পথে পথে গরুর ট্রাকে বেপরোয়া চাঁদাবাজি পরিবহন শ্রমিক, ক্ষমতাসীন দল ও পুলিশের নামে টাকা আদায় * রাজশাহী-চাঁপাই সীমান্ত থেকে ঢাকা ১৬টি স্পটে * সাতক্ষীরা ও যশোর সীমান্ত থেকে ঢাকা ১৫টি স্পটে * গরুপ্রতি ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা চাঁদা

আর ক’দিন পরেই কোরবানির ঈদ। ধীরে ধীরে রাজধানীতে বাড়ছে পশুবাহী ট্রাকের সংখ্যা। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চাঁদাবাজিও। বিভিন্ন মহাসড়কে পথেঘাটে এমনকি গরুর হাটগুলোতে ছোবল মারছে চাঁদাবাজরা। কোথাও কোথাও পরিবহন শ্রমিক, কোথাও ক্ষমতাসীন দল, কোথাও বা পুলিশের নামে তোলা হচ্ছে টাকা। এ ছাড়া সীমান্তের ঘাটগুলোতেও চাঁদাবাজি চলছে।
গরু ব্যবসায়ীরা জানান, ভারতীয় গরু আনতে সীমান্তের ওপারে বিএসএফকে দিতে হয় মোটা অংকের ‘পাসিং খরচ’। সেখান থেকেই শুরু। এরপর বাংলাদেশ সীমান্তে গরু আনার পর সরকার নির্ধারিত রাজস্বের অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়। এরপর গরুর ট্রাক রাজধানীতে নিয়ে আসতে পথে পথে চাঁদাবাজির শিকার হতে হয় ব্যবসায়ীদের। রাজশাহী-চাঁপাই সীমান্ত থেকে ঢাকা পর্যন্ত প্রায় ১৬টি স্পটে, সাতক্ষীরা সীমান্ত থেকে যশোর পর্যন্ত দুটি ও যশোর সীমান্ত থেকে ঢাকা পর্যন্ত প্রায় ১৩টি স্পটে চাঁদা দিতে হয়।

রাজশাহীতে পুলিশ ও মোটরশ্রমিক নামধারীরা বিভিন্ন স্পটে ২৫০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে গরুর ট্রাক থেকে পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের নামে ব্যাপক চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে। প্রতিটি ট্রাক থেকে ৭শ’ টাকা করে চাঁদা আদায় করছে তারা। সাতক্ষীরা সীমান্তে বিএসএফকে ‘পাসিং খরচ’ হিসাবে দিতে হয় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। যশোর সীমান্ত থেকে ঢাকার গাবতলীতে গরু নিয়ে আসতে বিভিন্ন পয়েন্টে ট্রাকপ্রতি ৩০০-৫০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের কয়েকজন ব্যবসয়ী জানান, হাট থেকে গরু কেনার পর ঢাকা পর্যন্ত পথে-পথে চাঁদা আদায়ের কারণে একেকটি গরুতে অতিরিক্ত ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা খরচ পড়ে যাচ্ছে। এ টাকা তারা ক্রেতাদের কাছ থেকেই আদায় করবেন বলে দাবি করেন। তারা জানান, এভাবে চাঁদাবাজি চলতে থাকলে এ বছর বেশি দামে কোরবানির গরু কিনতে হবে ক্রেতাদের। যুগান্তর রিপোর্ট, ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন হাট : শনিবার রাজধানীর আফতাবনগর, গাবতলী ও শাহজাহানপুর গরুর হাট সরেজমিন ঘুরে এবং ট্রাকশ্রমিক, গরুর পাইকার ও খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সবচেয়ে বেশি চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছেন উত্তরবঙ্গ থেকে আসা ব্যবসায়ীরা। এদিন আফতাবনগর হাটে কথা হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ৮টি গরু নিয়ে আসা খামারি শফিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, চাঁদাবাজির কারণে তার একেকটি গরু ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা বেশি দামে বিক্রি করতে হবে। জানতে চাইলে মাঝারি আকৃতির একটি গরু দেখিয়ে শফিকুল বলেন, ‘চাঁদাবাজি না থাকলে এ গরুটি তিনি সর্বোচ্চ ৪৫ হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারতেন। কিন্তু এখন এ গরুটি ৫০ হাজার টাকার নিচে বিক্রি করলে তাকে লোকসান গুনতে হবে।’ কালীগঞ্জ থেকে রাজধানীর আফতাবনগরে আসা ট্রাক (ঢাকা মেট্রো-ট-১১-২৫৪৫) চালক কামাল হোসেন জানান, ১৬টি মাঝারি আকৃতির গরু নিয়ে তিনি ঢাকার আফতাবনগর হাটে এসেছেন। ঢাকায় আসতে তিনি মোট ১১টি স্থানে চাঁদা দিয়েছেন। এর মধ্যে পদ্মার ওপারে ৫ স্থানের মধ্যে ফরিদপুর মোড়ে ৫শ’, কালীগঞ্জে ৩শ’, মাগুরায় ৩শ’ ও দৌলতদিয়া ঘাটে ফেরি ভাড়া বাবদ অতিরিক্ত ৭৪০ টাকা দিয়েছেন। কামাল হোসেনের অভিযোগ, অন্যান্য মালামাল নিয়ে ফেরি পার হওয়ার সময় ফেরি ঘাটে ভাড়া ও সিরিয়াল বাবদ তাদের কাছ থেকে ১ হাজার ৬৬০ টাকা নেয়া হলেও গরুর ট্রাক থেকে নেয়া হচ্ছে ২ হাজার ৪শ’ টাকা। তবে বাড়তি এ টাকার কোনো রশিদ দেয়া হচ্ছে না।

কামাল হোসেন বলেন, আরিচা পার হওয়ার পর মানিকগঞ্জে ৪শ’ সাভারের নবীনগরে ৩শ’ এবং গাবতলীতে ৫শ’ টাকা অতিরিক্ত চাঁদা দিতে হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, রাজধানীতে প্রবেশের পর শ্যামলী, বিজয় সরণি ও রামপুরায় ট্রাফিক পুলিশ নিয়েছে আরও ৮শ’ টাকা। কামাল জানান, কালীগঞ্জ থেকে গরু নিয়ে ঢাকার আফতাবনগর হাটে গরুগুলো পৌঁছে দিতে তিনি ট্রাক ভাড়া পেয়েছেন ২৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে সাড়ে ৫ হাজার টাকা পুলিশ, অঞ্চলভিত্তিক মোটরশ্রমিক ইউনিয়ন ও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতারা নিয়ে গেছেন।

একই ধরনের অভিযোগ করেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঢাকার গাবতলী হাটে আসা ট্রাকের (চট্টমেট্রো-ট-১১-০১৫২) চালক বদরুল আলম। যুগান্তরকে তিনি বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে গাবতলী হাটে আসতে তাকে ২ হাজার ৩৫০ টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে। রাস্তায় বিভিন্ন স্থানে অঞ্চলভিত্তিক শ্রমিক ইউনিয়ন অফিস, সরকারদলীয় ক্যাডার ও পুলিশ ট্রাক থামিয়ে ট্রাকপ্রতি ২শ’ থেকে ৭শ’ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে। এর মধ্যে আরিচা থেকে গাবতলী পর্যন্ত পুলিশকে ট্রাকপ্রতি ১ হাজার ২শ’ টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।

রাজধানীর শাহজাহানপুর গরুর হাটে কথা হয় বেপারি মো. আরিফের সঙ্গে। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থেকে ৮টি গরু নিয়ে শুক্রবার সকালে ঢাকার শাহজাহানপুর হাটে এসেছেন ষাটোর্ধ্ব আরিফ। তিনি জানান, গত বছর তিনি ১৫টি গরু নিয়ে আসেন। তখন এক লাখ টাকারও বেশি লোকসান গুনেছেন। এ কারণে এ বছর গরুর সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছেন। পথেঘাটে চাঁদা দিতে হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে আরিফ বলেন, এটা ড্রাইভার-হেলপার বলতে পারবে। বিভিন্ন স্থানে ট্রাক থামিয়ে ড্রাইভার-হেলপারকে টাকা দিতে দেখেছি।

গরুর বেশ কয়েকজন পাইকারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত এলাকার তক্তিপুর হাটটি গত কয়েক বছরের মধ্যে গরু-মহিষের সবচেয়ে বড় হাটে পরিণত হয়েছে। জেলার বিভিন্ন সীমান্তপথে আসা ভারতীয় গরু-মহিষ ছাড়াও দেশে খামারিদের বিপুলসংখ্যক গরু উঠে তক্তিপুর হাটে। শনিবার দুপুরে গাবতলী হাটে যুগান্তরের সঙ্গে কথা হয় গরু ব্যবসায়ী (পাইকার) মানিকের। যুগান্তরকে তিনি জানান, ওই হাটে প্রতিদিন ২ হাজারেরও বেশি গরু-মহিষ বিক্রি হয়। তবে গরু-মহিষের সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি ওই হাটে চাঁদাবাজদের সংখ্যাও বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, টোল ছাড়াও এক জোড়া গরু কিনতে ৮ থেকে ৯শ’ টাকা অতিরিক্ত দিতে হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় ক্যাডাররা ওই টাকা নিচ্ছে বলে তিনি জানান।

একই এলাকার ব্যবসায়ী মফিজুল বলেন, গরু কেনার পর থেকেই শুরু হয় চাঁদা দেয়ার পালা। তিনি বলেন, সীমান্ত হাট থেকে গরুবাহী ট্রাকগুলো ঢাকায় আসার পথে মহানন্দা টোল ঘরে ৬শ’ সুলতানগঞ্জ করিডোরে গরুপ্রতি শুল্ক ফি ৫০০ টাকার স্থলে ১ হাজার ৩শ’ টাকা দিতে হচ্ছে। এছাড়া রাজাবাড়ী তল্লাশি কেন্দ্রে প্রতি ট্রাকে ৩শ’, সিটি হাটে ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা চাঁদা দিতে হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।

রাজশাহী : গরু ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে বিট বা খাটালে কয়েক দফা চাঁদা দিয়ে গরুর হাটেও দিতে হচ্ছে দফায় দফায়। তারপর পথে পথে চাঁদা দিতে দিতে ঢাকার গাবতলী হাটে গিয়েও রেহাই মিলছে না। সেখানেও চাঁদাবাজির শিকার হতে হচ্ছে। তাদের মতে, শুধু পথেই এক গরুতে ন্যূনতম আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা চাঁদা গুনতে হচ্ছে। আর চাঁপাইনবাবগঞ্জ বা রাজশাহীর হাটে প্রতি ট্রাকে দিতে হচ্ছে আরও দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। ব্যবসায়ীরা জানান, মহাসড়কে মোটরশ্রমিক নামধারীরা ট্রাক থামিয়ে যে চাঁদা নিচ্ছে সেখানে পুলিশেরও সংশ্লিষ্টতা আছে। অনেক জায়গায় মহাসড়কে কর্তব্যরত পুলিশ নিজেরাই চাঁদা নিচ্ছে গরুর ট্রাক থেকে।

শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার সময় নগরীর প্রবেশমুখ কাশিয়াডাঙ্গা মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, শ্রমিক নামধারী একদল চাঁদাবাজ গরু-মহিষের ট্রাক ছাড়াও বিভিন্ন পণ্যবাহী ট্রাক থেকে বিভিন্ন অংকের চাঁদা আদায় করছে। চাঁদাবাজদের সবার হাতেই লাল কাপড় বাঁধা লাঠি দেখা যায়। দুপুরে আবদুল কুদ্দুস নামের একজন ট্রাকচালক যুগান্তরকে বলেন, কাশিয়াডাঙ্গা মোড়ের যে স্থানটায় ট্রাক ঘিরে চাঁদা নেয়া হচ্ছে তার কয়েক গজ দূরে কাশিয়াডাঙ্গা পুলিশ ফাঁড়ি। ফাঁড়ির সামনে চেয়ার পেতে বসে থাকা পুলিশ সদস্যরা তা দেখলেও কিছু বলছেন না। এদিকে কিছুক্ষণ পর নগরীর বাইপাসের আমচত্বরে গিয়ে দেখা যায়, সেখানেও লাঠির আগায় লাল কাপড় বেঁধে গরুসহ পণ্যবাহী ট্রাক থামিয়ে চাঁদা তুলছে একদল চাঁদাবাজ। রাজশাহী বাইপাসের খড়খড়ি মোড় ও বেলেপুকুরেও একইভাবে ট্রাক থেকে চাঁদা তোলা হচ্ছে।

এদিকে মহাসড়কের কাটাখালী, খড়খড়ি বাইপাস, পুঠিয়া, নাটোরের তেবাড়িয়া মোড় ও নাটোর চৌরাস্তা মোড়ে গরু ট্রাক থেকে ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা নেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন গরু ব্যবসায়ীরা। তারা জানান, মহাসড়কের এই পাঁচটি স্থানে মোটর শ্রমিকদের নামে চাঁদা তোলা হলেও এই চাঁদা আদায়ে পুলিশের পক্ষ থেকেও চাপ দেয়া হচ্ছে। কেউ চাঁদা দিতে রাজি না হলে পুলিশ ট্রাক থামিয়ে কাগজপত্র দেখার নাম করে হয়রানি করে থাকে।

চট্টগ্রামের গরু ব্যাপারী সামসুল হক পাটোয়ারি জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের রামচন্দ্রপুর হাট থেকে গরু কিনে চট্টগ্রাম নিয়ে যান তিনি। রামচন্দ্রপুর হাটে গরুর ট্রাক থেকে এক হাজার ৮০০ টাকা করে নেয়া হচ্ছে চাঁদা। এর পর রাজশাহী থেকে টাঙ্গাইল পর্যন্ত আট জায়গায় গরুর ট্রাকে চাঁদা দিতে হচ্ছে। টাঙ্গাইল থেকে মির্জাপুর, চন্দ্রা, আশুলিয়া হয়ে ঢাকা পর্যন্ত আরও প্রায় ছয়টি স্পটে পুলিশের নামে চাঁদা নেয়া হচ্ছে। টাকা না দিলেই ট্রাক সাইড করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখা হচ্ছে।

রাজশাহীর ট্রাক মালিক হাবিবুর রহমান বলেন, বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমের কড্ডার মোড়ে হাইওয়ে ও সিরাজগঞ্জ জেলা পুলিশ যৌথভাবে গরুর ট্রাক থেকে চাঁদা তোলে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি এম খুরশীদ হোসেন বলেন, মহাসড়কে চাঁদাবাজির বিষয় তার জানা নেই। চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ রয়েছে। ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেয়া হয়।

যশোর : বেনাপোল সীমান্ত থেকে ঢাকার গাবতলী পর্যন্ত কোরবানির পশু পৌঁছাতে অন্তত ১৩ জায়গায় চাঁদা দিতে হচ্ছে বলে ব্যাপারীদের অভিযোগ। যশোরের বাগআঁচড়া, নাভারণ, ঝিকরগাছা, চাঁচড়া, খাজুরা, মাগুরা, মধুখালী, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, গোয়ালন্দঘাট, মানিকগঞ্জ, সাভার ও গাবতলীতে ঘাটে ঘাটে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। এতে গরু আমদানি খরচ বেড়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে দুর্ভোগের শিকার ব্যাপারীরা। ভারতীয় গরুর পর্যাপ্ত আমদানি থাকলেও দেশে বিভিন্ন স্থানে চাহিদা কমেছে। গত বছরের তুলনায় এবার বেনাপোল সীমান্তের হাটগুলোতে বাইরের ব্যাপারীর আনাগোনা কম। স্থানীয় ব্যাপারীরা অধিকাংশ পশু ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ট্রাকে পাঠাচ্ছেন। গরু ব্যাপারী রাজু আহমেদ জানান, পুটখালী সীমান্ত থেকে ঢাকার গাবতলীতে গরু নিয়ে যেতে অন্তত ১৩টি স্থানে ট্রাক প্রতি ৩০০-৫০০ টাকা পর্যন্ত হারে চাঁদা দিতে হয়। টাকা দিতে রাজি না হলে ভয়ভীতি দেখানো হয়। বাধ্য হয়ে চাঁদা দিচ্ছি। আরেক ব্যাপারী হাশেম আলী জানান, সীমান্তের হাটে বাইরের ব্যাপারী আসছে কম। আমরা ট্রাকে করে দেশের বিভিন্ন স্থানে গরুর পাঠাচ্ছি। গরু পাঠাতে গিয়ে চাঁদা দিতে হচ্ছে। উত্তর অঞ্চলে বন্যার কারণে ভারতীয় গরুর চাহিদা কম। তবে আমদানি কমেনি। যথেষ্ট গরু আসছে ভারত থেকে। চাঁদাবাজি বন্ধ করতে পারলে আমরা স্বস্তিতে থাকতে পারতাম।

সাতক্ষীরা : সীমান্তের ঘোনা গরু হাটে আসা নোয়াখালীর পাইকারী ব্যবসায়ী শামসুল হক বলেন, ভারতে একেকটি বড় গরু কেনার পর বিএসএফকে ‘পাসিং খরচ’ হিসেবে দিতে হয় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। দেশে আনার পর গরুপ্রতি সরকার নির্ধারিত রাজস্ব ৫০০ টাকা হলেও দিতে হয় সাড়ে চার হাজার টাকা। এরপর পথে পথে দু’তিন স্থানে চাঁদা দিতে হয়। ফেনী থেকে আসা গরু ব্যবসায়ী আবুল খায়ের বলেন, ভারতীয় গরুতে চাঁদাবাজি শুরু হয় ভারত থেকেই। সীমান্ত পার করার পর ঢাকা বা অন্য কোনো জেলায় নিয়ে যেতে পথে পথে গুনতে হয় চাঁদা। এভাবে বড় গরু প্রতি ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা চলে যায়। আমরা গরু বিক্রি করে লাভ করব কিভাবে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ : সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক গরু আসছে। এসব ভারতীয় গরু বিক্রির জন্য নিয়ে যাওয়া হয় সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর ও শিবগঞ্জ উপজেলার তর্তিপুর হাটে। এখান থেকে ব্যাপারীরা গরু কিনে নিয়ে যান রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, খুলনা, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। কিন্তু হাটগুলো থেকে ট্রাক ছাড়ার সময় শ্রমিক ইউনিয়নের নামে চাঁদা তোলা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ব্যাপারীরা। শনিবার দুপুরে শিবগঞ্জের তর্তিপুর হাটে গিয়ে চাঁদাবাজির সত্যতা পাওয়া যায়। এখানে ট্রাকপ্রতি ৭০০ টাকা করে চাঁদা তুলতে দেখা গেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে প্রতিদিন প্রায় দেড় শতাধিক গরু বোঝাই ট্রাক ছেড়ে যায়। আর এসব ট্রাক থেকে প্রতিদিন গড়ে এক লাখ টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ট্রাক, ট্যাংকলরি ও কাভার্ডভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আবদুল খালেক গরুর ট্রাক থেকে চাঁদা তোলার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, জেলা ট্রাক মালিক গ্রুপ ও শ্রমিক ইউনিয়ন যৌথভাবে এ টাকা তোলে।

কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামের সবচেয়ে বড় পশুর হাট যাত্রাপুর বাজার। শনিবার ছিল হাটবার। শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পথ। ধরলা ব্রিজের পূর্বপ্রান্ত থেকে শুলকুর বাজার হয়ে যাত্রাপুর হাটের আট কিলোমিটার রাস্তা যেতে সময় লাগে প্রায় দুই ঘণ্টা। খানাখন্দে ভরা ভাঙা রাস্তায় লেগে থাকে দীর্ঘ যানজট। হাটে গিয়ে দেখা যায় ছোট বড় অনেক গরু। যদিও হাট ইজারাদারদের ভাষায় অন্য সময়ের তুলনায় অর্ধেক গরু। তার পরও ক্রেতা নেই। বিক্রেতাদের পশুর ভালো দাম না পাওয়ায় ক্ষোভ।

ট্রাক ড্রাইভার হেলাল মিয়া জানান, কুড়িগ্রামে ট্রাক নিয়ে ঢুকলেই ট্রাফিক পুলিশকে দিতে হয় ৫০০ টাকা। এ ছাড়া লালমনিরহাট, রংপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল হয়ে পথে পথে নানা অজুহাতে পুলিশসহ বিভিন্ন সংগঠন, পৌরসভার নামে চাঁদা বা টোল দিতে হয়। এতে ট্রাকপ্রতি বাড়তি খরচ পড়ে গড়ে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা।

কুষ্টিয়া : পথে পথে চাঁদাবাজি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে মরপুর উপজেলার সুলতানপুর গ্রামের ব্যাপারী আসাদুল মণ্ডল বলেন, ঢাকা ও চট্টগ্রামের হাটে গরু নিয়ে যেতে তিন পয়েন্টে পুলিশকে চাঁদা দিতে হচ্ছে। টাকা দিতে অস্বীকার করলে আমাদের সঙ্গে খুব খারাপ আচারণ করে। এমনকি টেনেহিঁচড়ে ট্রাক থেকে নামিয়ে লাঞ্ছিত করে। তখন মনে হয় ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে ডাকাতি-ছিনতাই করে খাই। শনিবার দুপুরে কুষ্টিয়ার সদর উপজেলার আলামপুর পশুর হাটে দেখা হয় আসাদুল মণ্ডলের সঙ্গে। আরেক ব্যাপারী কুষ্টিয়া সদর উপজেলার মতিয়ার রহমান বলেন, ঈদের আগে আজকে (শনিবার) আলামপুরের শেষ হাট। তাই বেশি করে গরু কিনতে হবে। পুলিশের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ করেন ব্যাপারী মতিয়ার। তিনি জানান, ঢাকায় গরু নিয়ে যেতে পথে পথে পুলিশকে চাঁদা দিতে হয়। বিশেষ করে হাইওয়ে পুলিশের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ ব্যাপারীরা। লালন শাহ সেতু এলাকায় পুলিশ, বনপাড়া ও যমুনা সেতু সংলগ্ন এলাকায় হাইওয়ে পুলিশকে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয় বলে জানান মতিয়ার।

গোয়ালন্দ : চুয়াডাঙ্গা থেকে ২৮টি গরু বোঝাই আসা ট্রাক চালক মো. হিরা জানান, দৌলতদিয়া ঘাট পর্যন্ত আসতে তার কাছ থেকে ঝিনাইদহে মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের নামে ২৫০ টাকা, ফরিদপুরে মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের নামে ৫০ টাকা এবং ট্রাক ড্রাইভার্স ইউনিয়নের নামে ২০ টাকা করে আদায় করা হয়েছে। কুষ্টিয়া থেকে গরু নিয়ে আসা ট্রাক চালক মো. মমিন অভিযোগ করে বলেন, তিনি দালালের সহযোগিতা ছাড়া দৌলতদিয়া ট্রাক বুকিং কাউন্টার থেকে টিকিট নিতে পারেননি। এ জন্য তাকে দালালের হাতে এক হাজার ৪৬০ টাকার জায়গায় দুই হাজার ৫০০ টাকা দিতে হয়েছে।

কুমিল্লা : ঢাকাগামী গরু বোঝাই ট্রাকে হাইওয়ে পুলিশ, কমিউনিটি ট্রাফিক পুলিশ ও শ্রমিক ইউনিয়নের নামে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী চালক ও বিক্রেতারা। জেলার কংশনগর থেকে ঢাকাগামী পাইকারি গরু বিক্রেতা নাজিম উদ্দিন জানান, তিনি গরু নিয়ে যাওয়ার পথে ইলিয়টগঞ্জ স্টেশনে তার গাড়িটি আটক করা হয়। পরে শ্রমিক সংগঠনের নামে ২০০ টাকা এবং হাইওয়ে পুলিশের নামে ৫০০ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। তিনি জানান, তার সামনে এমন আরও কয়েকটি গরু বোঝাই ট্রাক আটক করে একই কায়দায় চাঁদা আদায় করা হয়। তবে হাইওয়ে পুলিশের দাউদকান্দি থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ বলেন, গরু বোঝাই ট্রাক থেকে হাইওয়ে পুলিশের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

মানিকগঞ্জ : পাটুরিয়া ঘাটে গরুর মহাজন আলম শেখ জানান, দৌলতদিয়া থেকে পাটুরিয়া হয়ে মানিকগঞ্জ পর্যন্ত কোনো স্থানেই পুলিশ কিংবা পরিবহন শ্রমিকদের চাঁদা দিতে হচ্ছে না। এমনই সুর মেলালেন একই এলাকার আক্কাছ আলী, কোরবান আলী, আহম্মদ ব্যাপারী, মফিজ ব্যাপারীসহ আরো কয়েকজন। তারা জানান, শুধু কষ্টিয়া এলাকায় লাল নিশান উড়িয়ে প্রকাশ্যে একটি পরিবহন সংগঠনের নামে ৫০০ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে। মানিকগঞ্জ পুলিশ সুপার মাহফুজুর রহমান বিপিএম জানিয়েছেন, কোনো পশুবাহী ট্রাকে চাঁদাবাজি দূরের কথা পশু বহনকারী কোনো ট্রাকে সিগন্যাল পর্যন্ত দিতে পারবে না কোনো পুলিশ সদস্য।যুগা

Check Also

সাতক্ষীরা জেলা জলবদ্ধতা নিরসন কমিটির সভা

শাহ জাহান আলী মিটন , সাতক্ষীরা :সাতক্ষীরা   জেলা  জলবদ্ধতা নিরসন কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।সাতক্ষীরা জেলা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।