আজ ৩৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীপ্রতিকূলতা পেরিয়ে এগোচ্ছে বিএনপি

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপির ৩৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ। চার দিকে হতাশা, ােভ, না পাওয়ার বেদনা এবং শাসকযন্ত্রের প্রতি অতিষ্ঠ জনগণের মধ্যে স্বস্তি ও আশার সঞ্চার করে ১৯৭৮ সালের এই দিনে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরে জন্ম হয় দেশের অন্যতম বৃহৎ এই রাজনৈতিক দলটির। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় দলটি যেমন তিনবার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েছে, তেমনি সীমাহীন প্রতিকূল পরিস্থিতিও মোকাবেলা করেছে বহুবার।

২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত এক-এগারোর সরকারের আমল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১১ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি বেশ কঠিন সময় পার করছে। জরুরি সরকারের সময়ে দলটির ওপর যে মামলা, হামলা, জেল, জুলুম শুরু হয়েছিল তার ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। দলটির তথ্যানুযায়ী সহস্রাধিক নেতাকর্মী হত্যা, গুম ও খুনের শিকার হয়েছেন। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীরা মামলায় জর্জরিত। দল ভাঙনের চেষ্টা চলছে ক্রমাগত। এ রকম নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে সংগঠনকে গতিশীল রেখে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ জাতীয় নির্বাচনের পথ তৈরিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি।

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল প্রতিষ্ঠার আগে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠন করেছিলেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচন এগিয়ে এলে জিয়া বিএনপি গঠন করে এর সাথে জাগদলকে একীভূত করেন। রাষ্ট্রপতি জিয়া এই দলের সমন্বয়ক ছিলেন এবং প্রথম চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ছিলেন বিএনপির প্রথম মহাসচিব।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য এবং জনগণের মধ্যে স্বনির্ভরতার স্বপ্ন জাগিয়ে তোলাই ছিল জিয়াউর রহমানের মূলমন্ত্র। এর ফলে প্রতিষ্ঠার অল্প সময়ের মধ্যেই অভূতপূর্ব সাফল্য এসে ধরা দেয়। জিয়াউর রহমান স্বল্প সময়ের অকান্ত কর্মের মধ্য দিয়ে যেন ছড়িয়ে পড়েন পুরো বাংলাদেশে। জনগণ তাকে গ্রহণ করেন তৎকালীন সময়ের বিকল্প এক রাজনীতিবিদ হিসেবে। জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সাথে ইসলামি মূল্যবোধের মিশ্রণ তার দলকে আরো জনপ্রিয় করে তোলে। তার ঘোষিত ১৯ দফা দল ও সরকার পরিচালনার েেত্র এক ‘রাজনৈতিক দর্শন’ হিসেবেই আখ্যায়িত করা হয়। জিয়াউর রহমানের শাহাদতের কিছু পর স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিএনপির রাজনীতিতে উত্থান ঘটে বেগম খালেদা জিয়ার। সেই সময় থেকে বিএনপির নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনিই।

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশিবার রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল বিএনপি। ১৯৯০-এর গণতন্ত্রায়নের পর ২০০১ সাল পর্যন্ত দেশে মোট চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি তিনটিতেই জয়লাভ করে। ১৯৯১-এর নির্বাচনে বিএনপি ১৪২টি আসন লাভ করে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারি নির্বাচনেও বিএনপি জয়লাভ করে। তবে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে আন্দোলনমুখী হওয়ায় ৪৫ দিনের মাথায় বিএনপি সরকার একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে আবার নির্বাচন করার জন্য মতা তুলে দেয়। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-সহ চার দল প্রায় দুই- তৃতীয়াংশ আসনে জয়লাভ করে। তবে এক-এগারোর সরকারের দুই বছর পর ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে দলটির ভরাডুবি হয়। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনের নির্বাচনের দাবি আদায় না হওয়ায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে অংশ নেয়নি তারা।

দীর্ঘ ১১ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির নেতারা বলছেন, রাজনীতিতে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয়। এ পথে হেরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কৌশল পরিবর্তন করেই পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হয়। বিএনপিও এখন সেই কৌশল নিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নিরপে নির্বাচনের দাবিতে ২০১৪ ও ২০১৫ সালের আন্দোলন সফল না হওয়ায় বিএনপি তাদের কর্মকৌশল পরিবর্তন করে ধীরে চলা নীতি গ্রহণ করে। দল পুনর্গঠন ও গণসম্পৃক্ততার দিকেই নজর দেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।

গত বছরের ১৯ মার্চ ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে দলের নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করেন বেগম খালেদা জিয়া। এরপর পর্যায়ক্রমে জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দল, যুবদল, মহিলা দল, জাসাস, ঢাকা মহানগর উত্তর-দণি বিএনপি, চট্টগ্রাম মহানগরসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কমিটি পুনর্গঠনের মাধ্যমে দলকে নতুন আঙ্গিকে সাজাতে শুরু করে বিএনপি। জেলা কমিটিগুলোও থানা, পৌর ও ইউনিয়ন কমিটিগুলোকে ঢেলে সাজাচ্ছে। দায়িত্বশীল নেতারা বলেছেন, দল পুনর্গঠনের ৭৫-৮০ শতাংশ কাজ ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে।

তৃণমূল থেকে তথ্য নিয়ে দলের হাইকমান্ডের সমন্বয়ে দলটিকে বেশ কিছু পরিকল্পিত কর্মসূচি প্রণয়ন ও তার সফল বাস্তবায়নও করতে দেখা যায়। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরে- ‘বাজারে আগুন, জনজীবন বিপর্যস্ত’ শিরোনামে একটি পোস্টার দেশব্যাপী লাগানো। দেশে গণতন্ত্রহীন সংস্কৃতি, সরকারের অপশাসন ও অন্যায়-অত্যাচার তুলে ধরে বেগম খালেদা জিয়ার নাগরিক সচেতনতামূলক একটি গণচিঠি তৃণমূলপর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয় দলটি। ‘ভিশন-২০৩০’ তুলে ধরেন বেগম খালেদা জিয়া। এ ভিশনে ঘোষিত ২৫৬ দফা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। দলটি ভিশনের ১০ লাধিক কপি ইতোমধ্যেই দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছে। সম্প্রতি এক কোটি নতুন সদস্য সংগ্রহ কর্মসূচি হাতে নেয় বিএনপি। স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ কার্যক্রম চলছে। পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলের বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে বিএনপি। দলের মহাসচিবের নেতৃত্বে উত্তরাঞ্চলের প্রায় প্রতিটি থানা ও ইউনিয়নে ত্রাণতৎপরতা চালানো হচ্ছে।

দলের একাধিক নেতার সাথে আলাপকালে জানা যায়, বিএনপি তার একাধিক সার্ভে টিমের মাধ্যমে খোঁজখবর নিয়ে জনগণের দাবি ও মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করে চলছে। জনগণকে সাথে নিয়ে সরকারবিরোধী গণ-আন্দোলনে আবারো মাঠে নামার ল্য তাদের।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নয়া দিগন্তকে বলেন, সরকারের দমন-পীড়ন নতুন নয়। আগেও ছিল এখনো চলছে। প্রতিনিয়ত হামলা-মামলা চলছে। গোটা দেশকে বন্দিশালায় পরিণত করা হয়েছে। তারপরও আমাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চলছে। নেতাকর্মীরা নিজেদের মধ্যে বন্ধন অটুট রেখেছেন। সরকারের কোনো ফাঁদ বা উসকানিতে বিএনপি পা দেয়নি ভবিষ্যতেও দেবে না। আমরা জাতীয় কাউন্সিল করেছি। ইতোমধ্যে বহু জেলা কমিটি ও কয়েকটি অঙ্গসংগঠনের নতুন কমিটিও হয়েছে। তারপর আমাদের চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আগামী দিনে বাংলাদেশকে কিভাবে পরিচালিত করা হবে সে সম্পর্কে একটি রূপকল্প ‘ভিশন ২০৩০’ ঘোষণা করা হয়েছে, যা দেশের জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়েছে। এ সংক্রান্ত বই তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয় বিএনপি একটি আধুনিক ও উদারপন্থী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল।

ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনা এবারের লক্ষ্য : খালেদা জিয়া 

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এক বাণীতে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী, শুভানুধ্যায়ী এবং দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চা ও বিকাশসহ দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় বিএনপির বলিষ্ঠ ভূমিকা জনগণ কর্তৃক সমাদৃত হয়েছে। এই কারণেই বিএনপি দেশবাসীর কাছে এখন সর্বাধিক জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। জনগণের আস্থা ও বিশ^াস অক্ষুণœ রেখে দেশ ও জনগণের সেবায় বিএনপি আগামী দিনগুলোতেও বলিষ্ঠ ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

তিনি বলেন, আজ দেশে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে। ৫ জানুয়ারির তামাশার নির্বাচনের পর গণতন্ত্র এখন মৃতপ্রায়। দেশবিরোধী নানা চুক্তি ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বর্তমান সরকার জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে চলেছে। দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। দেশজুড়ে গণহত্যা, গুম, গুপ্তহত্যা, নারী ও শিশুদের ওপর পৈশাচিকতা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, নিপীড়ন ও নির্যাতনের মহোৎসব চলছে।

বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, জনগণের অধিকার আদায়ে এবং দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের ধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য বিএনপি জনগণকে সাথে নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। তাই এবার আমাদের আন্দোলনের লক্ষ্য হারানো ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনা এবং বাক-ব্যক্তি ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ জনগণের মানবিক মর্যাদা সুরক্ষা করা।

অপর এক বাণীতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশবাসীকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহবান জানান।

কর্মসূচি : প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচির মধ্যে রয়েছেÑ আজ সকাল ১০টায় দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদন ও ফাতেহা পাঠ এবং আগামী ৯ সেপ্টেম্বর আলোচনা সভা।

Check Also

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই তত্ত্বাবধায়ক সরকারে রূপান্তরিত হতে পারে : অ্যাটর্নি জেনারেল

র্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারে রূপান্তরিত হতে পারে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।