এইচ এম সম্রাট, বান্দরবান: মিয়ানমারে চলছে বিশ্বের সবচেয়ে নীরবতম গণহত্যা। গণহত্যার প্রমাণ আড়াল করতে মিয়ানমার আর্মি লাশ পুড়ে এবং গুম করে ফেলছে। আকাশে কালো মেঘ দেখলেই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তাকিয়ে থাকে শিশুরা। আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়েন নারী ও বৃদ্ধারাও। তাদের মনে শঙ্কা আবারও কি তাদের গ্রামে নতুন করে নৃশংসতা শুরু হলো! এমন ভয়ে কুঁকড়ে যান বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্তে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারাও।
বৃহস্পতিবার থেকে তলোয়ার, চাপাতি ও আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত রাখাইন সন্ত্রাসীদের সঙ্গে নিয়ে মিয়ানমারের সেনা বাহিনী নিরস্ত্র অসহায় নারী ও শিশুসহ রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর হামলা অব্যাহত রেখেছে। জ্বালিয়ে দিচ্ছে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর।
মিয়ানমারে মৃত্যুর দুয়ার থেকে পালিয়ে এসে ঘুমধুম কোনা পাড়া এলাকার কলাবাগানে আশ্রয় নেয়া নারী রহিমা বেগম, খাদিজা বেগম, আব্দুল আলিম ও আবু সৈয়দ জানান, হাজার হাজার রোহিঙ্গা এখনও গৃহহীন অবস্থায় বাংলাদেশ সীমান্তে নদীতে নৌকার মধ্যে আটকে আছে। মিয়ানমার আর্মি ও রাখাইন যুবকরা রোহিঙ্গা পুরুষদের চোখ বেঁধে লাইনে দাঁড় করিয়ে তাদের পরিবারের সদস্যদের সামনে গুলি মেরে হত্যা করছে। অনেক পুরুষকে হাত পা কেটে হত্যা করে লাশ টুকরা টুকরা করা হচ্ছে । শিশুদের, এমনকি সদ্যজাত শিশুদেরও টুকরা টুকরা করো হত্যা করছে কিংবা জলাশয়ে ছুঁড়ে ফেলে হত্যা চলছে পুরো রাখাইন রাজ্য জুড়ে।
অপরদিকে মিয়ানমার আর্মি ও বৌদ্ধ রাখাইন যুবকরা মুসলিম তরুণী ও যুবতীসহ বিভিন্ন বয়সের নারীদের গণর্ধষণ করে হত্যা করছে।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা আরও জানিয়েছেন, তাদের ধর্ষণ থেকে কোনও মুসলিম নারী রেহাই পাচ্ছেন না।
তারা আরো জানান,আমরা যত টুকু খবর নিয়েছি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মুসলিম উধ্যুষিত এলাকা ঢেকুবনিয়া, বাজার পাড়া, কিয়াত্ত পাড়া, বলি পাড়া, উত্তর পাড়া, ফকিরা পাড়া ও গাইট্টা বুইন্ন্যা এলাকায় মিয়ানমার আর্মি ও রাখাইন যুবকরা গত বুধবার পর্যন্ত প্রায় আট শতাধিক রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছে। তারা বিশ্বের কাছে নিহতের সংখ্যা আড়াল করতে শত শত লাশ পুড়ে ফেলেছে এবং গাড়িতে করে নিয়ে গিয়ে গুম করে ফেলছে বলেও তারা জানান।
গত ৩০ আগস্ট ২০১৭ আমেরিকান হেরাল্ড ট্রিবিউনে প্রকাশিত মানবাধিকার ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক সিজে ওয়ের্লম্যান’র প্রতিবেদনে উঠে এসেছে জাতিসংঘ জেনেভা কনভেনশনে গণহত্যার সংজ্ঞায় বলা হয়, ‘যখন কোনো জাতি, নৃতাত্ত্বিক, বর্ণগত বা ধর্মীয় গোষ্ঠিকে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে শেষ করে দেয়ার জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে হামলা চালানো হয়।
গণহত্যার সংজ্ঞায় আরও বলা হয়, যখন কোনো জাতিগোষ্ঠির বিরুদ্ধে এমন পদক্ষেপ নেয়া হয় যাদেরকে নিয়মিতভাবে শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয়া হয়। ওই জনগোষ্ঠিতে শিশু জন্ম নিয়ন্ত্রণ করা হয়। জোর করে ওই জনগোষ্ঠির শিশুদেরকে অন্যত্র স্থানান্তর করা হয়।
এখন গণহত্যার সবগুলো সংজ্ঞা অনুযায়ী মিয়ানমার সরকার তার ১৩ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠির ওপর গণহত্যা চালাচ্ছে।
যদিও এটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পুরোপুরিভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে।
জাতিসংঘ অবশ্য মিয়ানমার সরকার কতৃর্ক রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নির্বিচার হত্যা, গুম, নির্যাতন, গণধর্ষণ, বেধড়ক পিটুনি, সম্পদ দখল ও জোর করে অন্যত্র পাঠিয়ে দেয়াসহ বিভিন্ন অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে বলে জানিয়েছে।
জাতিসংঘের ২০১৭ সালের একটি প্রতিবেদনে মিয়ানমার সরকারের এই পদক্ষেপগুলোকে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ হিসেবেও অভিহিত করেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে পশ্চিমা গণমাধ্যম ও নেতারা মিয়ানমার কর্তৃক রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর চালানো নিয়মতান্ত্রিক নিধন কেন যেন এড়িয়ে যাচ্ছেন।
রোহিঙ্গা গণহত্যা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার যাইদ রা’দ আল হুসেইন বলেন, ‘রোহিঙ্গা শিশুরা যে কঠিন নির্মমতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সেটা অবর্ণনীয়। এটা ঘৃণার কেমন রূপ যে মায়ের দুধ পানরত শিশুকে ছুরিবিদ্ধ করতে হয় এবং মাকে সেটা দেখতে হয়। আবার সেই নিরাপত্তা বাহিনীই তাকে গণধর্ষণ করে। অথচ যাদের দায়িত্ব ছিল তাকে রক্ষা করা।
রোহিঙ্গাদের ওপর রাষ্ট্রীয়ভাবে যে নিপীড়ন চালানো হচ্ছে, তার তুলনা হতে পারে শুধু আইএসের সঙ্গে। আইএস যেখানে বিশ্বব্যাপী শিরোনাম আকর্ষণ করছে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক চালানো একই নির্মমতা বড় আকারে অজানাই থেকে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ওপর যেসব নির্মমতা চালানো হয়েছে তার মধ্যে আছে একেবারে দুধের বাচ্চা থেকে শুরু করে বিভিন্ন শিশুদের ছুরি দিয়ে হত্যা করা, নারীদের গনর্ধষণ এবং তাদের খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া এমনকি পুরো গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া, লুটপাট চালানোর মতো কাজ।
ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে জাতিসংঘ যে ১০১ জন নারীর সাক্ষাৎকার নিয়েছে তাদের অর্ধেকেরও বেশি স্বীকার করেছেন, তারা মিয়ানমার আর্মি ও রাখাইন যুবক কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।