আদালতের কার্যক্রম নিয়ে সংসদসহ কারো মন্তব্যের সুযোগ নেই: প্রধান বিচারপতি/আমরা কি কথা বলতে পারব না?

বিচারপতি অপসারণ সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাসহ আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতির স্বাক্ষরের পর ৭৯৯ পৃষ্ঠার এ রায় প্রকাশ করা হয়।

মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টায় সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্টার (প্রশাসন ও বিচার) মো. সাব্বির ফয়েজ  বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

তিনি বলেন, কিছুক্ষণের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ রায়টি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে দেয়া হবে।

আদালতের প্রক্রিয়া নিয়ে জাতীয় সংসদ সহ কারো প্রকাশ্যে বিতর্ক করার কোনো সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা।
মঙ্গলবার সকাল পৌনে ১০ টার দিকে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের সময় তিনি এ মন্তব্য করেন।

এর আগে গত ৩ জুলাই হাইকোর্টের দেয়া রায়ের কিছু পর্যবেক্ষণ এক্সপাঞ্জ (বাদ দিয়ে) করে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল ‘সর্বসম্মতভাবে’ খারিজ করে বিচারপতি অপসারণ সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।

প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা নেতৃত্বাধীন সাত বিচারকের আপিল বিভাগ এ রায় দেন।

বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার।

২০১৪ সালে সংসদে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হলে তা রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা সৃষ্টি করে। এর মধ্যে আসাদুজ্জামান সিদ্দিকীসহ সুপ্রিমকোর্টের ৯ জন আইনজীবী একটি রিট আবেদন করেন হাইকোর্টে।

২০১৬ সালে হাইকোর্টের তিন বিচারপতির বেঞ্চের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে দেয়া রায়ে সংবিধানের এই সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করা হয়। হাইকোর্টের এই রায় রাজনৈতিক অঙ্গনেও উত্তাপ ছড়িয়েছিল। সংসদে ওয়াকআউটের ঘটনা ঘটে।

অন্যদিকে সংসদের বাইরে থেকে বিএনপি হাইকোর্টের রায়ের পক্ষে অবস্থান জানায়। হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলে ৮ মে আপিল বিভাগের ‘ফুলবেঞ্চে’ শুনানি শুরু হয়। সব মিলিয়ে ১১ দিন রাষ্ট্র ও রিট আবেদনকারীর বক্তব্য শোনেন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাসহ সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকরা। পাশাপাশি অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে সুপ্রিমকোর্টের ১০ জন আইনজীবীর বক্তব্যও শোনেন আপিল বিভাগ।

গুরুত্বপূর্ণ মামলাটির শুনানিতে আপিল বিভাগ আদালত বন্ধু হিসেবে যে ১০ জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর বক্তব্য শোনেন, তার মধ্যে কামাল হোসেনসহ নয়জনই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের পক্ষে অর্থাৎ ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে মত দেন। সংবিধানের এই সংশোধনের পক্ষে অবস্থান জানান শুধু আজমালুল হোসেন কিউসি। কামাল হোসেনের সঙ্গে একই মত পোষণকারীরা হলেন টিএইচ খান, এম আমীর-উল ইসলাম, রোকন উদ্দিন মাহমুদ, এএফএম হাসান আরিফ, ফিদা এম কামাল, এজে মোহাম্মদ আলী, এমআই ফারুকী ও আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া।

আদালত মোট ১২ জন আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ব্যারিস্টার রফিক উল হক ও ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ মতামত দেননি। তাদের বাইরে ‘ইন্টারভেনার’ হিসেবে সংবিধানের এই সংশোধনের পক্ষে যুক্তি দেখান সাবেক আইনমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য আবদুল মতিন খসরু।

২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়, যাতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা ফিরে পায় সংসদ। বিলটি পাসের পর ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ নভেম্বর হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন ৯ আইনজীবী। প্রাথমিক শুনানির পর হাইকোর্ট ২০১৪ সালের ৯ নভেম্বর রুল দেয়। রুলে ওই সংশোধনী কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়। ২০১৬ বছরের ৫ মে হাইকোর্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয় ওই বছরের ১১ আগস্ট। তিন বিচারকের ওই বেঞ্চের বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দেন। অন্য বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল তাতে ভিন্নমত জানিয়ে আলাদা রায় দেন।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে উদ্দেশ্য করে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, ‘এজলাসে বসে কথা বলার বিষয়ে কিছু মন্ত্রী বিচারপতিদের সমালোচনা করছেন। এটা কি ফেয়ার?’

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা সংক্রান্ত আপিলের শুনানিতে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তাকে এ কথা বলেন প্রধান বিচারপতি।

অ্যাটর্নি জেনারেলকে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনারা প্রধান বিচারপতি ও কোর্টের স্বাধীনতা খর্ব করতে করতে এমন জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন, আমরা কি কিছুই বলতে পারব না? আমরা কি কোর্টে বসে মন্তব্য করতে পারব না?’

তিনি বলেন, ‘আপনারা জাজদের মধ্যে ডিভিশন সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন। আমরা কি কোর্টে বসে মন্তব্য করতে পারব না? কিছু কিছু মন্ত্রী এজলাসে বসে কথা বলার বিষয়ে মন্তব্য করেন। এটা কি ফেয়ার? আপনাকে প্রশ্ন করছি।’

প্রধান বিচারপতির প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘দুদিক থেকে বক্তব্য আসে। বক্তব্য মিডিয়া লুফে নেয়।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনি কেন এ কথা বলছেন? বিচারে আমরা পলিটিক্যাল মন্তব্য দেই না। বিচার বিভাগ সংক্রান্ত বক্তব্য দেই। বিচার বিভাগে যখন যে ইস্যু চলে আসে। যেমন আজকে মোবাইল কোর্ট সম্পর্কে। না বললে কি থাকল, মাসদার হোসেন মামলা। আমরা পলিটিক্যাল কথা বলছি না।’

এ সময় বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহাব মিঞা বলেন, ‘শৃঙ্খলাবিধির খসড়ার গেজেট প্রকাশের বিষয়টি আমরা সুপ্রিম কোর্টের কথা অনুসারে বলেছিলাম। কিন্তু আপনারা সেখানে সরকারের কথা বলেছেন।’

তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘পলিটিক্যাল কথা বলছি না। মি. অ্যাটর্নি জেনারেল, আপনারা জাজদের মধ্যে ডিভিশন সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন। পত্রিকায় এসেছে একজন, একজন বলেছেন। কোর্ট প্রসিডিংসে আদালতের কার্যক্রমে যা হয় তা নিয়ে পার্লামেন্ট এবং পাবলিকলি কথা বলার সুযোগ নেই।’

প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, ‘মাসদার হোসেন মামলায় ১১৬ অনুচ্ছেদ এবং ১১৬ অনুচ্ছেদের (ক) এর ব্যাখ্যা দিয়ে রায় হয়েছে। এখন যদি আপনাদের কাছ থেকে ব্যাখ্যা শুনতে হয় তাহলে দুঃখজনক।’

পরে শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের ছয় সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া স্থগিত আদেশের মেয়াদ আরও দুই সপ্তাহের জন্য বৃদ্ধির আদেশ দেন।

ফলে এ সময় পর্যন্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় আইনি কোনো বাধা নেই বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।

Check Also

ট্রাইব্যুনালে আ.লীগ নেতাদের বিচার দেখতে এসে যা বললেন সাঈদী পুত্র

জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া সাবেক ৯ মন্ত্রীসহ ১৩ জনকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।