রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে জাতিসংঘ ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়

রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ। সংস্থাটি বলছে, মিয়ানমারের রাখাইনে নিপীড়ন থেকে জীবন বাঁচাতে অন্তত ৩ লাখ রোহিঙ্গা  বাংলাদেশ আসতে পারেন। এই সংখ্যা প্রাথমিক ধারণার চেয়ে অনেক বেশি। যেভাবে দলে দলে রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসছে তাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়ে সংকট মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নিতে পারে বলে সতর্ক করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির কর্মকর্তারা বলছেন, যেভাবে শরণার্থী বাড়ছে তাতে শিগগিরই আশ্রয়ের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সংকট তৈরি হতে পারে। এদিকে বৃহস্পতিবার মিয়ানমার সরকার দুই ডজনের মতো সাংবাদিককে অবরুদ্ধ ও সংঘাতময় রাখাইন রাজ্যের কয়েকটি গ্রাম পরিদর্শনের সুযোগ দেয়। সফরের পর বিদেশি সাংবাদিকরা বলেছেন, পুলিশ প্রহরায় গিয়েও তারা যা দেখেছেন তা সরকারি ভাষ্যের বিপরীত।

অভুক্ত ও ক্ষুধার্ত রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুদের জন্য খাদ্য দরকার। আগামী চার মাসে উচ্চ পুষ্টির বিস্কুট ও চালের জন্য ১ কোটি ৩৩ লাখ ডলার প্রয়োজন বলে জানিয়েছে সংস্থাটির বাংলাদেশের মুখপাত্র। এরই মধ্যে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এদের  ঘিরে তৈরি হয়েছে বাসস্থান, খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। স্থানীয় জনগণ বিভিন্নভাবে এদের খাবার দিয়ে সহায়তা করছেন। তারপরও অনেকেই অভুক্ত আছেন।

এদিকে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন বন্ধে মিয়ানমার সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা সংকটে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কানাডা রোহিঙ্গা নিপীড়ন বন্ধে অং সান সুচির ব্যর্থতার সমালোচনা করেছে। মুসলিম বিশ্বও এ ইস্যুতে সোচ্চার হয়েছে। তবে সুচি বৃহস্পতিবার ফের দাবি করেছেন, রাখাইনের সবাই নিরাপদে আছে। তবে তিনি রাখাইন রাজ্যে নির্যাতনের শিকার সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিষয়ে কিছুই বলেননি। তিনি বলেছেন, রাতারাতি রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান সম্ভব নয়। সুচি সরকারের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের কোনো প্রমাণ বা কাগজপত্র না থাকলে তাদের আর ফিরিয়ে নেয়া হবে না।

বাংলাদেশে আসতে পারে তিন লাখ রোহিঙ্গা- জাতিসংঘ : মিয়ানমারের রাখাইনে সেনা দমন অভিযানের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা তিন লাখে পৌঁছাতে পারে বলে ধারণা করছেন জাতিসংঘ কর্মকর্তারা। কক্সবাজারে কর্মরত জাতিসংঘের কর্মীরা বলছেন, কত রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে পালিয়েছেন কিংবা বাংলাদেশে এসেছেন তা বলা কঠিন। তবে জাতিসংঘের হাতে নিশ্চিত যে তথ্য আছে তাতে বলা হয়েছে, ইতিমধ্যেই অন্তত ১ লাখ ৪৬ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশ ঢুকেছেন।

অবশ্য স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, ইতিমধ্যেই এই সংখ্যা আড়াই লাখ পার হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস সতর্ক করে বলেছেন, যেভাবে দলে দলে রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসছে তাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়ে সংকট মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নিতে পারে।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির বাংলাদেশ মুখপাত্র দীপায়ন ভট্টাচার্য বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, জাতিসংঘ কর্মকর্তারা প্রাথমিকভাবে ধারণা করেছিলেন এক লাখ ২০ হাজার শরণার্থী বাংলাদেশে আসতে পারে। এখন তারা মনে করছেন এ সংখ্যা তিন লাখে পৌঁছাতে পারে।

তিনি বলেন, তারা আসছে অপুষ্টির শিকার হয়ে, সম্ভবত এক মাসেরও বেশি সময় তারা প্রয়োজনমতো খাবার পায়নি। তাদের ক্ষুধার্ত ও ভীতসন্ত্রস্ত দেখাচ্ছে। শরণার্থীরা নৌকা ছাড়াও স্থলসীমান্তের অনেক জায়গা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে বলে জানান দীপায়ন। কর্মকর্তারা বলছেন, জীবনভয়ে পালিয়ে আসা গুরুতর আহত মানুষ, খাদ্যহীন-আশ্রয়হীন নারী-শিশু-বৃদ্ধরা এভাবে আসতে থাকলে পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। যেভাবে শরণার্থী বাড়ছে তাতে শিগগিরই আশ্রয়ের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সংকট তৈরি হতে পারে।

দীপায়ন বলেন, আগামী চার মাসে উচ্চ পুষ্টির বিস্কুট ও চালের জন্য ১ কোটি ৩৩ লাখ ডলার প্রয়োজন। তিনি দাতাদের এই অর্থ দ্রুত দেয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন,  দাতারা অর্থ না দিলে ক্ষুধার্ত লোকগুলো অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে। এর শিকার হতে পারেন নারী ও শিশুরা।

জাতিসংঘের আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, কত শরণার্থী এসেছে তা বলাটা ‘কঠিন বিজ্ঞান’। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, রাখাইনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর কথিত ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ চলছে। বিশৃঙ্খল সেই রাজ্যে প্রবেশ করতে পারে না কোনো সাহায্যকর্মী কিংবা সাংবাদিক।  তাছাড়া এই বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর ন্যূনতম চাহিদা পূরণে হিমশিম খাচ্ছে ত্রাণ সংস্থাগুলোও। ফলে বড় একটি মানবিক বিপর্যয়ের মুখেই দাঁড়িয়ে আছে অসহায় এ রোহিঙ্গারা।

এদিকে জাতিসংঘের মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন দুজারিক বুধবার নিউইয়র্কে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকট ইস্যুটি ব্যাপক গুরুত্বের সঙ্গে নেয়ার কারণে সংস্থার মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস নিরাপত্তা পরিষদের কাছে বিরল এক চিঠি লিখেছেন। এখন দেখার বিষয় পরিষদ কী করে।

রাতারাতি সমাধান সম্ভব নয়- সুচি : মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী অং সান সুচি বলেছেন, রাতারাতি  রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান সম্ভব নয়। তিনি ফের দাবি করেছেন, তার সরকার সংঘাতময় রাখাইন রাজ্যের প্রত্যেক নাগরিককে রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার ‘এশিয়ান নিউজ ইন্টারন্যাশনাল’র সঙ্গে আলাপকালে এ মন্তব্য করেন সুচি।

মিয়ানমারে মোট ১১ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস, যারা দীর্ঘদিন ধরে বৌদ্ধপ্রধান মিয়ানমারে জাতিগত নিপীড়নের শিকার। রোহিঙ্গা নির্যাতনের ঘটনায় পশ্চিমা পর্যবেক্ষকদের অনেকেই ১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সুচির কঠোর সমালোচনা করেছেন। এমনকি অনেকে তার নোবেল পুরস্কার কেড়ে নেয়ার কথাও বলেছেন। তাদের কথা, সুচি রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন।

সুচি বলেন, ‘আমাদের নাগরিকদের রক্ষা করতে হবে। আমাদের সবাইকে রক্ষা করতে হবে, যারা আমাদের দেশে আছে, এমনকি তারা আমাদের নাগরিক না হলেও।’

এর আগে ইয়াংগুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকে সুচি বলেন, ‘অবশ্যই আমাদের সম্পদ যথাযথ নয় এবং পর্যাপ্তও নয়। কিন্তু আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের এটা নিশ্চিত করতে হবে, প্রত্যেকে আইনের সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারী।’

দেড় বছর আগে ক্ষমতা গ্রহণের দিকে ইঙ্গিত করে সুচি বলেন, মাত্র ১৮ মাসেই এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে ভাবাটা যৌক্তিক নয়। কারণ উপনিবেশ-পূর্ববর্তী সময় থেকেই কয়েক যুগ ধরে এই সংকট চলে আসছে। ভারতে রোহিঙ্গাদের থাকা-না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, এটা আসলে তাদের ব্যাপার যে তারা কিভাবে সন্ত্রাসী ও সাধারণ মানুষদের আলাদা করবে। ভারত এ বিষয়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

নাগরিকত্বের প্রমাণ চায় মিয়ানমার : নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের কোনো প্রমাণ বা কাগজপত্র না থাকলে তাদের আর ফিরিয়ে নেবে না মিয়ানমার। দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। উপদেষ্টা ইউ থাং টুন বলেছেন, যাদের নাগরিকত্বের প্রমাণ নেই তাদের ফিরিয়ে নেয়া হবে না। কারণ এটা অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে, তারা বহু বছর ধরে মিয়ানমারে বাস করেন। যদি এটি সত্য প্রমাণিত হয় তারা ফিরে আসতে পারবেন। বুধবার রাতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা জানিয়েছেন। তবে মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের সেদেশের নাগরিক বলে স্বীকার করে না। কয়েক শতাব্দী ধরে রোাহিঙ্গারা মিয়ানমারে থাকলেও দেশটির কর্তৃপক্ষ তাদের অবৈধভাবে যাওয়া বাঙালি বলে দাবি করেন। এ কারণে তাদের নাগরিক সনদপত্র দেয়া হয় না।

টুন দেশের নাগরিকদের আশ্বাস দিয়ে বলেন, আপনাদের নিরাপত্তার কোনো বিঘ্ন হবে না। সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে। তিনি দাবি করেন, এমন অনেক মুসলিম আছেন যারা বলেছেন তারা রাখাইনে হামলার শিকার নন।

কন্টাক্ট গ্রুপ গঠন করবে ওআইসি : মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চলমান গণহত্যার সমাপ্তি ঘটাতে ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) একটি কন্টাক্ট গ্রুপ গঠন করবে। ইরানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এ কথা জানিয়েছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত গোলাম আলী খসরু। তিনি বলেন, ‘কয়েকদিন ধরে আমি মুসলিম দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি।’ মুসলিম দেশের কন্টাক্ট গ্রুপ নামে একটি গ্রুপ গঠনে তারা সম্মত হয়েছে বলেও জানান তিনি। মন্ত্রী এবং রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে এ গ্রুপ গঠন করা হবে বলে জানান খসরু। এরই মধ্যে রোহিঙ্গা সংঘাতে জড়িত পক্ষগুলোর সঙ্গে পৃথকভাবে ইসলামী দেশগুলো যোগাযোগ শুরু করেছে বলেও জানান তিনি।

রোহিঙ্গাদের সহায়তায় মিয়ানমারে পৌঁছেছে তুর্কি জাহাজ : রোহিঙ্গাদের সহায়তায় মিয়ানমার পৌঁছেছে পণ্যবাহী তুরস্কের জাহাজ। বুধবার ১ হাজার টন চাল, শুকনা মাছ ও কাপড় নিয়ে মিয়ানমারে পৌঁছে জাহাজটি। রাখাইন রাজ্যের সমাজসেবা মন্ত্রণালয়কে এ ত্রাণগুলো তুলে দেয় তারা। সামরিক হেলিকপ্টারের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে এই ত্রাণ পৌঁছে দেয়া হবে।

তুর্কি কো-অপারেশন অ্যান্ড কো-অর্ডিনেশন এজেন্সির বরাত দিয়ে দেশটির বার্তা সংস্থা আনাদোলু জানায়, মঙ্গলবার রাখাইন রাজ্যে ত্রাণ সরবরাহে অনুমতি দেয়া হয় বলে জানান তুরস্কের প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র ইব্রাহিম কালিন।

এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচির সঙ্গে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোগানের ফোনালাপের পর এই অনুমতি পাওয়া যায়। এতে করে সেখানে প্রথম বিদেশি সহায়তা পৌঁছে দিয়েছে তুরস্ক। এরদোগান বলেছেন, তুরস্ক ১০ হাজার টন ত্রাণ সহায়তা দেবে  রোহিঙ্গাদের।

Check Also

ঢাকা প্রসঙ্গে বদলাতে পারে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি

পাঁচ দশকের বিরতির পর গত মাসে বাংলাদেশের বন্দর নগরী চট্টগ্রামে একটি পাকিস্তানি পণ্যবাহী জাহাজ ডক …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।