ইসির প্রতি নির্বাচন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ আস্থা অর্জনের এখনই সময় ৯০ দিনের ঘেরাটোপে বন্দি থাকতে চায় ইসি * সংলাপের বিষয়ও আইনে নেই * নিবন্ধিত দলের সভায় বাধা চলবে না * প্রয়োজনে কমিশন উচ্চ আদালতের নির্দেশনা নিতে পারে

 ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট:
সাধারণত পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত প্রচলিত বাক্য হচ্ছে, ‘সকালের সূর্য বলে দেয় দিনটি কেমন যাবে।’ সূর্য যেমন সারাদিনের আগাম বার্তা দেয়, তেমনি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদাও রোববার একটি বার্তা দিয়েছেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংক্রান্ত বার্তা। তার এ বার্তা জনগণকে শঙ্কিত করে তুলেছে। সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে অবাধ নির্বাচনের আশায় মানুষ যে প্রহর গুনছেন তা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ এখনও তফসিল ঘোষণা হয়নি। অথচ সরকারি দল আওয়ামী লীগ অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন স্থানে সভা সমাবেশ করে ভোট চাচ্ছেন। অন্যদিকে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি ভোট চাওয়া দূরের কথা, সভা-সমাবেশ করার অনুমতিই পাচ্ছে না। রাজনৈতিক দলগুলো একসঙ্গে বসতে চাইলে পুলিশ বাধা দিচ্ছে। এসব রোধে নির্বাচন কমিশন (ইসি) কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না। সব দলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করাই সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত। কিন্তু প্রধান নির্বাচন কমিশনার তার এখতিয়ারের প্রশ্ন তুলে বাস্তব অবস্থা আড়ালের চেষ্টা করছেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, এসব রোধে তফসিল ঘোষণার আগে তারা কিছুই করতে পারবেন না। প্রশ্ন উঠেছে, কমিশন কবে পরিবেশ নিশ্চিত করবে। তফসিল ঘোষণার আগে যদি তাদের কিছু করার না থাকে, তবে তো দুই-তিন মাসের জন্য নির্বাচন কমিশন গঠন করলেই হয়। ২-৩ মাসের জন্য গঠিত কমিশন নির্বাচনের তফসিল দেয়ার আগে নির্বাচন নিয়ে কোনো দল বা অন্য কেউ কোনো কথা বলবেন না। কোনো তৎপরতা চালাবেন না। ইসি তো সেভাবে চলছে না। তারা দেড় বছর আগে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করছে। তফসিল ঘোষণার আগে কেন রোডম্যাপ দিচ্ছেন। আসলে তারা অনেক কিছুই করছেন। শুধু মাঠের বিরোধী দলগুলোর সভা-সমাবেশে পুলিশি বাধা বন্ধ করতে পারবেন না বলে বার্তা দিয়েছেন। এসব কারণেই মূলত জনগণ সিইসির বার্তায় ভয় পাচ্ছে। তাদের শঙ্কা তবে কি ফের ৫ জানুয়ারির স্টাইলে নির্বাচন হবে। দেশের শীর্ষ রাজনীতিবিদ, সংবিধান বিশেষজ্ঞ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা যুগান্তরকে এসব কথা বলেন।
সংবিধান ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে তবে নির্বাচন কমিশনের কাজ কি তফসিল ঘোষণার দিন থেকে ভোট গ্রহণ এবং ফল ঘোষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ। তফসিল ঘোষণার দিন থেকে ভোট পর্যন্ত সব দলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করবে ইসি। সে ক্ষেত্রে কি সরকারি দল এখন থেকে তফসিল ঘোষণা পর্যন্ত সভা-সমাবেশে ভোট চাওয়া বন্ধ রাখবে। তফসিল ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ বিএনপিসহ নিবন্ধিত দলগুলো একসঙ্গে নির্বাচনী প্রচারে নামবে। তাদের মতে, প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে এটা সম্ভব নয়। অতীতে কোনো নির্বাচনে তফসিল ঘোষণার পর দলগুলো প্রচারে নামেনি। দলগুলো মেয়াদ শেষ হওয়ার দেড়-দু’বছর আগে থেকে নির্বাচনী প্রচার শুরু করে। এবারও সরকারি দল সেই কাজই করছে। শুধু বাধা দেয়া হচ্ছে বিএনপিসহ অন্যান্য দলকে। নির্বাচন কমিশনকেই এটা বন্ধ করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট শাখাগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। প্রয়োজনে আইনগত পরামর্শ নিতে হবে। নির্বাচনের মাঠ সবার জন্য সমান করতে হলে এসব উদ্যোগ নেয়া জরুরি। তবেই মানুষ বিশ্বাস করবে নির্বাচন কমিশন সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে। ইসি সবার জন্য চেষ্টা করছে। তাদের পক্ষে ভালো একটি নির্বাচন উপহার দেয়া সম্ভব। জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য এসব পদক্ষেপ এখনই নিতে হবে। কাজগুলো শুরু করার এখনই সময় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক সোমবার যুগান্তরকে বলেন, ‘সিইসির কথায় মনে হয়েছে তারা ৯০ দিনের ঘেরাটোপে বন্দি থাকতে চাইছেন। এর মধ্য দিয়ে আসলে তারা সুকৌশলে নিজেদের ওপর অর্পিত দায়-দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চান।’ তিনি আরও বলেন, ‘সকাল দেখে যেমন দিনটি কেমন যাবে বোঝা যায়, তেমনি সব দলের অংশগ্রহণভিত্তিক নির্বাচন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি, রাজনৈতিক দলগুলোর সভা-সমাবেশ করার অধিকার, প্রভাবমুক্ত নির্বাচন, নির্বাচনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি প্রভৃতি ইস্যুতে ইসির মনোভাবও কিছুটা আঁচ করা যাচ্ছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে এখন থেকেই ইসিকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে বলে তিনি মনে করেন। ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা আছে, নির্বাহী বিভাগ নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করবে। এই সহায়তা শুধু তফসিল ঘোষণার পরপরই করতে হবে, তা বলা নেই। তফসিল ঘোষণার আগেই নির্বাচন কমিশন অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বাধাগুলো সরকারের কাছে তুলে ধরতে পারে। এসব বাধা-বিপত্তি দূর করতে সরকারের সহায়তা চাইতে পারে নির্বাচন কমিশন।’ তিনি আরও বলেন, ‘রোডম্যাপ ঘোষণা করে সিইসি বলেছেন, তফসিল ঘোষণার আগে তাদের কিছু করার নেই। এ অবস্থায় প্রশ্ন হচ্ছে- সত্যিই কি তাদের কিছু করার নেই? তফসিল ঘোষণার আগে নির্বাচন কমিশনের যদি কিছু করার না থাকে, তাহলে তো দু-তিন মাসের জন্য নির্বাচন কমিশন গঠন করলেই হতো। ওই তফসিলের আগে নির্বাচন নিয়ে কেউ কোনো কথা বলবেন না। কোনো তৎপরতা চালাবেন না।’

অবাধ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির জন্য ইসিকে এখন থেকেই কাজ শুরু করতে হবে। অন্যথায় ইসি বিতর্কে জড়িয়ে পড়বেন। এর সঙ্গে যোগ হবে অনেক প্রসঙ্গ। যেমন- সিইসি শপথ নেয়ার পর ছড়িয়ে পড়েছিল তিনি ‘জনতার মঞ্চের লোক’। মাঠের বিরোধী দলগুলোকে এখন থেকেই সমান সুযোগ দিতে না পারলে সিইসির বিরুদ্ধে পুরনো অভিযোগ প্রতিষ্ঠা পাবে। তিনি যে জনতার মঞ্চের লোক, সরকারের লোক, তা প্রতিষ্ঠিত হবে। মানুষ বলার সুযোগ পাবে যে, এ জন্যই ইসি মাঠে বিরোধী দলগুলোকে সুযোগ দিচ্ছেন না। এ ইসির অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, সবকিছুই আইনে লেখা থাকে না। আইনের বাইরেও অনেক বৈধ বিষয় আছে। অধিকাংশ সময় আমরা যা মেনে চলি। বিরোধী দলগুলোর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য সিইসির এখতিয়ার বা আইনের অজুহাতের প্রয়োজন নেই। প্রথা, ঐতিহ্য, বাস্তব অবস্থা ইত্যাদি বিবেচনায় নিলেই অনেক কিছু সহজে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। ইসি বিরোধী দলগুলোর জন্য সেই সহজ রাস্তা অনুসরণ করলেই সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব বলে তারা মনে করেন।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খান এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, ‘সিইসি ঘোষিত রোডম্যাপই বলে দিচ্ছে, আগামী দেড় বছর ধরেই কমিশন নির্বাচন সংক্রান্ত কাজগুলো করে যাবে। এর মধ্যে সীমানা নির্ধারণ, ভোটার তালিকা হালনাগাদ ও সংলাপ অন্যতম। এসব কাজ যদি ইসি দীর্ঘ সময় নিয়ে করতে পারে তাহলে আগেভাগেই নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে তারা কেন কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন যে রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের সংলাপ ইত্যাদি করার উদ্যোগ নিয়েছে, তাও তো নির্বাচনী আইনে লেখা নেই। নির্বাচনী আইনে আছে, নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করবে এবং নির্বাচন পরিচালনা করবে। নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করতে তারা যদি রাজনৈতিক দলগুলোর জবাবদিহিতা আদায় করতে পারে, তবে নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করার জন্য সরকারকে কেন বলতে পারবে না।’

এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, ‘কেউ নির্বিঘ্নে নির্বাচনী প্রচারণা চালাবে। আর কেউ ভয়ে ঘরে বসে থাকবে। তাহলে কিভাবে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে?’ তিনি বলেন, সিইসি বলছেন, ‘এ মুহূর্তে সরকার কীভাবে পরিচালিত হবে ও রাজনৈতিক কর্মপরিবেশের বিষয়গুলো তাদের এখতিয়ার নয়। সরকারের কর্মকাণ্ডে এখনই কমিশন হস্তক্ষেপ করবে না। তার (সিইসি) এই বক্তব্য সঠিক নয়। সরকারি দল সারা বছর সরকারি টাকায় সভা-সমাবেশ করবে আর বিরোধী দলগুলো ভোটের আগে এক মাস সময় পাবে, তা হলে তো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হল না। সব রাজনৈতিক দলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হলে এখন থেকে দেশের সব রাজনৈতিক দলকে সভা-সমাবেশ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে ইসিকে। এ জন্য প্রয়োজনে নির্বাচন কমিশন উচ্চ আদালতেরও নিদের্শনা নিতে পারে।’

নির্বাচন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমদ বলেন, ‘নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টিসহ সব রাজনৈতিক দলের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। কারণ রাজনৈতিক দলগুলো কমিশনে নিবন্ধিত। সেই রাজনৈতিক দলগুলোকে সরকার সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছে না, তার জন্য কমিশন উচ্চ আদালতের নিদের্শনা নিতে পারে। তা না করতে পারলে শুধু রোডম্যাপ ঘোষণা দিয়ে কিছুই হবে না।’

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে কমিশনের স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের বিধান রয়েছে। সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনকে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে স্বচ্ছতা, দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিতা প্রদর্শন করা আরও বেশি জরুরি। সেখানে রাজনৈতিক দলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। এটা করতে না পারলে দেশের জন্য

যুগান্তর

Check Also

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হচ্ছেন খবরে আসামিপক্ষে শুনানি করেননি সমাজী

জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার সাবেক ৯ মন্ত্রীসহ ১৩ জনকে আন্তর্জাতিক …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।