জিম্মি অর্থনীতি চলছে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের ঘিরে। তাদের সঙ্গে নিয়ে আসা কিয়াত (মিয়ানমারের স্থানীয় মুদ্রা) ও স্বর্ণ রেখে নামমাত্র টাকা তুলে দেয়া হচ্ছে। এক লাখ কিয়াতের বিনিময়ে দিচ্ছে ১ হাজার থেকে ২ হাজার টাকা। রোহিঙ্গাদের দুর্দশাকে কাজে লাগিয়ে কক্সবাজারের একশ্রেণীর দালাল জিম্মি অর্থনীতির নেপথ্যে কাজ করছে। এ চক্র মুদ্রা সংগ্রহ করে চোরাকারবারিদের কাছে বিক্রি করছে। উখিয়ার কুতুপালং ও ঘুমদুম অস্থায়ী রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা পরিবার ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের ঢল বাংলাদেশে আসতে শুরু করলে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় অনেক দালালচক্র সক্রিয় হয়ে উঠে। নৌকা ভাড়া করে মিয়ানমার থেকে রেহিঙ্গাদের বাংলাদেশে নিয়ে আসা, যানবাহন ভাড়া করে দেয়া, বিভিন্ন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া, বসবাসের জন্য জমির ব্যবস্থা করা, রোহিঙ্গা নারীদের স্বর্ণালংকার ও জিনিসপত্র বিক্রি করে দেয়া, কম মুল্যে মিয়ানমারের মুদ্রা ‘কিয়াত’ কেনাবেচা করছে এ চক্র। পুলিশি অভিযান, গ্রেফতার ও বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং করেও দমানো যাচ্ছে না দালাল চক্রকে।
মূলত মিয়ানমারের মুদ্রা ও স্বর্ণ নিয়ে জিম্মি অর্থনীতির ব্যবসা শুরু করেছে তারা। রোহিঙ্গা নারীদের কাছ থেকে স্বর্ণ ও মুদ্রা রেখে বিনিময়ে নামমাত্র মূল্যে বাংলাদেশের টাকা দেয়া হচ্ছে। একইভাবে যাদের কাছে মুদ্রা নেই, তাদের স্বর্ণের বিনিময়ে টাকা দেয়া হচ্ছে। ফলে নাফ নদী পার হওয়ার পর একজন রোহিঙ্গার সঙ্গে থাকা শেষ সমম্বলটুকু কেড়ে নিচ্ছে দালাল চক্র। বিকল্প না থাকায় রোহিঙ্গারা বাধ্য হয়ে পানির দরে মিয়ানমারের মুদ্রা ও স্বর্ণ তুলে দিচ্ছে দালালদের হাতে। বিনিময়ে যা পাচ্ছে, তা দিয়ে একবেলা খাবারও জুটছে না।
এ প্রসঙ্গে উখিয়া থেকে মোবাইল ফোনে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবিএম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম শনিবার যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের কর্মকাণ্ড চোরাকারবারকে উৎসাহিত করবে। কারণ মিয়ানমারের মুদ্রা সরাসরি ব্যাংকগুলো কিনবে না। এসব মুদ্রা বিক্রি করতে হবে যারা মিয়ানমারের সঙ্গে অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য করছে তাদের কাছে। তিনি আরও বলেন, এটি এক ধরনের অনৈতিক ব্যবসা।
শনিবার মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের ঘুমধুম সীমান্তে আসেন রোহিঙ্গা ইউসুফ। মিয়ানমার পুসিং এলাকা থেকে পালিয়ে আসার সময় সঙ্গে তিন হাজার কিয়াত (স্থানীয় মুদ্রা) নিয়ে আসেন তিনি। নাফ নদী পার হওয়ার পর তার কাছে ্বাংলাদেশের কোনো টাকা ছিল না। দালাল চক্র তার কাছ থেকে তিন হাজার কয়েত রেখে তাকে দিয়েছে মাত্র একশ টাকা। ইউসুফ বলেন, আমি কিছু বুঝতে পারিনি। আমার কাছ থেকে এক রকম জোর করে টাকা (কয়েত) নিয়ে এ দেশের একশ টাকা দিয়েছে। আমি ছেলে, মেয়ে ও স্ত্রীসহ ৫ জন ওই টাকা দিয়ে নৌকা ভাড়া পরিশোধ করে বাংলাদেশে আসি।
জানা গেছে, ট্রুলারে যাত্রী বিশেষ করে রোহিঙ্গা পারাপারে জড়িত দালাল চক্র রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে মাথাপিছু ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা আদায় করছে। ঘুমধুম সীমান্তের শামলাপুরে এ কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছ শহীদ, মৌলভী রফিক, মৌলভী আজিজ, জহুর আলম, নুরুল আলমসহ অর্ধশত দালাল। শামলাপুর এলাকার বেশিরভাগ বোট মালিকও এখন দালালি শুরু করেছে।
এদিকে কক্সবাজার শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে ঘুমধুম সীমান্ত সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, আগের তুলনায় শনিবার রোহিঙ্গা স্রোত কম ছিল। তবে ২৪ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও পুলিশের হামলার পর থেকে এই সীমান্ত দিয়ে লাখো রোহিঙ্গা দেশে প্রবেশ করেছে। মুদ্রার অবৈধ ব্যবসার ব্যাপারে জানতে চাইলে স্থানীয় বাসিন্দা ইসমাইল যুগান্তরকে বলেন, তার গ্রামেও কয়েকজন মিলে এ ব্যবসা করছে। বিশেষ করে নাফ নদী পার হয়ে যে পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা প্রবেশ করছে সেখানে তারা কাজ করছে। ইসমাইলের মতে, মিয়ানমারের এক লাখ মুদ্রা দেয়ার বিনিময়ে ২ হাজার টাকা দেয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, যারা কিনছেন, তারা কষ্ট করে টেকনাফ বাজারের ব্যাংকে এসব মুদ্রা বিক্রি করছেন। ব্যাংকের হিসাবে দেশীয় এক টাকার বিনিময়ে মিয়ানমারের ১৬ দশমিক ৮০ কিয়াত পাওয়া যায়। মিয়ানমারের ৮৪০ কিয়াতের (মুদ্রা) বিনিময়ে বাংলাদেশের ৫০ টাকা পাওয়া যাবে।
কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী তৈয়বা বেগম জানান, তার পরিবারের ৬ জনকে গুলি করে হত্যা করেছে মিয়ানমারের সেনারা। এরপর এক কাপড়ে পালিয়ে আসেন বেঁচে থাকা পরিবার-পরিজন নিয়ে। ১১ দিন বনজঙ্গল পাড়ি দিয়ে নাফ নদীর সামনে আসার পর টাকার অভাবে নৌকা পার হতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত ৫০ হাজার টাকা মূল্যের (মিয়ানমার মুদ্রা) নাকফুল মাঝিকে দেয়ার পর সে নৌকা পার করে দিয়েছে।
সেন্টমার্টিন দিয়ে আট সদস্যের পরিবার নিয়ে উখিয়ার ঘুমধুমে আসা ইমান হোসেনের সঙ্গে কথা হয় পরিবারের বিষয়ে। তিনি বলেন, আমার আধা ভরি (আট আনা) স্বর্ণ ছিল। নৌকা পার হওয়ার সময় টাকা না থাকায় তা কেড়ে নেয়া হয়েছে। এখন খাবার খাওয়ার মতো টাকা নেই। ছোট ছেলেটিও না খেয়ে আছে।যুগা