বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমারে দুই নারীসহ ১৭ জন রোহিঙ্গা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাদের একজন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন। শুধু এমপি-মন্ত্রীই নন,মিয়ানমার সরকারের সচিবসহ শীর্ষ বিভিন্ন পদেও ছিলেন রোহিঙ্গারা। ১৯৯০ সালের নির্বাচনেও সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের চার জন প্রতিনিধি ছিলেন দেশটির পার্লামেন্টে। ১৯৯২ সালে রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। এরপর থেকে আর কোনও নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি তারা। গত মঙ্গলবার (১২ সেপ্টেম্বর) জাতীয় সংসদে এই তথ্য জানান চাঁদপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। রোহিঙ্গা শরণার্থী বিষয়ে সংসদে প্রস্তাব উত্থাপনকালে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রস্তাব উত্থাপনের পর নিজের বক্তব্যে দীপু মনি বলেন, ‘১৯৪৮ সালে বার্মার স্বাধীনতার ঠিক পূর্বমুহূর্তে ১৯৪৭ সালের নির্বাচনে এম এ গাফ্ফার এবং সুলতান আহমেদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৫১ সালে সাধারণ নির্বাচনে পাঁচ জন রোহিঙ্গা তৎকালীন বার্মার পার্লামেন্টে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন জুরা বেগম। তৎকালীন বার্মার নির্বাচিত প্রথম দুইজন নারীর একজন হলেন এই জুরা বেগম। ছয়জন এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন ১৯৫৬ সালের সাধারণ নির্বাচন ও পরবর্তী যেসব উপনির্বাচন হয়েছিল তাতে। দেশটিতে ১৯৯০ সালে যে সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল, তাতে রোহিঙ্গাদের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি ফর হিউম্যান রাইট চারটি আসনে জয়ী হয়। ওই চারজন এমপি হলেন, সামসুল আনোয়ারুল হক, ইব্রাহিম, ফজল আহমেদ ও নূর আহমেদ। দীপু মনি বলেন, ‘সুলতান মাহমুদ একজন রোহিঙ্গা রাজনীতিবিদ। তিনি বার্মা সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বও পালন করেছেন।’ দীপু মনি বলেন, তিনি মনে করেন ১৯৮২ সালে প্রণীত নাগরিকত্ব আইন দিয়ে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের সব অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়।
দীপু মনি আরও বলেন, এ জনগোষ্ঠীর সদস্যরা বার্মার সংসদ নির্বাচিত সদস্য, তাদের সরকারে মন্ত্রী, সংসদীয় সচিবসহ আরও বহু সরকারি উচ্চপদে আসীন ছিলেন। বার্মার সামরিক শাসকেরা ১৯৬২ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে রোহিঙ্গাদের তাদের সব রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়।
দীপু মনি তার ব্ক্তব্যে মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের প্রধান নোবেলবিজয়ী অং সান সু চির সমালোচনা করে বলেন, ‘নোবেল বক্তৃতায় সু চি বলেছিলেন, “আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া উচিত এমন একটি পৃথিবী গড়ে তোলা, যা হবে বাস্তুচ্যুত, গৃহহীন ও আশাহত মানুষমুক্ত। একটি পৃথিবী যার প্রতিটি কোণ হবে সত্যিকারের অভয়াশ্রম।যেখানে বসবাসকারীদের থাকবে স্বাধীনতা এবং শান্তিতে বসবাস করবার সক্ষমতা।”’
মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের বাঙালি অনুপ্রবেশকারী বা বাঙালি সন্ত্রাসী বলায় দীপু মনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ইতিহাস তা বলে না।’ একাধিক পুরনো রেফারেন্স উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, ‘তারা দীর্ঘকাল ধরে আরাকানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। অষ্টম শতাব্দী থেকেই এই জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব সম্পর্কে ইতিহাস পাওয়া যায়।’
সম্প্রতি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর অব্যাহত নির্যাতন চরম আকার ধারণ করেছে। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ৩ লাখ ৭৯ হাজার মানুষ বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। সবমিলিয়ে এখন শরণার্থীর সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়ানোর আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিয়ে নাগরিকত্ব অধিকার দিয়ে নিরাপদে বসবাসের ব্যবস্থা গ্রহণে মিয়ানমার সরকারের ওপর জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের জোরালো কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানিয়ে প্রস্তাব পাস হয় বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে।