কামাল হোসেন আজাদ ও শাহনেওয়াজ জিল্লু, কক্সবাজার : রাথিদং জেলার সোহাগপ্রাং রোহিঙ্গা পল্লীতে নারকীয় হত্যালীলা চালিয়েছে বর্মী হানাদার বাহিনী। পুলিশ, লুন্টিং, সেনা ও বিজিপি সম্মিলিতভাবে এ বর্বরতা চালিয়েছে। সোমবার দিবাপূর্ব রাতের শেষভাগে এ নৃশংসতা চালিয়েছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।
জানা যায়, কয়েক শত সৈন্য গ্রামটি ঘেরাও করে চিরুণী অভিযান চালিয়ে রোহিঙ্গা পুরুষদের ধরে ফেলে। আটককৃত পুরুষদের দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয়েছে। রোহিঙ্গা নারীদের ধরে নিয়ে গিয়ে গ্রামের একটি স্কুলঘরে গণধর্ষণ চালায়। উঠতি বয়সের কন্যা শিশুও রক্ষা পায়নি সেনাদের ধর্ষণ থেকে। স্কুল ঘরে অসংখ্য নারীর লাশ এখনো পড়ে রয়েছে বলেও জানিয়েছে তারা।
সূত্র আরো জানিয়েছে, হত্যার পর গাড়িতে তুলে অনেক লাশ নিয়ে গেছে। তবে বেশ কিছু লাশ এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। যাওয়ার সময় অগ্নি সংযোগ করার ফলে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে বসতঘরগুলো। পুড়ে মরেছে গবাদিপশুও। গ্রামটি এখন জনশূন্য ও নিস্তব্ধ। আশপাশের রোহিঙ্গা পল্লীগুলোও ঘিরে রেখেছে সামরিক বাহিনী।
বলাবাহুল্য, আরাকানের প্রত্যেক মুসলিম পল্লীতে হত্যালীলা চালানোর জন্য ইতিমধ্যে অমুসলিমদের সরিয়ে নিয়েছে প্রশাসন। এ বর্বরতা চলতে থাকলে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে পুরো আরাকান রোহিঙ্গা শূন্য হতে পারে বলে আশংকা করছেন বিশ্লেষকরা।
গতকাল সোমবার ভোর থেকে মংডুর দক্ষিণ পূর্বে রাথিদং সংলগ্ন এলাকার ধুংচি পাড়া ইউনিয়নের চারটি রোহিঙ্গা গ্রামে একের পর এক মর্টার নিক্ষেপ করছে। এতে করে আগুন ধরে পুড়ে যাচ্ছে ধুংচি ইউনিয়নের মংচিঘোনা, বড়পাড়া, পূর্বপাড়া ও কুয়েশ্চাং রোহিঙ্গা পল্লী।
এদিকে গ্রামগুলোর রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে দিক-বিদিক ছুটে পালাচ্ছে। হানাদার বাহিনী কামানবাহী ট্যাংকার থেকে গোলা নিক্ষেপ করতে করতে ক্রমশই রোহিঙ্গা পল্লীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
রোহিঙ্গাদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠেছে বুথিদং থানার চৌপ্রাং ইউনিয়নাধীন বিভিন্ন গ্রাম। দিনব্যাপী ওই এলাকায় হত্যালীলা চালিয়েছে সৈন্যরা। শিশু, নারী, বৃদ্ধ, যুবক কেউ বাদ পড়েনি সেনাদের হাত থেকে। যাকে যেখানে পেয়েছে সেখানে গুলি করেছে। বন্দুকের বাট দিয়ে মেরে থেতলে দিয়েছে অনেক রোহিঙ্গার মাথা ও মুখ।
আরোও জানা যায়, গত রোববার তাণ্ডাব চালিয়েছে বর্মী হানাদার বাহিনী। সেনাদের বুলেট বিদ্ধ হয়ে মারা গেছে অন্তত অর্ধশত রোহিঙ্গা। রক্ষা পায়নি মায়ের কোলে থাকা নিষ্পাপ শিশুরাও। একটি শিশুকে মায়ের কোল থেকে টেনে নিয়ে মায়ের সামনে পদদলিত করে নাড়িভূড়ি বের করে ফেলে হানাদার বাহিনীর সদস্যরা।
এদিকে চৌপ্রাং এর অদূরে রোহিঙ্গা পল্লী থেকে খবর পাওয়া গেছে, বিকেলের কিছু সময় সেনা ট্রাকে করে লাশগুলো নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
উল্লেখ্য, গত ২৪ আগস্ট দিবাগত রাত থেকে রোহিঙ্গাদের উপর আবারো গণহত্যা শুরু করেছে বর্মী বাহিনী। গত তিন দিনে মংডু, বুথিদং ও রাথিদং-এ প্রায় ১ হাজার রোহিঙ্গা হত্যার শিকার হয়েছে। আহত হয়ে আশংকাজনক অবস্থায় রয়েছে পাঁচ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা। এছাড়াও উদ্বাস্তু হয়ে পাহাড়ে ও বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থান করছে প্রায় পঞ্চাশ হাজার।
চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর প্রহর গুণছে সেনা প্রহৃত রহিম : চিকিৎসাভাবে মৃত্যুর প্রহর গুণছে সেনা প্রহৃত আব্দুর রহিম। আরাকানের উত্তর মংডুর হঁরর ডিল গ্রামের এই রোহিঙ্গা যুবককে বেশ কিছুদিন আগে বর্মী সেনা সদস্যরা তুলে নিয়ে ব্যাপক নির্যাতন করে। এতে শরীরের বিভিন্ন স্থানে মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয় ওই যুবক। মাথায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাতের ফলে আশংকাজনক অবস্থায় রয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, বর্মী সেনা সদস্যরা নির্যাতনের পর ফেলে রেখে গেলে স্থানীয়রা সহযোগিতা করে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়। বাংলাদেশে তার কোন আত্মীয় স্বজন না থাকায় উখিয়ার বালুখালি অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গ্রাম্য প্রতিবেশীর ছাউনীতে আশ্রয় নেয়। ক্যাম্পের এমএসএফ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নেয়ার পর তাকে উখিয়া সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ চিকিৎসা সেবা না দেয়ায় ফিরে যায় বালুখালী ক্যাম্পে। বর্তমানে তার প্রশ্রাবের রাস্তা দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। শারিরিক অবস্থার আরো অবনতি হয়েছে। ফলে মৃত্যুর প্রহর গুণছে সে।
টেকনাফে ১৪১ রোহিঙ্গাকে ফেরত: এদিকে টেকনাফের সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে প্রবেশ কালে ১৪১ জন রোহিঙ্গাকে আটক করেছে বিজিবি ও পুলিশ। রোববার ভোর রাত হতে সোমবার ভোররাত পর্যন্ত সময়ে হোয়াইক্যং ও উনছিপ্রাং সীমান্ত এলাকা থেকে এসব রোহিঙ্গাদের আটক করা হয়। এদের মধ্যে ৭ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে পুলিশ। পরে স্ব স্ব সীমান্ত দিয়ে আটক রোহিঙ্গাদের মায়ানমার ফেরত পাঠানো হয় বলে নিশ্চিত করেছেন ২ বিজিবি’র টেকনাফস্থ ব্যাটলিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল এস এম আরিফুল ইসলাম।
বিজিবির এই কর্মকর্তা বলেন, সীমান্তে দিন-রাত নিশ্ছিদ্র টহল জোরদার করেছে বজিবি। এরপরও কোনভাবেই মিয়ানমার নাগরিকরা যাতে বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে সে ব্যাপারে সর্তক নজরদারি রাখা হয়েছে। এছাড়া সীমান্ত এলাকায় বিজিবির পাশাপাশি কোস্ট গার্ড এবং পুলিশও কাজ করে যাচ্ছে।
রোহিঙ্গা শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না!
আল জাজিরার খবরে বলা হয়, মিয়ানমারের সহিংসতা প্রবণ রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে দেশটির সেনাবাহিনী।
স্থানীয় রোহিঙ্গারা এবং অধিকার কর্মীরা অভিযোগ করেছেন, নিরস্ত্র রোহিঙ্গা পুরুষ ও নারীদের লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলী করছে মিয়ামারের সেনারা। এমনকি শিশুদেরও রেহাই দিচ্ছে না তারা।
তারা আরও অভিযোগ করেন, রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা করার পর সেনারা তাদের ঘরবাড়িতেও আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। রোববার মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে এসব অভিযোগের কথা তুলে ধরা হয়েছে।
এতে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের বরাতে বলা হয়, গত শুক্রবার ভোররাতে রাখাইনের কিছু পুলিশ চৌকিতে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (এআরএসএ) নামে একদল সশস্ত্র ব্যক্তি হামলা চালানোর পর থেকে এ পর্যন্ত একশ’র কাছাকাছি মানুষ নিহত হয়েছে।
শুক্রবারের ঘটনার পর মংডু, বুতিডং এবং রাতেডং জেলাকে ঘিরে ফেলে কথিত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এসব এলাকায় প্রায় আট লাখ মানুষ বসবাস করে। সেনাবাহিনী সেখানে সন্ধ্যা থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করেছে।
আল জাজিরা জানায়, রোহিঙ্গা অধিকার বিষয়ক কর্মীরা বলেছেন গত কয়েক দিনের সহিংসতায় নিহতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। তাদের দাবি, অন্তত আটশ’ রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে কয়েক ডজন নারী ও শিশুও রয়েছে।
তবে শুক্রবারের ভোর রাত থেকে শুরু হওয়া সংঘর্ষে এ পর্যন্ত মোট কতজন হতাহত হয়েছে তা স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি বলে প্রতিবেদনে জানিয়েছে আল জাজিরা।
মংডুর বাসিন্দা আজিজ খান বলেন, শুক্রবার সকালে তার গ্রামে অতর্কিত হানা দেয় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, তারা সাধারণের বাড়ি ও গাড়িকে লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে।
তিনি বলেন, সরকারি বাহিনী এবং সীমান্তরক্ষী পুলিশ আমার গ্রামের অন্তত ১১ জনকে হত্যা করেছে। তারা গ্রামে এসে সামনে যা কিছু পেয়েছে তার ওপর গুলীবর্ষণ করেছে। পরে কিছু সংখ্যক সেনা ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। নিহতদের মধ্যে নারী ও শিশুরাও রয়েছে উল্লেখ করে আজিজ খান বলেন, এমনকি একটি শিশুও হত্যাযজ্ঞ থেকে রেহাই পায়নি।
ইউরোপ নিবাসী রোহিঙ্গা অ্যাক্টিভিস্ট ও ব্লগার রো নে সান লুইন বলেন, সাম্প্রতিক হামলার সময় পাঁচ হাজার থেকে ১০ হাজার রোহিঙ্গাকে তাদের বাড়িঘর থেকে ধরে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।