুপি, ষড়যন্ত্র, জালিয়াতি করে ক্ষমতায় আসবেন- এরকম মনমানসিকতা তার নেই। এটা তাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি বলেই বলছি, শেখ হাসিনা এ কাজ করবেন না। বিএনপি এটা ভাবলে ভুল করবে। যদি এবারকার নির্বাচনটা শেখ হাসিনার অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু হয় তাহলে ভবিষ্যতে তারাও লাভবান হবে। তা না হলে তারা ক্ষমতায় এলেও বিপদে পড়বে। আমি বলি, শেখ হাসিনার অধীনে আগামী নির্বাচন একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হবে। আমি শতভাগ বিশ্বাস করি, আমাদের প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় জনগণের রায়ের ওপর কোনো হস্তক্ষেপ করবেন না। বিএনপি অহেতুক ভয় পাচ্ছে। আমার মনে হয়, এই নির্বাচনটা তারা করুক। তারা দেখুক। তারা তো এখন কোথাও নেই। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক, দেশবাসী সাক্ষী আছে। সারা দুনিয়া থেকে পর্যবেক্ষক আসবে। তারা দেখবে। সরকারের সাংবিধানিকভাবে হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার নেই। অহেতুক হস্তক্ষেপ করে একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে দেশের ইমেজ নষ্ট করা- এ কাজটা আমাদের দ্বারা হবে না।
যুগান্তর : একটা অভিযোগ করা হচ্ছে- খালেদা জিয়াকে শাস্তি দেয়ার মাধ্যমে বিএনপিকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে সরকার। যাতে আগামী নির্বাচনে তারা পুরো শক্তি নিয়ে অংশ না নিতে পারে।
ওবায়দুল কাদের : ষোড়শ সংশোধনী যখন বাতিল হল তখন আপনি স্বাগত জানাচ্ছেন। বলছেন, বিচার বিভাগ স্বাধীন। তাহলে স্বাধীন বিচারব্যবস্থায় আপনার যদি শাস্তি হয়, সেটা কেন আপনি মেনে নেবেন না? বিচার বিভাগ স্বাধীন আপনি বলছেন, তাহলে বিচার বিভাগ কি কেস টু কেস স্বাধীন? তাই মামলায় যদি আপনার বিরুদ্ধে রায় হয় তখনও তাহলে বিচার বিভাগ স্বাধীন- আমি সেটাই বলতে চাই।
যুগান্তর : নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি ভাঙার গুজবও আছে। বলা হচ্ছে, সরকার বিএনপির একটি অংশ নিয়ে নির্বাচন করতে চায়।
ওবায়দুল কাদের : বিএনপি ভাঙলে তারা নিজেরাই নিজেদের দল ভাঙবে। বিএনপির প্রতিপক্ষ তারা নিজেরাই। যাদের আপন ঘরে শত্রু তাদের শত্রুতা করার জন্য বাইরের শত্রুর কোনো দরকার নেই। এটি জিয়াউর রহমান সাহেবের দল। এখানে খালেদা জিয়া, তারেক রহমান তারাই তো ডমিনেট করে। এখানে ভাঙাভাঙির যদি কোনো প্রশ্ন আসে সেটা তাদের দলের নিজেদের দ্বন্দ্বের জন্য হতে পারে। দলের সিনিয়র নেতাদের মাঝে এমনও সম্পর্ক যে, কেউ কারও মুখের দিকে তাকাতে পারে না। তারা নিজেরাই নিজেদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেয়, নিজেরা নিজেদের সম্পর্কে নানান কথা বলে। এমনকি একজন আরেকজনকে সরকারের এজেন্টও বলে। এ সমস্যাটা আওয়ামী লীগে নেই। বিরোধী দলে থাকতেও ছিল না, এখনও নেই। তাদের এ সংকট রয়ে গেছে। তাদের দল যদি ভাঙে, তাহলে তা নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্বের জন্য ভাঙবে। আওয়ামী লীগের কোনো প্রয়োজন নেই বিএনপিকে ভাঙার।
যুগান্তর : বিএনপিকে নির্বাচনে আনার কোনো বাড়তি উদ্যোগ বা কৌশল কি থাকবে সরকারের?
ওবায়দুল কাদের : বিএনপি নির্বাচনে আসবে এটা আমরা চাই। বিএনপির মতো বড় দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে সে বিজয়েরও একটা দাম আছে। কাজেই আমরা চাই বিএনপি আসুক। আমরা ফাঁকা মাঠে গোল দিতে চাই না। তবে বিএনপি নির্বাচনে আসবে কিনা এটা তাদের সিদ্ধান্তের বিষয়। এজন্য বিএনপিকে কি আমরা করুণা বিতরণ করব? তাদের হাত-পা ধরে নির্বাচনে আনব? নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। এটা সুযোগ নয়।
যুগান্তর : বিএনপি না এলেও কি ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন আবার হওয়ার সম্ভাবনা আছে?
ওবায়দুল কাদের : সরকার চায় বিএনপি নির্বাচনে আসুক।
যুগান্তর : নির্বাচনের আগে বা এ বছরই মন্ত্রিপরিষদে কোনো পরিবর্তন আসছে কি?
ওবায়দুল কাদের : হয়তো একটা পরিবর্তন হবে। কিন্তু কখন হবে এটা তো প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার। তাই কবে হবে এটা নিয়ে অন্ধকারে ঢিল ছোড়া ঠিক হবে না। যখন হবে সবাই দেখতে পাবে, আকাশে চাঁদ উঠলে সবাই দেখতে পাবে। এসব ব্যাপারে যখনই আমি অনুমান বা ধারণার কথা বলব তখনই মন্ত্রীপাড়ায় ঘুম থাকবে না। অযথা কেন বিপদে ফেলছেন। টেনশনটা অহেতুক না। সামনে আবার আরেকটা ঈদ। আছি কী নেই এ চিন্তাটা তো ভালো নয়। যারা মোর দ্যান শিওর তাদের ব্যাপার আলাদা। কিন্তু পরিবর্তনের আগে কথা বললে যারা হতে চায় তারাও টেনশনে থাকবে আর যারা আছে তাদের তো বাদ পড়ার টেনশন থাকবেই। কাজেই অহেতুক টেনশনে কাউকে ফেলতে চাই না।
যুগান্তর : ধন্যবাদ আপনাকে।