ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে সংক্ষুব্ধ সরকার। সচিবালয়ে সোমবার মন্ত্রিপরিষদের সভা শেষে এক অনির্ধারিত আলোচনায় এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন মন্ত্রীরা। একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রায়ের বিষয় জনগণকে জানানোর জন্য মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের নির্দেশ দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রায় তো ওনারা দিয়েছেন। পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি আপনাদের হাতে এসেছে। এখন আপনারা রায়ের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ নিয়ে কথা বলুন। এ বিষয়ে জনমত গড়ে তুলুন। জনগণ যেন বুঝতে পারে ষোড়শ সংশোধনীর পূর্ণাঙ্গ রায়ে তারা কী মন্তব্য করেছেন?’
মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকের পর অনির্ধারিত আলোচনায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ষোড়শ সংশোধনীর পূর্ণাঙ্গ রায়ের বিষয়টি উপস্থাপন করেন। দুই ঘণ্টাব্যাপী এটি নিয়ে আলোচনা হয়, যা এর আগে কখনও হয়নি।
অনির্ধারিত বৈঠকে আইনমন্ত্রী রায়ের কপি উত্থাপন করেন। তিনি রায়ের বিভিন্ন পয়েন্ট মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের অবহিত করেন। আইনমন্ত্রী বলেন, “ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে অপ্রাসঙ্গিক অনেক কিছু আনা হয়েছে, যা প্রয়োজন ছিল না। যেমন- রায়ে পঞ্চম ও ষষ্ঠ সংশোধনী টেনে আনা হয়েছে। এ রায়ে সংসদকে ‘ইমম্যাচিউর্ড’ বলা হয়েছে। এমনকি ২০১৪ সালে যে নির্বাচন হয়েছিল, সেটাকেও ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ বলা হয়েছে। এছাড়া রায়ে আরও অনেক ‘আপত্তিকর’ বিষয় আনা হয়েছে।”
মন্ত্রিপরিষদের একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আগামীকাল মঙ্গলবার এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করবেন বলেও সভা সূত্রে জানা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অপর এক মন্ত্রী বলেন, “রায়ে যেসব ‘আপত্তিকর’ মন্তব্য করা হয়েছে তা এক্সপাঞ্চ করতে আবেদন করা হবে।’’
ষোড়শ সংশোধনীর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রসঙ্গে মন্ত্রিসভার সদস্যরা বলেন, সংসদ যদি ইমম্যাচিউর্ড হয় তাহলে রাষ্ট্রপতিও ইমম্যাচিউর্ড। আর রাষ্ট্রপতি যে প্রধান বিচারপতিকে শপথবাক্য পাঠ করিয়ে প্রধান বিচারপতি করেছেন তিনি কি করে ম্যাচিউর্ড হতে পারেন- এমন প্রশ্ন রাখেন তারা।
মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু জাগো নিউজকে বলেন, ‘পঞ্চম সংশোধনীতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বাতিল করা হয়েছিল।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো আইন হলে সুপ্রিম কোর্ট ব্যাখ্যা দিতে পারেন, সংশ্লিষ্ট আইন বাতিল করা যেতে পারে। কিন্তু সংবিধান বাতিল করতে পারেন না।’
‘সংসদ যদি প্রশ্নবিদ্ধ হয় তাহলে যে সংসদ রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচিত করেছেন সেই রাষ্ট্রপতিও প্রশ্নবিদ্ধ! আর সেই রাষ্ট্রপতির কাছে শপথবাক্য পাঠ করে যিনি প্রধান বিচারপতি হয়েছেন তিনিও প্রশ্নবিদ্ধ হন।’
সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ছাড়াও মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
প্রসঙ্গত, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণ সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রেখে আপিল বিভাগের দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায় গত ১ আগস্ট প্রকাশিত হয়।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানটি তুলে দিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হয়। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ৯৬ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন এনে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেয়া হয়; যেটি ১৯৭২ সালের সংবিধানে ছিল।
সংবিধানে এই সংশোধনী হওয়ায় মৌল কাঠামোতে পরিবর্তন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করবে- এমন যুক্তিতে ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছরের ৫ নভেম্বর হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করা হয়।
ওই রিটের ওপর প্রাথমিক শুনানি শেষে হাইকোর্ট ২০১৪ সালের ৯ নভেম্বর রুল জারি করেন। গত বছরের ১০ মার্চ মামলাটির চূড়ান্ত শুনানি শেষে ৫ মে তা অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন আদালত।
পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর ওইদিনই সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায় পড়ার পর এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানানো হবে।