সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া মামলার রায়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, বিচারকরা কারও দাস নয় এবং কেউই তাদের মনিব নয়।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে তিনি লিখেছেন, বিচার বিভাগের জবাবদিহিতা আইন, সংবিধান ও জনগণের কাছে। বিচারিক সিদ্ধান্তের জন্য কোনো বিচারপতিকে দায়ী করা যায় না। এ ধরনের জবাবদিহিতার প্রশ্নই ওঠে না।
এ মামলার রায়ে বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী লিখেছেন, বিচারপতিরা সর্বশক্তিমান আল্লাহ, দেশের আইন, নিজের বিবেক ও জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। মঙ্গলবার ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশিত হয়।
সুপ্রিমকোর্টে এ মামলার শুনানিকালে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের একটি অঙ্গ। এ কারণে বিচারপতিরা নিজেরাই নিজেদের বিচার করবেন, তা ন্যায়সঙ্গত নয়। এটা আইনের শাসনের পরিপন্থী।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, বিচারপতিদের জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে জবাবদিহিতা থাকা উচিত। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ভারতের জনগণ তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে বিচারপতিদের জবাবদিহিতায় কোনো বাধা দেয়নি। বিচারপতিরাও গর্ববোধ করেন যে, তারা আর কারও কাছে নয়, জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে জবাবদিহি করেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেছেন, কোনো বিচারক (পটেনশিয়াল ক্যান্ডিডেট) যদি মনে করেন, তিনি জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে জবাবদিহিতার তুলনায় যথেষ্ট বড়, তবে তিনি বিচার বিভাগে স্বাগত নয়। তার সরে যাওয়াই উচিত।
আজমালুল হোসেন বলেছেন, বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা যদি বিচার বিভাগের হাতে দেয়া হয় তবে বিচার বিভাগের ওপর জনগণের আস্থায় চিড় ধরবে।
এ মন্তব্যের জবাবে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা লিখেছেন, এখন প্রশ্ন উঠেছে ক্ষমতা চর্চার নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকা উচিত। লর্ড ড্যানিং বলেছেন, ‘কাউকে না কাউকে তো বিশ্বাস করতেই হবে, সেটা বিচারপতি হলেই ভালো।’
প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, ‘অ্যাটর্নি জেনারেল বিচারকদের সম্পর্কে নির্দয় মন্তব্য করেছেন। আমি বলব, তিনি ভুল বলেছেন। আমি তাকে উপদেশ দেব যে, তিনি যেন তার মক্কেলকে (এ ক্ষেত্রে সরকার) বলেন যে, সরকারের ধারণা যদি এই হয় যে, বিচারপতিরা স্বাধীন ও স্বচ্ছ নন, তাহলে দেশে কারও ওপরই আস্থা রাখা ঠিক হবে না। উপরন্তু, আমরা যদি এই যুক্তি গ্রহণ করি তবে এ বিষয়ে বিশ্বের বেশিরভাগ সংবিধানই এই ভুল পদ্ধতি গ্রহণ করত।’
বিচারপতি সিনহা লিখেছেন, অনুচ্ছেদ ৯৪-এর ৪ ধারায় বলা হয়েছে, বিচার পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতি ও অন্য বিচারপতিরা স্বাধীন থাকবেন। ১১৬(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বিচার বিভাগে নিয়োজিত সব ব্যক্তি এবং বিচার পরিচালনাকালে সব ম্যাজিস্ট্রেট স্বাধীনতা ভোগ করবেন। এই প্রেক্ষাপটেই বিচারপতি ও বিচার বিভাগের জবাবদিহিতার বিষয়টি দেখতে হবে। আদালতে যেসব মামলা বিচারাধীন আছে তার ৮০ ভাগই হয় রাষ্ট্রের (সরকার) বিরুদ্ধে অথবা বিচার বিভাগের কাছে সরকার ন্যায়বিচার চাচ্ছে।
প্রধান বিচারপতি মত দিয়েছেন, পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বিচারিক জবাবদিহিতা ও ব্যক্তিগতভাবে বিচারকের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। বিচারকরা ব্যক্তিগতভাবে কোনো অপরাধ করলে অন্য নাগরিকদের মতো তাদের জন্যও আইন সমান প্রযোজ্য। তবে বিচারিক সিদ্ধান্তের জন্য কোনো বিচারপতিকে দায়ী করা যায় না। এ ধরনের জবাবদিহিতার প্রশ্নই ওঠে না। আর জবাবদিহিতা থাকবে না বলে বিচারকরা কাজে অবহেলাও দেখাতে পারেন না।
প্রধান বিচারপতি ও অন্য বিচারকরা সাংবিধানিক কর্মকর্তা। তারা বেসামরিক কর্মকর্তাদের মতো নয়। তারা কারও দাস নয় এবং কেউই তাদের মনিব নয়। কারও সঙ্গে তাদের দাস-প্রভুসুলভ সম্পর্ক নেই, যেমনটা অন্যান্য সরকারি শাখায় থাকে। সংবিধান অনুযায়ী উচ্চতর আদালত নির্বাহী ও আইন বিভাগ থেকে একেবারেই পৃথক। তারা তাদের বিবেক ছাড়া কারও কাছে জবাবদিহি করবে না।
তবে প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, জবাবদিহিতা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিচারকরা বিদ্যমান আইন, প্রক্রিয়া ও রীতিনীতি অনুযায়ী বিচার করেন। তারা মর্জিমাফিক কাজ করতে পারেন না।
বিচার বিভাগের জবাবদিহিতা আইন, সংবিধান ও জনগণের কাছে। জনগণ ও গণমাধ্যম বিচারপতিদের সমালোচনা করে থাকে। এতেই বোঝা যায়, বিচারকের স্বাধীনতা চূড়ান্ত নয়, বরং কিছু সীমাবদ্ধতা তাদেরও রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের সবচেয়ে জবাবদিহি অঙ্গের একটি।
বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী লিখেছেন, একজন বিচারক সর্বশক্তিমান আল্লাহ, দেশের আইন, তার বিবেক, জনগণ, আপিল বিভাগ কর্তৃপক্ষ এবং রায় প্রকাশের ক্ষেত্রে মামলাকারীর কাছে জবাবদিহি করবেন। বিচারের যুক্তিই বিচারকের ব্যাখ্যা।
তিনি পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতের উদ্ধৃতি দেন যেখানে আল্লাহ বলেছেন : হে ইমানদাররা, ন্যায়বিচারের পক্ষে দৃঢ় থাক। কারণ আল্লাহ তা দেখছেন। যদি তা তোমাদের নিজেদের, তোমাদের বাবা-মায়ের অথবা তোমাদের আত্মীয়দের বিরুদ্ধেও যায়। হোক সে ধনী অথবা গরিব। আল্লাহ উভয়ের ক্ষেত্রে (তোমাদের চেয়ে) উত্তম সুরক্ষাদানকারী। কাজেই লোভের বশবর্তী হয়ে তোমরা যেন ন্যায়বিচার থেকে দূরে সরে না যাও। যদি তোমরা সাক্ষ্য বিকৃত কর অথবা তা দিতে অস্বীকার কর তবে নিশ্চয়ই জেনে রেখো তোমরা যা কর সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত (পবিত্র কোরআন : ৪ : ১৩৫)।
বিচারপতি ফয়েজ সিদ্দিকী লিখেছেন, বিচার বিভাগের জবাবদিহিতা এখন বহু দেশেই বহুল প্রচলিত বাণীর মতো। জনগণ প্রায়ই বিচারকদের যে সমালোচনা করে থাকেন তা হল- তারা সামাজিকভাবে জবাবদিহির মধ্যে আসেন না। তারা জনগণের প্রয়োজন ও স্বার্থ রক্ষায় সাড়া দেন না।
তিনি বলেন, জবাবদিহিতা মানে দায়বদ্ধতা। বিচারকের জবাবদিহিতা আর গণতন্ত্রে নির্বাহী বা আইন বিভাগ অথবা অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা একই রকম নয়। এর কারণ অন্যান্য সংস্থা থেকে যেমনটা করা হয় তা থেকে ভিন্নভাবে বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা আশা করা হয়।
রায়ে তিনি তিনটি বিভাগের কাজের ধরন ব্যাখ্যা দেন এভাবে- নির্বাহী বিভাগ স্টিয়ারিং হুইল নিয়ন্ত্রণ করে। দেশ কিভাবে চলবে সেই সিদ্ধান্ত নেয় এ বিভাগ। আইন বিভাগ জ্বালানি সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে। নির্বাহী বিভাগের প্রস্তাব অনুসারে অর্থ সরবরাহের নীতি প্রণয়ন করে এ বিভাগ। বিচার বিভাগের হাতে থাকে ব্রেকের নিয়ন্ত্রণ।
তিনি লিখেছেন, বিচারপতিরা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে অবশ্যই। কাজেই আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আইনের শাসনের মাধ্যমে বিচারিক একনায়কত্বের অবসান সম্ভব। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের একটি বিশ্বাসযোগ্য অঙ্গ। বিচারপতিদের সন্দেহের ঊর্ধে থাকতে হবে। একজন বিচারপতি হলেন ন্যায়বিচারের প্রতিভূ। কাজেই তার ব্যক্তিগত আচরণ নিয়ে সংশয় দেখা দিলে পুরো প্রতিষ্ঠানের ওপর তার কালো ছায়া পড়ে।
তিনি লিখেছেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা মানে জবাবদিহিতার বাইরে থাকা নয়। বিচার বিভাগের জবাবদিহিতা মূূলত সাধারণ জনগণের কাছে। বিচার বিভাগের দরকার জনগণের সমর্থন এবং এই সমর্থন অবশ্যই অর্জন করে নিতে হয়। এই সমর্থন আদায়ের উত্তম পন্থা হল এটা নিশ্চিত করা যে জনগণ যেন তাদের সিদ্ধান্ত বুঝতে পারে। বিচারিক আদালতের (বিচারপতি) জবাবদিহিতা আপিল বিভাগের কাছে এবং তারপর আপিল ব্যবস্থার মাধ্যমে সর্বোচ্চ আদালতে। জনগণের জন্য বিচার প্রক্রিয়া উন্মুক্ত রাখলে এবং বিচারিক সিদ্ধান্ত প্রকাশ করলে জনগণের কাছে জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়।
বিচারপতি ফয়েজ সিদ্দিকী লিখেছেন, কেউ কেউ মনে করেন বিচারপতিরা একই সঙ্গে স্বাধীন এবং চরমভাবে জবাবদিহির মধ্যে থাকতে পারেন না। এমনকি ব্যাখ্যামূলক জবাবদিহিতাও বিচারিক স্বাধীনতার জন্য মানানসই নয় বা বিপজ্জনক। লর্ড কুক বলেছেন, বিচারপতিদের জবাবদিহিতা হবে মূলত আত্মনিয়ন্ত্রণ। অন্যথায় বিচারপতিদের সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তা বিপন্ন হতে পারে।
মোহাম্মদ সি ওথম্যান তার ‘বৈধতা, জবাবদিহিতা এবং বিচার বিভাগের কার্যকারিতার জন্য বিচারিক স্বাধীনতা’ শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছেন, জবাবদিহিতার জন্য বিচারিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহজগম্য বা অবারিত, স্বচ্ছ, ব্যয়সাশ্রয়ী এবং কার্যকর রাখতে হবে। বিচার প্রক্রিয়া বোধগম্য, জনগণের জন্য উন্মুক্ত এবং সিদ্ধান্তসমূহ মুক্ত ও দ্রুত পাওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
তিনি লিখেছেন, জবাবদিহিতা মানে বিচারিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের কাজ, সিদ্ধান্ত, কার্যকারিতা এবং বিচারিক কর্মকর্তাদের আচরণ ও পারফরম্যান্সের জন্য দায়ী থাকতে হবে। জবাবদিহিতা থাকলে স্বচ্ছতা ও উন্মুক্ততাও সহজ হয়। এতে আইনের চোখে সবাই সমান তার গ্যারান্টি মেলে। গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতিষ্ঠানের ওপর জনগণের আস্থা বাড়ে, বিচার বিভাগ ও পুুলিশের মতো সংস্থার ওপর জনগণের আস্থার সংকট দূর হয়।
বিচারপতি ফয়েজ লিখেছেন, বিচারপতিরা উন্মুক্ত আদালতে বসেন। তাদের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা যায়। বিচার বিভাগ তাদের কাজের মূল্যায়ন করে। তারা সিদ্ধান্তের জন্য কারণ ব্যাখ্যা করতে আইনত বাধ্য। তাদের নিয়ে গণমাধ্যমে মন্তব্য করা হয়। আইনগত কারণে তাদের কর্তৃপক্ষ সরিয়ে দিতে পারে। তারা সহকর্মীদের কাছে জবাবদিহি করেন। দায়মুক্তি সংস্কৃতি নির্মূল করা, আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা, জাতীয় সংহতি প্রতিষ্ঠা, সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে নতুন সমাজ নির্মাণ এবং ব্যক্তির মানবাধিকারের প্রতি সম্মানের জন্য বিচারিক জবাবদিহি দরকার।
বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন লিখেছেন, স্বাধীন বিচার বিভাগের তাৎপর্য হল এখানে সরকারের অন্য দুটি বিভাগ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদ এবং অনুচ্ছেদ ৯৪(৪), ১১৬-এ এবং ১৪৭ অনুচ্ছেদে এ বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।