খাদ্যে উদ্বৃত্ত জেলা নওগাঁ। দেশের বড় ধান-চালের মোকাম এটি। জেলার ১১টি উপজেলায় এক হাজার ১৬৭টি চালকল রয়েছে। প্রতি বছর এ জেলা থেকে প্রায় ১৬ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হয়ে থাকে। কৃষি প্রধান জেলা হওয়ার সত্ত্বেও চালের দাম দিন দিন বেড়েই চলছে। চালের দাম বৃদ্ধিতে ভারতের সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন জেলা চালকল মালিকরা। আগামীতে চালের দাম আরও বাড়বে পাবে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।
ঈদের পর পাইকারী ও খুচরা বাজারে সব ধরনের চালের দাম ফের বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিকেজি নাজিরশাইল পূর্বে ছিল ৫৪-৫৫ টাকা, বর্তমানে ৫৮-৬০ টাকা, বিআর-২৮ পূর্বে ছিল ৪৫-৪৬ টাকা, বর্তমানে ৫০-৫২ টাকা, জিরাশাইল পূর্বে ছিল ৫০-৫২ টাকা, বর্তমানে ৫৫-৫৬ টাকা, পারিজা পূর্বে ছিল ৪০-৪২ টাকা, বর্তমানে ৪৪-৪৬ টাকা, স্বর্ণা পূর্বে ছিল ৩৫-৩৬ টাকা, বর্তমানে ৪০-৪২ টাকা, এলসি পূর্বে ছিল ৪০-৪২ টাকা, বর্তমানে ৪৪-৪৬ টাকা বিক্রি করা হয়েছে। গত ১৩ দিনে প্রতিকেজি চালের দাম ৩-৫ টাকা এবং ৫০ কেজি ওজনের বস্তা প্রতি ১৫০-২০০ টাকা দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।
সরকার চাল আমদানিকে উৎসাহিত করার জন্য ২৮ শতাংশ শুল্ক থেকে কমিয়ে ২ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। এছাড়া বাকিতে ঋণপত্র খোলার সুযোগ দেয়া হলেও সরকারিভাবে আমদানির প্রভাব চালের বাজারে পড়ছে না। এসব পদক্ষেপ সত্ত্বেও গত দেড় মাসের ব্যবধানে নওগাঁয় প্রতিকেজিতে গড় ৫-৭ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে নাভিশ্বাস উঠেছে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষদের।
চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিগত ইরি-বোরো মৌসুমে বন্যা এবং রোগ বালাইয়ের কারণে সারাদেশে প্রতিবিঘা জমিতে ধানের উৎপাদন কম হয়েছে। সর্ব সাকুল্যে ইরি-বোরো মৌসুমে প্রায় ৫০-৬০ লাখ মেট্রিক টন ধানের উৎপাদন কম হয়েছে। পরবর্তীতে কৃষকরা বুক ভার আশা নিয়ে আমনের আবাদ শুরু করলে পর পর দুবার বন্যায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে দেশে ধানের সঙ্কট সৃষ্টি হয়। এতে বেশিরভাগই চালকল এখন বন্ধ হয়ে পড়েছে ধানের অভাবে।
রিকশাচালক সাইফুল ইসলাম জানান, তিনি নওগাঁ শহরের চকদেবপাড়ায় ভাড়ায় বাসায় থাকেন। সারাদিন রিকশা চালিয়ে ২৫০-৩০০ টাকা আয় করেন। বাজারে চালের দাম বেড়েছে। এছাড়া কাঁচা বাজারে সবজির দামও অস্থির। প্রতিদিন চাল ও তরকারি কিনতেই টাকা শেষ হয়ে যায়। মাছ বাজারে যাওয়াই যায় না। মাস শেষে টানাপোড়েনে পড়তে হয়। চালের বাজার মনিটরিংসহ দাম কমানোর জন্য সরকারে সুদৃষ্টি কামনা করেন তিনি।
দিনমজুর সুফিজান বলেন, ১৫ দিন আগে যে চাল ৩৮ টাকায় কিনেছি। এখন সেটা ৪৫ টাকায় কিনতে হচ্ছে। দিন আনা দিন খাওয়া আমাদের মতো মানুষদের চালের টাকা সংগ্রহ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এছাড়া বেশ কিছু দিন থেকে ওএমএস বন্ধ আছে। সেখান থেকে স্বল্প দামে চাল ও আটা কিনতে পারতাম। ওএমএস চালু করলে আমাদের মতো খেটে খাওয়া মানুষদের সুবিধা হতো।
পৌর ক্ষুদ্র চাউল ব্যবসায়ী সমিতি সাধারণ সম্পাদক উত্তম সরকার বলেন, হাওর অঞ্চলে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আগেই দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। এখন কৃষকের ঘরে ও হাটে বাজারে ধান নাই। ধান ব্যবসায়ীরা হাটে গিয়ে ধান পাচ্ছেন না। যে এলসির চাল আমদানি করা হয়েছে তা মানসম্পন্ন না। দামও বেশি। ফলে দফায় দফায় চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।
নওগাঁ জেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, সরকার আমদানিকে উৎসাহিত করার জন্য ২৮ শতাংশ শুল্ক থেকে কমিয়ে ২ শতাংশে নিয়ে আসছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য সরকার দেশে শুল্ক প্রত্যাহর করলেও প্রতিবেশী দেশ ভারত চালের দাম বৃদ্ধি করে। চালের আমদানি বৃদ্ধি পাওয়ায় চালের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সমস্যা থেকে উত্তোরনের জন্য একটাই উপায় ভারতকে চালের দাম কমাতে হবে। এছাড়া এ থেকে প্রতিকার পাওয়া সম্ভব নয়।
তিনি আরও বলেন, আগামীতে যদি ইরি-বোরো মৌসুমে শতভাগ ফসল উৎপাদন হয় তাহলে বাজার স্থিতিশীল হবে। অন্যথায় বাজার নিন্ত্রয়ণ হওয়ার সম্ভবনা খুবই ক্ষীণ। মূল সমস্যা হচ্ছে- ভারত দফায় দফায় চালের দাম বৃদ্ধি করছে। চালের বাজার ভারতের হাতে। তারাই এটি নিয়ন্ত্রণ করছে। ভারত যেভাবে চালের দাম রাখছে, আমাদের এখানে সেভাবেই চালের বাজার বহাল থাকবে।
নওগাঁর জেলা প্রশাসক ড. মো. আমিনুর রহমান বলেন, নওগাঁ খাদ্য উৎপাদন উদ্বৃত্ত জেলা। বন্যার কারণে এ জেলায় প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর ফসলের ক্ষতি হয়। বর্তমানে চালের দাম কিছুটা বেড়েছে। তবে বাজার স্থিতিশীল রাখতে মোবাইল কোর্ট এবং মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করেছি। আশা করছি শিগগিরই চালের দাম বৃদ্ধির কারণটা উৎঘাটন করতে পারব।