আবু সাইদ বিশ্বাস সীমান্ত অঞ্চল থেকে: কুরবানীর পশুর চামড়া সীমান্ত দিয়ে প্রতিবেশী দেশে পাচার হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ট্যানারির মালিকরা সিন্ডিকেট করে চামড়ার কম মূল্য নির্ধারণ করায় এ আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ সুযোগে প্রতিবেশী দেশের ব্যবসায়ীরা সীমান্ত জেলাগুলোতে বিপুল অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করেছে। স্থানীয়ভাবে নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক বেশি দাম দিয়ে তারা চামড়া কিনেছে। এতে দেশী ব্যবসায়ীরা সংকটে পড়েছে। ফলে এবার কুরবানীর চামড়া দেশে ধরে রাখা কঠিন হবে। চামড়া পাচার রোধে ভোমরা ও বেনাপোল সীমান্তে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। সিন্ডিকেটের কবলে সাতক্ষীরা,যশোরসহ বিভিন্ন সীমান্তদিয়ে কুরবানীর পশুর চামড়া ভারতে পাচার হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সক্রিয় হয়ে উঠেছে দেশী-বিদেশী চামড়া পাচার সিন্ডিকেট। সীমান্তে কয়েক জন চামড়া ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়। গত সোমবার ভ্যান ভরে সীমান্তের দিকে চামড়া নিয়ে যেতে দেখা যায়। ক্যামেরায় ছবি তুলতে গেলে বাধার সম্মুখীন হতে হয়।
কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারো চতুমুর্খী সিন্ডিকেটের কবলে পড়েছে দেশের চামড়ার বাজার। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চামড়া ক্রয়কারী ক্ষুদ্র মৌসুমি ব্যবসায়ী এবং চামড়া থেকে প্রাপ্ত অর্থের ভাগিদার হতদরিদ্র মানুষ, এতিম ও মিসকিন। প্রতিবছর চামড়ার মোট চাহিদার সিংহভাগের জোগান আসে কোরবানি ঈদে। একই সঙ্গে দেশের হতদরিদ্র মানুষ, এতিম ও মিসকিনদের সারা বছরের অর্থের জোগানও আসে কোরবানীর ঈদের চামড়া থেকে প্রাপ্ত সহায়তার মাধ্যমে। বিপুল সংখ্যক মাদ্রাসা ছাত্র ঈদের চামড়ার টাকায় সারাবছর বিনা খরচে লেখা-পড়া করে। কিন্তু চতুমুর্খী সিন্ডিকেটের কারণে এসব মাদ্রাসা ছাত্র, এতিম ও মিসকিনরা তাদের ন্যয্য হক থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
ভারতীয় একাধিক ব্যবসায়ী বাংলাদেশি চামড়া কেনার জন্য কয়েক কোটি টাকা লগ্নি করেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। বিজিবি ও পুলিশের চেকপোস্ট এবং সীমান্তে কড়া নজরদারির কারণে চামড়া পাচার সাময়িকভাবে থমকে গেলেও পরিস্থিতি একটু শিথিল হলেই এসব চামড়া ভারতে পাচার হয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রতিবছর ঈদের সময় দেশি ব্যবসায়ীরা যে পরিমাণ চামড়া কিনতেন, এ বছর তার এক-তৃতীয়াংশও কিনতে পারেননি। পাইকারি চামড়া ব্যবসায়ীদের ধারণা, ভারতীয় ব্যবসায়ীদের অগ্রিম দাদনের কারণে তাঁরা চাহিদামতো চামড়া কিনতে পারেননি। সাতক্ষীরা সীমান্তের বিভিন্ন হাট ঘুরে ভারতে চামড়া পাচারের এ চিত্র লক্ষ করা গেছে।
শুধু সাতক্ষীরাতে এবছর ৫২ হাজার পশু কুরবাণি হয়েছে বলে সরকারী সূত্রে জানা গেছে। কুরবাণি কৃত এসব পশুর চামড়া গত চার দিনে চামড়ার মোকামে তেমন দেখা মেলেনি । এমনকি ঢাকাতেও বেশি যায় নি। সব মিলিয়ে অর্ধেকের বেশি চামড়া সীমান্ত এলাকাতে মজুদ আছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এখন কাঁচা চামড়ায় লবণ দিয়ে মজুদ করে রাখা হয়েছে। সুযোগ পেলেই এসব চামড়া ভারতে পাচার হয়ে যাবে। কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, পারুলিয়া হাট থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে ভারতীয় সীমান্ত। যার কারণে পারুলিয়া ও তার আশপাশের এলাকায় মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া কিনে মজুদ করে রেখেছেন। সীমান্তের পরিস্থিতি শিথিল হলেই এসব চামড়া ভারতে পাচার হবে।
সীমান্ত গ্রামবাসী সূত্রে জানা গেছে, ঈদুল আযহা উপলক্ষে বাজারের সব চাইতে হৃষ্টপুষ্ট রোগমুক্ত গরু, ছাগল, ভেড়া এবং মহিষ বাংলাদেশে কুরবানী দেয়া হয়। হৃষ্টপুষ্ট এসব পশুর চামড়া খুবই উন্নতমানের। সমগ্র বিশ্বের বাজারে বাংলাদেশের পশুর এ চামড়ার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। উন্নতমানের এই চামড়াগুলোর আন্তর্জাতিক বাজার দর তুলনামূলক অনেক বেশি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সীমান্তের চোরাচালানী সিন্ডিকেট সূত্রে জানা যায়, সুযোগ বুঝে কলারোয়ার কেড়াগাছির চারাবাড়ি ঘাট, কুটিবাড়ি ঘাট, রথখোলা ঘাট, গাড়াখালী ঘাট, দক্ষিণ ভাদিয়ালী ঘাট, চান্দা স্লুইচ গেট ঘাট, বড়ালী ঘাট, হিজলদী ভদ্রশাল ঘাট, হিজলদী শিশুতলা ঘাট, সুলতানপুর ঘাট, গোয়ালপাড়া ঘাট, চান্দুড়িয়া ঘাট দিয়ে মাড়োয়ারীদের অনেক এজেন্ট বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার মূল্য কমার ধোয়া তুলে প্রতি বর্গফুট চামড়ার মূল্য গত বছরের তুলনায় ২০ থেকে ৩০ টাকা কম নির্ধারণ করে। গত বছর খাসির চামড়ার প্রতি বর্গফুট ৫০ থেকে ৫৫ টাকা ও বকরি ৪০ থেকে ৪৫ টাকা ও মহিষের দর ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। এ বছর খাসির চামড়া ৩৫ থেকে ৪০ টাকা, ছাগলের চামড়া ২৫ থেকে ৩০ টাকা, মহিষের দর দেয়া হয়েছে প্রতি বর্গফুট ৩৫ থেকে ৪০ টাকা।
চামড়া পাচার প্রতিরোধে সাতক্ষীরার ২৩৮ কিলোমিটার সীমান্ত জুড়ে বিজিবি ও পুলিশসহ আইনশৃখংলা বাহিনীর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। ঈদুল আযহার পরে কোন চোরাকারবারী যাতে সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে ভারতে কোন পশুর চামড়া পাচার করতে না পারে সে জন্য সীমান্তে এই কঠোর নজরদারী করা হয়েছে। পাশাপাশি সীমান্ত জুড়ে রয়েছে গোয়েন্দা নজরদারী।
ট্যানারী মালিকদের নির্ধারন করা মূল্যে পশুর চামড়া বিক্রি করতে না পেরে কোন চোরাচালানী যাতে প্রতিবেশী দেশ ভারতে চামড়া পাচার করতে না পারে সে জন্য এই টহল জোরদার করা হয়েছে। কোরবানির পর চোরাকারবারীরা অসৎ উদ্দেশ্যে প্রচুর পরিমাণ পশুর চামড়া অবৈধভাবে পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে পাচার করে থাকে। এ জন্য চামড়া পাচার রোধে বিজিবির পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ন স্থানে পুলিশ চেকপোস্ট বসানোসহ গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করেছেন পুলিশ প্রশাসন।
তবে, চামড়া ব্যবসায়ীদের অভিযোগ ট্যানারীর মালিক ও সরকারের নির্ধারন করা মুল্যে তাদের চামড়া কিনতে হচ্ছে যার কারনে লাভের পরিমানটা তাদের কম হবে।
সাতক্ষীরা ৩৮ বিজিবি’র ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর মোঃ আমিনুর রহমান জানান, সাতক্ষীরায় সীমান্ত দিয়ে যাতে কোন চোরাচালানী ভারতে চামড়াসহ কোন ধরনের চোরাচালানী পন্য পাচার না করতে পারে সেজন্য সমগ্র সীমান্ত এলাকাজুড়ে বিজিবি বিশেষ সতর্কাবস্থাসহ গোয়েন্দা নজরদারীতে রয়েছে। তিনি আরো জানান, সীমান্ত দিয়ে যে কোনো ধরনের পাচার ও জঙ্গি-সন্ত্রাস প্রতিরোধে বিজিবি সর্বদা প্রস্তুত রয়েছে।
সাতক্ষীরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মেরিনা আক্তার জানান, সাতক্ষীরা একটি সীমান্তবর্তী জেলা। এখান থেকে যাতে কোন চোরাচালানী চামড়া পাচার না করতে পারে সেজন্য বিজিবির পাশাপাশি পুলিশের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। তিনি আরো জানান, আগামী ৭ দিন যাবত এই নিরাপত্তা জোরদার থাকবে।—আবু সাইদ বিশ্বাসঃসাতক্ষীরা