রাখাইনের পরিস্থিতি সত্যিকার অর্থেই ভয়াবহ: জাতিসংঘের বিশেষ দূত। বাংলাদেশে এসেছেন প্রায় ১ লাখ রোহিঙ্গা রাখাইনে নতুন ধরনের গণহত্যা শিরশ্ছেদ করা হচ্ছে, কেটে ফেলা হয়েছে অনেককে। রোহিঙ্গা-বিরোধী অভিযান বন্ধ করুন : মিয়ানমারকে ৫ মুসলিম দেশ

নিপীড়িত রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর আরও বীভৎস নির্যাতনের খবর পাওয়া গেছে। রোহিঙ্গাদের নিবাস সংঘাতময় রাখাইনের উপগ্রহ চিত্রে দেখা গেছে, বহু গ্রাম জ্বালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে।

রোহিঙ্গারা বলছেন, ‘গণহত্যার নতুন ধরন’ শুরু করেছে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী। রোহিঙ্গাদের শিরশ্ছেদ ও কেটে দ্বিখণ্ডিত করা হচ্ছে।

এদিকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতন-হামলা আর ধর্ষণের মুখে রাখাইন রাজ্য থেকে বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন ৯০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা।

জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা সোমবার এ তথ্য জানিয়েছেন। সীমান্তের নোম্যানস ল্যান্ডে এখনও হাজার হাজার রোহিঙ্গা খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছেন বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায়। খবর বিবিসি, রয়টার্স, এএফপি ও দ্য গার্ডিয়ানের।

রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বলছেন, দেশ ছাড়তে বাধ্য করতে সেনাবাহিনী তাদের বাড়িঘরে আগুন দিচ্ছে এবং নির্বিচারে হত্যা করছে। অন্যদিকে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ স্যাটেলাইটে তোলা ছবি এবং পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বক্তব্যের ভিত্তিতে বলেছে,  মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে।

মানবাধিকার সংস্থটির এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক ফিল রবার্টসন বলেন, ‘স্যাটেলাইটে তোলা নতুন ছবিতে একটি মুসলিম গ্রাম পুরো ধ্বংস হয়ে যেতে দেখা গেছে। এ থেকে সেখানকার পরিস্থিতি যতটুকু খারাপ বলে প্রথমে ধারণা করা হচ্ছিল তার চেয়েও বেশি শোচনীয় হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।’

প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে রয়টার্স বলছে, নিরাপত্তা বাহিনীর তথাকথিত ক্লিয়ান্সে অভিযানের মধ্যে গত এক সপ্তাহে রাখাইন রাজ্যের ২ হাজার ৬২৫টি বাড়ি জ্বালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে।

নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে মুসলিম নারী-পুরুষ ও শিশুদের হত্যাযজ্ঞে যোগ দিচ্ছে স্থানীয় সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা। অবশ্য মিয়ানমারের রাষ্ট্র পরিচালিত পত্রিকা ‘গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমার’-এর দাবি, অগ্নিসংযোগের পেছনে রয়েছে সশস্ত্র রোহিঙ্গা সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএস)। দেশটির সেনাপ্রধান বলেছেন, অভিযান অব্যাহত থাকবে, তার ভাষায় এটা ‘আনফিনিশড বিজনেস’।

এদিকে মিয়ানমারের মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোটিয়ার ইয়াংঘি লি বলেছেন, রাখাইনের পরিস্থিনি সত্যিই ভয়াবহ। এ ব্যাপারে সুচিকে হস্তক্ষেপ করতে হবে।

লি বলেন, এবারের ধ্বংসযজ্ঞ গত অক্টোবরের চেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ। তিনি বলেন, মিয়ানমারের নেতা সুচিকে তার দেশের প্রত্যেককে রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে।

মিয়ানমার সরকারের বরাত দিয়ে ১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উলে্লখ করা হয়, মিয়ানমারে সহিংসতা শুরুর পর গত এক সপ্তাহে ৪০০ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৩৭০ জন ‘রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী’, ১৩ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, দু’জন সরকারি কর্মকর্তা এবং ১৪ জন সাধারণ নাগরিক।

তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলা হচ্ছে, নিহতের সংখ্যা এর কয়েকগুণ। রাখাইনে কোনো বিদেশি সাংবাদিক ও দাতা সংস্থার প্রবেশাধিকার না থাকায় সেখানকার প্রকৃত চিত্র পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। চুত পাইন গ্রামের ২৭ বছর বয়সী সুলতান আহমেদ বলেন, ‘অনেক লোকের শিরশ্ছেদ করা হয়েছে, অনেককে কেটে ফেলা হয়েছে, পাশের গ্রামের সশস্ত্র লোকেরা যখন শিরশ্ছেদ করছিল তখন আমরা পালিয়েছিলাম।

মিয়ানমারে জাতিগত সহিংসতার শিকার হয়ে গত কয়েক দশকে বিভিন্ন সময়ে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন, যাদের একটি বড় অংশ উপকূলের বিভিন্ন ক্যাম্পে নিবন্ধিত বা অনিবন্ধিত শরণার্থী হিসেবে অবস্থান করছেন। এদের মধ্যে অনেকে আবার কক্সবাজার, পার্বত্য তিন জেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়েও পড়েছেন।

এ বিপুল রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে অবস্থানের মাঝেই গত বছরের অক্টোবরে আবার নতুন করে সহিংসতা দেখা দেয় বেৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে। তখন আরও প্রায় ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসেন।

এবার ২৫ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত ৯০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন। অর্থাত্ গত ১১ মাসে বাংলাদেশে প্রায় পেৌনে দুই লাখ রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছেন। প্রতিদিনই এ সংখ্যা বাড়ছে।

সীমান্তে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোরভাবে তৎপর রয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। প্রতিদিনই নেৌকায় বা সীমান্ত পথে আসা রোহিঙ্গা আটক করে পরে তাদের ফের নিজ দেশে পাঠাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করার সময় নেৌকাডুবে এখন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গা মারা গেছেন।

একদিনেই এসেছে ১৩ হাজার রোহিঙ্গা : বাংলাদেশে জাতিসংঘ শরণার্থী এক রাতের ব্যবধানেই টেকনাফে পালিয়ে আসা নতুন ১৩ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে চিহ্নিত করেছে।

অস্থায়ী আশ্রয়ের জন্য স্কুল-মাদ্রাসাগুলো খুলে দেয়া হয়েছে, কিন্তু সেগুলো এখন উপচে পড়ছে। জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর কর্মকর্তা ভিভিয়েন ট্যান বিবিসিকে বলেছেন, এক রাতের ব্যবধানেই তারা রোববার নতুন অন্তত ১৩ হাজার রোহিঙ্গাকে চিহ্নিত করেছেন।

তিনি বলেন, পুরনো যে দুটো রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির কুতুপালং এবং নয়াপাড়া তাতে আর তিলধারণের জায়গা নেই। স্থানীয় স্কুল-মাদ্রাসা ছাড়াও বিভিন্ন খোলা জায়গায় তঁাবু খাটিয়ে পালিয়ে আসা মানুষজনকে ঠঁাই দেয়ার চষ্টো চলছে।

কিন্তু বর্তমান হারে শরণার্থী আসতে থাকলে পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে পারে। ঈদের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আশ্রয়ের জন্য ব্যবহার করা এখন সম্ভব হলেও, ছুটি শেষে কি হবে তা নিয়ে ত্রাণ সংস্থাগুলো উদ্বিগ্ন। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বলছেন, আরও হাজার হাজার লোক বাংলাদেশ সীমান্তের পথে রয়েছেন।

বাংলাদেশে-মিয়ানমার সীমানে্তর নোম্যানস ল্যান্ডের কয়েকটি জায়গায় কয়েক হাজার রোহিঙ্গা অপেক্ষা করছেন। রেডক্রস কর্মকর্তা সেলিম আহমেদ বিবিসিকে বলেন, নোম্যানস ল্যান্ডে বসে থাকা রোহিঙ্গাদের অবস্থা সঙ্গিন, কারণ তাদের কোনো সাহায্য দেয়া যাচ্ছে না।

সীমানে্তর কাছে বিস্ফোরণ : বাংলাদেশ সীমানে্তর কাছে মিয়ানমারের অংশে সোমবার দুটো বিস্ফোরণ ঘটেছে। এ সময় গুলির শব্দ শোনা গেছে, উড়তে দেখা গেছে ঘন-কাল ধোঁয়া।

বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীরা জানিয়েছে, মিয়ানমারের প্রায় ৫০ মিটার ভেতরে ঘটা বিস্ফোরণে এক নারীর পা উড়ে গেছে। তাকে চিকিত্সার জন্য বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়েছে। সামবার মিয়ানমারের তাউং পায়ো গ্রামের কাছে বিস্ফোরণের আগে গুলির শব্দ শুনতে পাওয়া এবং আগুন দেখতে পাওয়ার কথাও জানিয়েছেন তারা। সীমান্তরক্ষীদের ধারণা, আহত নারী পাতা মাইনের ওপর পা দিয়েছিলেন। তবে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

রাখাইনে জাতিসংঘের ত্রাণ তত্পরতা স্থগিত : এদিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলা-নির্যাতন ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকার মুখে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে সহিংসতার শিকার রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে জরুরি খাদ্য সরবরাহ কর্মসূচি স্থগিত করেছে জাতিসংঘ।

২০১২ সাল থেকে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহযোগিতা দিয়ে আসছিল জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। এতে আড়াই লাখ মানুষের খাদ্যের সংস্থান হতো। কিন্তু এ কর্মসূচি স্থগিত করায় তাদের খাদ্য নিরাপত্তায় চরম অনিশ্চয়তা তৈরি হল।

শনিবার ডব্লিউএফপির এক বিবৃতিতে বলা হয়, রাখাইন রাজ্যে সহিংসতায় অভ্যন্তরীণভাবে গৃহহীন দুই লাখ ৫০ হাজার এবং অন্যান্য অতিদরিদ্র মানুষের মধ্যে যে খাবার সাহায্য দেয়া হতো, তা স্থগিত করা হল।

এদের মধ্যে রাখাইন রাজ্যেই বিভিন্ন ক্যাম্পে থাকা এক লাখ ২০ হাজার মানুষ ডব্লিউএফপির খাবারের ওপরই নির্ভর করত। এদের অধিকাংশই রোহিঙ্গা। যারা জীবন বাঁচিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন, তাদের অবস্থাও করুণ।

অনেককে শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় পেলেও খাবারের তীব্র সংকটের মধ্যে রয়েছেন। অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন স্থানীয় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। অনেক রোহিঙ্গা পরিবার মাথাগোঁজার ঠাঁই করতে উপকূলের পাশে বন-জঙ্গল সাফ করেবাঁশ-প্লাস্টিক দিয়ে ছাউনি তৈরির চষ্টো করছে।

জাতিসংঘ ছাড়াও আরও ১৬টি মানবিক সহায়তা প্রতিষ্ঠান মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ত্রাণ কার্যক্রমে অসহযোগিতা আর বাধা দেয়ার অভিযোগ তুলেছে।

দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কখনও ভিসা বন্ধ করে, কখনও সহায়তাকর্মীদের ফেরত পাঠিয়ে, কখনও বা স্থানীয় প্রশাসনের রক্তচক্ষুর মাধ্যমে ত্রাণ সরবরাহে বাধা দেয়া হচ্ছে।

অভিযান শুরুর পর বেসামরিকদের বিপন্নতার মধ্যেই ২ সেপ্টেম্বর রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে ত্রাণ সরবরাহ স্থগিত করার ঘোষণা দেয় জাতিসংঘ। নিরাপত্তাজনিত সংকটকে কারণ দেখিয়ে ত্রাণ সরবরাহ বন্ধের ঘোষণা দেয়া হয়।

তবে মিয়ানমারের জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধির কার্যালয় গার্ডিয়ানকে ইঙ্গিত দিয়েছে, মিয়ানমার সরকারই তাদের কাজ করার অনুমতি দিচ্ছে না।

জাতিসংঘ ছাড়াও অক্সফাম ও সেভ দ্য চিলড্রেনসহ বিশ্বের বড় বড় ১৬টি মানবিক সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠানও অভিযোগ করেছে মিয়ানমার সরকার তাদের সংঘাতপূর্ণ এলাকায় যেতে দিচ্ছে না।

 

রাখাইনের পরিস্থিতি সত্যিকার অর্থেই ভয়াবহ: জাতিসংঘের বিশেষ দূত

 

 রোহিঙ্গা মুসলিমদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির সমালোচনা করেছেন দেশটির মানবাধিকার বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লি।

তিনি বলেছেন, রাখাইনের পরিস্থিতি সত্যিকার অর্থেই ভয়াবহ। এ বিষয়ে সু চির পদক্ষেপ নেয়ার এখনই সময়।

জাতিসংঘের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে। বাড়িঘর ছেড়ে পালানো রোহিঙ্গার সংখ্যা ২০১৬ সালের অক্টোবরের সহিংসতার সময়কার তুলনায় অনেক বেশি। এ পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লি সু চির এ সমালোচনা করলেন।

গত বছরের অক্টোবরের পর গত ২৪ আগস্ট রাখাইনে আবার নতুন করে নিরাপত্তা বাহিনী ও মুসলিম বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়। এতে অন্তত ৮৯ জন নিহত হয় বলে মিয়ানমার সরকার জানায়।

ইয়াংহি লি বলেন, অক্টোবরের তুলনায় এবারের সহিংসতার মাত্রা ‘অনেক তীব্র’।

তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের নেত্রীর (সু চি) এগিয়ে আসা প্রয়োজন। নিজ দেশের সবাইকে রক্ষা করার বিষয়টি আমরা যেকোনো সরকারের কাছেই প্রত্যাশা করি।’:

 

 বাংলাদেশসহ এশিয়ার কয়েকটি মুসলিম দেশ মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান বন্ধ করতে দেশটির প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।

বাংলাদেশ, পাকিস্তান, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে এ আহ্বান জানিয়ে এই সংকটের দ্রুত নিষ্পত্তির দাবি জানানো হয়।

গতকাল সোমবার বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আগামী সোমবার মিয়ানমারের নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাৎ করবেন।

জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোটিয়ার ইয়াংগি লি এবং নোবেল বিজয়ী মালালা ইউসুফজাই উভয়েই মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির প্রতি এ সহিংসতার নিন্দা জানানোর আহবান জানিয়েছেন।

গত ১০ দিনে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সহিংসতার কারণে প্রায় ৯০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। প্রতি দিনই আরো হাজার হাজার শরণার্থী আসছে।

এ সংকটের ব্যাপারে ইতিমধ্যেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিক্রিয়া আসতে শুরু করেছে।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে , ‘রোহিঙ্গা মুসলিমদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান মৃত্যুর সংখ্যা এবং ব্যাপক ঘরবাড়ি ছেড়ে পালানোর খবরে’ উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।

মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নজিব রাজ্জাক এক টুইট বার্তায় ‘ মিয়ানমার এবং এ অঞ্চলের কল্যাণের স্বার্থে রোহিঙ্গা ভাই-বোনদের এই গুরুতর দুর্দশার অবসানের’ আহ্বান জানান।

দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মুসলিম দেশগুলো থেকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমদের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে।

ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেটনো মারসুডি মিয়ানমার সফর করছেন, এবং তিনি সেদেশের সামরিক বাহিনীর প্রধানের সাথে দেখা করে এ সংকট সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন। মি. রেটনো আজই পরে কোন এক সময় অং সান সুচির সাথে দেখা করবেন।

কয়েকটি দেশে বিক্ষোভ-প্রতিবাদের খবর পাওয়া গেছে।

রোববার ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তার মিয়ানমার দূতাবাস লক্ষ্য করে একটি ছোট পেট্রল বোমা ছোঁড়া হয়।

মালদ্বীপ বলছে, তারা মিয়ানমারের সাথে সবরকম অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে যাচ্ছে।

মধ্য এশিয়ার কিরগিস্তানে মিয়ানমার ফুটবল দলের সাথে একটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ বাতিল করা হয়েছে। কারণ কিছু সামাজিক মাধ্যমেই ম্যাচের সময় প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করার আহ্বান জানানো হয়েছিল।

রোহিঙ্গা বিরোধী অভিযান বন্ধ করুন॥ ৫ মুসলিম দেশ

রাখাইনে ত্রাণ কার্যক্রমে বাধা দিচ্ছে মিয়ানমার সরকার: জাতিসংঘ

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নির্যাতিত অসহায় ও গৃহহীন রোহিঙ্গা মুসিলমদের কাছে ত্রাণ পৌঁছাতে পারছে না জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো।

এতে বাধা দিচ্ছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীসহ দেশটির প্রশাসন। শীর্ষনিউজ।

অপরদিকে রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিম যুবকদের গুলী করে ও পুড়িয়ে হত্যা করছে দেশটির সেনারা। একই সাথে নারীদের ধর্ষণসহ নারী-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সবার ওপর হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে দেশটির সামরিক বাহিনী। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে একের পর ঘরবাড়ি। লুটে নেয়া হচ্ছে রোহিঙ্গাদের সব সহায়সম্বল। এছাড়া যারা সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের পর জীবনে রক্ষা পাচ্ছেন বা যারা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের কাছে কোনও ত্রাণ সহায়তাও পৌঁছাতে দেয়া হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে চরম দুর্বিষহ অবস্থায় পড়েছেন রাখাইনের রোহিঙ্গা মুসলিমরা।

জাতিসংঘ বলছে, রাষ্ট্রীয় বাধার কারণে সেখানে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ত্রাণ কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে। এ খবর দিয়েছে প্রভাবশালী ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান।

জাতিসংঘের বরাত দিয়ে গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমার সরকারের ভূমিকার কারণেই রাখাইনে সহায়তা কার্যক্রম স্থগিতে বাধ্য হয়েছে তারা। জাতিসংঘ ছাড়াও আরও ১৬টি মানবিক সহায়তা প্রতিষ্ঠান মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ত্রাণ কার্যক্রমে অসহযোগিতা আর বাধা দেয়ার অভিযোগ তুলেছে।

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, কখনও ভিসা বন্ধ করে, কখনও সহায়তাকর্মীদের ফেরত পাঠিয়ে, কখনওবা স্থানীয় প্রশাসনের রক্তচক্ষুর মাধ্যমে ত্রাণ সরবরাহে বাধা দেয়া হচ্ছে। এতে লাখ লাখ রোহিঙ্গার জীবন শঙ্কা দেখা দিয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে মানবিক সহায়তার আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো।

সাম্প্রতিক ক্লিয়ারেন্স অপারেশনের লক্ষ্যে রাখাইন রাজ্যে সেনা মোতায়েন শুরুর কয়েকদিনের মাথায় ২৪ আগস্ট পুলিশ চেকপোস্টে হামলা এবং বিদ্রোহী-পুলিশ-সেনাসদস্য মিলে অন্তত ১০৪ জন নিহত হয়েছে বলে জানায় সেনাসূত্র। এই হামলার দায় স্বীকার করে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ)।

ওই হামলার পর থেকে রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান জোরদার হয়। যদিও এর আগেই রাখাইনে সার্জিক্যাল অপারেশনের ঘোষণা দিয়েছিল মিয়ানমার সেনাবাহিনী। অভিযান শুরুর পর বেসামরিকদের বিপন্নতার মধ্যেই ২ সেপ্টেম্বর রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে ত্রাণ সরবরাহ স্থগিত করার ঘোষণা দেয় জাতিসংঘ। নিরাপত্তাজনিত সংকটকে কারণ দেখিয়ে ত্রাণ সরবরাহ বন্ধের ঘোষণা দেয়া হয়।

তবে মিয়ানমারের জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধির কার্যালয় গার্ডিয়ানকে ইঙ্গিত দিয়েছে, মিয়ানমার সরকারই তাদেরকে কাজ করার অনুমতি দিচ্ছে না।

হঠাৎ করে ত্রাণ সরবরাহ বন্ধের কারণ কী সে ব্যাপারে গার্ডিয়ানকে আবাসিক প্রতিনিধির কার্যালয় জানায়, ‘নিরাপত্তা পরিস্থিতি এবং মাঠ পর্যায়ের পরিদর্শনে সরকারের পক্ষ থেকে কড়াকড়ির কারণে আমরা সহায়তা দিতে পারিনি। যত দ্রুত সম্ভব যেন মানবিক সহায়তা কার্যক্রম শুরু করা যায় তা নিশ্চিত করতে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে যাচ্ছে জাতিসংঘ।’

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর), জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) এবং জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক তহবিল (ইউনিসেফ) এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে মাঠ পর্যায়ের কোনও কাজ করেনি।

জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) জানায়, রাখাইনের অন্য এলাকাগুলোতে তাদেরকে কার্যক্রম স্থগিত করতে হয়েছে। এতে নিয়মিত খাদ্য যোগাড় করতে না পারা কয়েক লাখ মানুষ অনিশ্চয়তায় পড়েছে।

জাতিসংঘ ছাড়াও অক্সফাম ও সেভ দ্য চিলড্রেনসহ বিশ্বের বড় বড় ১৬টি মানবিক সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠানও অভিযোগ করেছে মিয়ানমার সরকার তাদেরকে সংঘাতপূর্ণ এলাকায় যেতে দিচ্ছে না।

জাতিসংঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক সংস্থার মিয়ানমার কার্যালয়ের মুখপাত্র পিয়েরে পেরন বলেন, ‘চলমান সহিংসতায় লাখো মানুষের পরিণতি নিয়ে ত্রাণ সংগঠনগুলো গভীর উদ্বেগে আছে।’

গার্ডিয়ান বলেছে, ক্যাম্পে ক্যাম্পে গিয়ে ত্রাণ সরবরাহের জন্য মানবিক সহায়তা প্রতিষ্ঠানগুলো যাদের সঙ্গে চুক্তিবন্ধ, সেই কন্ট্রাকটররা তাদের কাজে অপারগতা জানাচ্ছেন। স্থানীয় প্রশাসনের ভয়ে তারা অস্বীকৃতি জানাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কন্ট্রাকটরদের ধারণা, তারা এই ত্রাণ সরবরাহে অসন্তুষ্ট হতে পারে।

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ারমার কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক সহায়তা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভিসা দিচ্ছে না। তাদের মধ্যে ইতোমধ্যেই যারা মিয়ানমারে অবস্থান করছেন তাদেরও কোনও কোনও ক্ষেত্রে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। বাসস্থান হারানো বেসামরিক মানুষের জন্য নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দরকার। তাদের অবিলম্বে খাবার, পানি, আবাস, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ধরনের মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেয়া অপরিহার্য।

জাতিসংঘের অফিস ফর দ্য কো-অর্ডিনেশন হিউম্যানটারিয়ান অ্যাফেয়ার্সের একজন মুখপাত্র গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘মানবিক সহায়তা তাদেরকেই দেয়া হয়, বিপন্ন অবস্থায় থাকা যে মানুষরা এর ওপর নির্ভরশীল। রাখাইনের সব সম্প্রদায়ের বিপন্ন এই বাস্তবতায় সেখানে স্থগিতকৃত ত্রাণ কার্যক্রম পুনরায় চালু করতে এখনই সব রকমের পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।’

এর আগে শুক্রবার ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এবং সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানের এক যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারে সাম্প্রতিক সেনা অভিযান শুরুর পর থেকে গেল এক সপ্তাহে উত্তর-পশ্চিম রাখাইন রাজ্যে ৪শজন নিহত হয়েছে। মিয়ানমারের ডি-ফ্যাক্টো সরকারের সেনাবাহিনী নিহত ৪শ জনের মধ্যে ৩৭০ জনকে সন্ত্রাসী বলে উল্লেখ করেছে।

 

Check Also

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হচ্ছেন খবরে আসামিপক্ষে শুনানি করেননি সমাজী

জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার সাবেক ৯ মন্ত্রীসহ ১৩ জনকে আন্তর্জাতিক …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।