আবু সাইদ বিশ্বাসঃ সাতক্ষীরায় শিক্ষকদের সাময়িক বরখাস্ত প্রত্যাহারে উচ্চ আদালতের রায় মানা হচ্ছে না। প্রায় অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠানের দুই শতাধিক শিক্ষক কয়েক বছর ধরে রাজনৈতিক বিবেচনায় সাময়িক বরখাস্ত আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে বরখাস্তকৃত শিক্ষকরা যেমন মানবেতর জীবন-যাপন করছে তেমনি পাঠদান ও চরম ব্যাহত হচ্ছে।
সারা দেশের বেরসকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল-কলেজ-মাদ্রসা) এমপিওভুক্ত কোনো শিক্ষক-কর্মচারীকে ৬০ দিনের বেশি সাময়িক বরখাস্ত করা যাবে না। বরখাস্তের সময়কাল এর চেয়ে বেশি হলে ওই শিক্ষককে মাসিক বেতন-ভাতা প্রদান করতে হবে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরসহ ১০টি শিক্ষা বোর্ডকে এ সংক্রান্ত চিঠি দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। জানতে চাইলে এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব (মাধ্যমিক) সালমা জাহান বলেন, বেসরকারি শিক্ষকদের সাময়িক বরখাস্তের মেয়াদ ৬০ দিন নির্ধারিণ করতে বিজ্ঞ আদালত এ বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করে রায় দিয়েছেন। এ বিষয়ে একটি পর্যাবেক্ষণও দেয়া হয়েছে।
আদালতের পর্যবেক্ষণের কথা উল্লেখ করে সালমা জাহান আরো বলেন, তাতে বলা হয়েছে ৬০ দিনের বেশি কোনো শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করা যাবে না। এর বেশি বরখাস্ত করা হলে তাকে বেতন ভাতা দিতে হবে। আদালতের রায় বাস্তবায়ন করতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি), সকল শিক্ষাবোর্ডকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
মহামান্য হাইকোর্ট ডিভেশনের ১৫০৮৩/২০১৬ নং রীট পিটিশনের এক আদেশে আদালত ৬০ (ষাট) দিনের বেশী সাময়িক বরখাস্ত করা যাবে না মর্মে আদেশ দেন। রায়ে বাংলাদেশ সংবিধানে ১০২(২)(এ) আর্টিকেলসহ কয়েকটি আটিকেলের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে।
সর্বশেষ হাইকোর্টের ৩৬৫৭/২০১৫ নং রিট পিটিশনের আদেশ বাস্তবায়নে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগ বেসরকারি মাধ্যমিক-১ গত ইং-৬ আগস্ট ২০১৭ তারিখে যুগ্ম সচিব সালমা জাহান স্বাক্ষরিত ৬৯৪ নং এক সাকুর্লার জারী করেছেন। এতে বলা হয়েছে “মহামান্য হাইকোট ডিভিশনের রীট পিটিশন নং-৩৬৫৭/২০১৫ এর রায়ের বেসরকারী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোন শিক্ষককে ৬০ দিনের বেশী সাময়িক বরখাস্ত না রাখার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে এবং ৬০ দিনের বেশী সাময়িক বরখাস্ত রাখা হলে তিনি বেতন ও অন্যান্য ভাতা সমুদয় প্রাপ্ত হবেন।
২০১৩ সালের পর থেকে সাতক্ষীরাসহ দেশব্যাপী বিভিন্ন মামলায় বহু শিক্ষক আসামী হয়েছেন। মামলায় আসামী শ্রেণিভুক্ত হওয়ার পর শিক্ষকরা হাজতবাসও করেছেন অনেকে। যে কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে তাদেরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। হাজত থেকে বেরিয়ে ওই সমস্ত শিক্ষকরা স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান বা সভাপতি বরাবর তাদের সাময়িক বরখাস্তাদেশ প্রত্যাহারের আবেদন করলে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পরিষদ শিক্ষকদের সাময়িক বরখাস্তাদেশ প্রত্যাহার করে। আবার অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের শিক্ষকরা ২০১৩ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সাময়িক বরখাস্ত অবস্থায় রয়েছে।
প্রাপ্তে তথ্যে আরও জানা যায়, সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার দারুল উলুম চৌমহনী ফাজিল মাদ্রাসার সাময়িক বরখাস্তকৃত শিক্ষক মো. আব্দুল কাদির মহামান্য হাইকোর্টে ৪৯০০/১৩ নং রীট পিটিশন দাখিল করেন। ওই রিট পিটিশনে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্ট্রার গত ২৯-০৪-২০১৪ তারিখে ৮৭৯ নং পত্রে সংশ্লিষ্ট সকলকে উপযুক্ত আদালত কর্তৃক দন্ড প্রাপ্ত না হলে শুধু মাত্র আসামী হওয়ার কারণে সাময়িক বরখাস্তাদেশের বিষয়টি দীর্ঘায়িত না করার এবং এ ক্ষেত্রে মাষ্টার এবং সারভেন্ট বিধি অনুসরণ বাঞ্ছনীয় মর্মে পত্র প্রেরণ করেন।
এছাড়া গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার উজান তেওড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. নূরুন নবী সরকারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। যার বরখাস্তের মেয়াদ দেড় বছর পর্যন্ত গড়িয়েছিল। এরপর তিনি এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। যার ক্রমিক নং ৩৬৫৭/২০১৫। রিটে ওই শিক্ষক বলেছেন, আগে একজন শিক্ষককে সর্বোচ্চ তিন মাসের জন্য সাময়িক বরখাস্ত করা যেত। অভিযোগের নিষ্পত্তি না হলে তিন মাস পর বরখাস্তের আদেশ আপনা আপনি উঠে যেত। ১৯৯৬ সালে ওই নিয়ম বাতিল করা হয়। অনির্দিষ্টকালের জন্য সাময়িক বরখাস্ত করে রাখা মানবিক অধিকারের লঙ্ঘন- এই যুক্তি দেখিয়ে বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষকদের সাময়িক বরখাস্তের মেয়াদ ৬০ দিন করার নির্দেশনা চেয়ে ২০১৫ সালে ওই রিট আবেদন করা হয়। আদালত তার পক্ষে রায় দেন।
প্রসঙ্গত,মামলা, প্রশ্নপত্র ফাঁস, নকল সরবরাহ, শিক্ষার্থীদের হয়রানীসহ নানা ধরনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ম্যানেজিং কমিটি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষকদের সাময়িক বরখাস্ত করে। একই সঙ্গে তাদের বেতন ভাতা স্থগিত করে রাখে। বছরের পর বছর সামিয়ক বরখাস্ত করে ঝুলিয়ে রাখা হয় শিক্ষকদের। এতে করে তারা পরিবার পরিজন নিয়ে চরম মানবেতর জীবন যাপন করেন। আদালতের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষকরা এখন ভোগান্তি থেকে রক্ষা পাবেন।
সাতক্ষীরায় সাত জন প্রতিষ্ঠান প্রধান সহ দুই শতাধিক শিক্ষক বর্তমানে সামিয়ক বরখাস্তে আছে। কলারোয়া মাদ্রাসার মাওলানা মোহাম্মদ আলী,ওমর আলী,মাওলানা বেলালী সহ ৫ জন,কামার খালি দাখিল মাদ্রাসার সুপার,কয়লা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, পরপর তিনবার নির্বাচিত চেয়ারম্যান শওকতা হোসেন,চান্দুড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুল গফুর ,সোনার বাংলা কলেজের অধ্যাক্ষআশফাকুর রহমান,প্রভাষক আশরাফুজ্জামান,ইমামুল হক,কুশাডাঙ্গা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুল লতিফ,হেলা তলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুল মাজেদ,শেখ আমানুল্লাহ ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক বিএনপি নেতা তোফাজ্জেল হোসেন সহ অনেকে এখনো সাময়িক বরখান্তে রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকজন শিক্ষকরে বেতন সম্পূর্ণ ফেরত পাঠানো হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ সভাপতি সরকার দলীয় নেতা। তারা উচ্চ আদালত ও শিক্ষা মন্ত্রানালয়ের কোন আদেশী তোয়াক্কা করছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। একই অবস্থা জেলার সাতটি উপজেলাতে।
শিক্ষকদের সাময়িক বরখাস্ত প্রত্যাহারে উচ্চ আদালতের রায় কেন মানা হচ্ছে না জানতে চাইলে কয়েকটি প্রতিষ্টান প্রধান জানান,তারা শুনেছে তবে তাদের কাছে এখনো কোন আদেশ এসে পৌছায়নি। এছাড়া যে সব প্রতিষ্ঠানে কয়েক বছর ধরে প্রতিষ্টানে পরিচালনা পরিষদ না থাকায় তারা ও উচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে সাতক্ষীরা সদর আসনের এমপি মীর মোস্তাক আহম্মেদ রবী জানান,তিনি সাতক্ষীরা সিটি কলেজের সভাপতি থাকা কালিন তিনি সব শিক্ষকদের সাময়িক বরখাস্ত প্রত্যাহার করেছেন। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব নজরুল ইসলাম তিনি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সভাপতি । সে সব প্রতিষ্টানের শিক্ষকদের সাময়িক বরখাস্ত প্রত্যাহার করেছেন,সাতক্ষীরা আলিয়া কামিল মাদ্রাসার এক জন শিক্ষক জানান,তাদের প্রতিষ্ঠানের সভাপতি জেলা প্রশাষক। সেখানে পাঁচ জন শিক্ষকের সাময়িক বরখাস্ত প্রত্যাহার করা হয়েছে।
এব্যাপারে সাতক্ষীরা জেলা শিক্ষা অফিসার এস.এম, ছায়েদুর রহমান জানান, তিনি আদালত ও শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের আদেশের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান ঐ পত্র মোতাবেক শিক্ষকদের বরখাস্তাদেশ প্রত্যাহার হলে মুলত শিক্ষার্থীরাই বেশী উপকৃত হবে।
Check Also
‘আ.লীগ-বিএনপি বা যে কোনো রাজনৈতিক দলকে সরিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা জামায়াতের নেই’
বাংলাদেশের সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যম আনন্দবাজারকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. …