বি.এইচ.মাহিনী (অভয়নগর সংবাদদাতা) ঃ ইতিহাস কথা বলে। এ কথা সত্য। তবে তার চেয়ে আরো বড় সত্য হলো কিছু ঐতিহাসিক চিত্র তত্ত্ব ও তথ্য আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় কী ছিল আমাদের, কী নেই আজ। প্রায় ৯০০ বছর ভারত শাসন করেছিল মুসলমানরা। আজকের ভারতের প্রতিটি প্রাচীন ঐতিহ্য স্মরণ করিয়ে দেয় তাঁদের কীর্তি। তাজমহল, কুতুব মিনার, শাহী জামে মসজিদ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তেমনিভাবে পৃথিবীর সব সভ্যতা, সকল জাতি গোষ্ঠীর কৃষ্টি-কালচার স্থাপত্য ও ঐতিহাসিক নিদর্শন থরে থরে শোভা পায় ইতিহাসের পাতায় ও প্রামাণ্যচিত্রে। আবার অবহেলায় হারিরেও যায় মহামূল্যবান অনেক ঐতিহ্য ও নিদর্শন। পৃথিবী তথা বাংলাদেশ থেকেও ধীরে ধীরে হারাতে বসেছে বহু প্রতœতাত্ত্বিক ও প্রাচীন ঐতিহ্য ও স্থাপত্য। এমনই একটি প্রাচীন নিদর্শন অভয়নগরের বাঘুটিয়া ইউনিয়নের কুমারপাড়ার মৃৎশিল্প। ৪০০ বছরের পুরাতন এ ঐতিহ্য আজ বিলীন হওয়ার পথে।
মৃৎ শিল্প কী? মাটি দিয়ে মনুষ্য হাতের নিপুন কলাকুশলীর মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী সামগ্রিই মৃৎ শিল্প নামে পরিচিত। মৃৎ শিল্প নিয়ে যারা কাজ করে অর্থৎ যারা এসব শৈল্পিক জিনিসপত্র তৈরি করে আঞ্চলিক ভাষায় তাদের বলা হয় ‘কুমোর’।
কুমোরদের তৈরি মৃৎ শিল্পের মধ্যে রয়েছে মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিল, থালা-বাসন, পানির পেয়ালা, ঘটি, বাটি, ঠাকনা, নন্দা, ঠিলা-কলসী ইত্যাদি। একথা আজ বিজ্ঞান সম্মত সত্য যে, মাটির তৈরি সাংসারিক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যবহার করলে বহু রোগ-জীবানু থেকে মুক্ত থাকা যায়। এতে রাসায়নিক কেমিক্যাল না থাকায় স্বাস্থ্য সম্মত খাবার পরিবেশন করা যায়। অভয়নগর উপজেলার বাঘুটিয়া সরকারি কমিউনিটি ক্লিনিকের উপ সহঃ কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার ডা. মো. আবু সাঈদ এমনই তথ্য দিয়েছেন। তিনি আরো জানিয়েছেন, ‘সিলভার বা আধুনিক ধাতব পদার্থের তৈরি থালা-বাসন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অন্যদিকে মাটির তৈরি জিনিস জীবানু মুক্ত থাকে। ফলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে।’
কুমারদের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ ঃ বাঘুটিয়ার পালপাড়ার এখন যারা এ শিল্পের সাথে জড়িত তাদের ক’য়েক জনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় ৪’শ বছর ধরে চলে আসছে তাদের বাসস্থান। বাঘুটিয়া কুমোরপাড়ার কয়েকজন বয়োজোষ্ঠ্য লোকের সাথে কথা বলে জানা যায়, মোঘল আমলে তারা ভৈরব উত্তর-পূর্ব জনপদের পার্শ্ববর্তী পাইকপাড়া গ্রামে সর্বপ্রথম তাদের বসতি স্থাপন করে। এরপর তাদের পিতামহ এই স্থানে (বাঘুটিয়া) এসে বসতি স্থাপন করে এবং এ সময়ে তারা পোড়া মাটির বাসন-কোসন, হাড়ি-পতিল, কলসিসহ জ্বালিয়ে রাখার প্রদীপটিও তৈরি করতে কার্পন্য করেনি। আর তাইতো এখনও তারা তাদের তৈরি এসকল জিনিসপত্র বেচা-বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। তারা তাদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধিসহ সভ্যতার সমৃদ্ধিতে তারা অংশ নিতে ভুলে যাননি।
তৈজসপত্র তৈরি প্রক্রিয়া ঃ বাঘুটিয়ার পালপাড়ার কালীপদ পালের ছেলে হরিপদ পাল (৪৫) জানান, আমাদের পূর্বে ৮-১০পুরুষ এ করে আসছে। তার ভাষ্য মতে, আগে যেখানে ১৫-২০টি চাকা ঘুরতো এখন সেখানে মাত্র ৫-৬টি চাকা ঘুরে। মূলত এটেল মাটি দিয়ে তৈরি হয় এসকল ক্রোকারিজ সামগ্রী। শুকনা মাটি প্রথমে পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। এরপর খামি করে পা ও হাত ব্যবহার করে ময়দা মাখানোর মতো খামি তৈরি হয়। এরপর এ খামি বাঁশ, কাঠ ও নারকেলের ছোবড়া দিয়ে তৈরি চাকে উঠানো হয়। চাক ব্যবহার করে সাধারণত ঠিলা, কালসী, খোলা, হাঁড়ি, পূজার ঘটসহ অনেক কিছু তৈরি হয়। হাতে তৈরি তৈজষপত্রের মধ্যে রয়েছে গরুর খাবারের নান্দা বা চাড়ী, মালসা, ঠাকুন, বাসন, দধির ভাড় প্রভৃতি।
বর্তমান চিত্র ঃ কালক্রমে এখন আমারা কি দেখতে পাচ্ছি? আধুনিক সভ্যতার সংস্পর্শে এসে আমরা যখন এসকল মাটির তৈরি জিনিসপত্র ব্যবহার থেকে বিরত থাকছি, তখন কঁপাল পুড়ছে মৃৎ শিল্পিদের। বেচা-বিক্রি নেই বলে তারা তাদের বাপ-দাদার এ পুরাতন পেশা ছেড়ে অনেকেই ভিন্ন কর্মসংস্থান খুঁজে নিচ্ছে। তাই এদের সেই তৈরি পণ্য সম্ভার সভ্যতার প্ররিক্রমায় আজ নিভে যেতে বসেছে। নিত্য নতুন কাচের বা সিরামিকের পন্য সম্ভারের অনুপ্রবেশের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে এ শিল্প। মৃৎ শিল্পে বর্তমানে আয় রোজগার কেমন, জানতে চাইলে সোনাপালের ছেলে নিরাপদ পাল (৫২) জানান, একজন দিনে ৪০-৫০টি গুড়ের ঠিলা বানাতে পারে। যা ৪৫০-৫০০ টাকা বিক্রি হয়। যা পোড়াতে প্রায় ২শ’ টাকার কাঠ খরচ হয়। আমরা যদি সত্যিই আমাদের প্রাচীন এ ঐতিহ্য ধরে রাখতে চাই তবে এসকল কুমোরদের সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। যাতে তারা তাদের পূর্ব পুরুষদের কর্মকান্ড ধরে রেখে কাজে অনুপ্রেরণা পায়। এলাকার বয়স্ক ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, একসময় এই কুমোরপাড়ায় কুমোররা জাকজমকের সাথে বসবাস করত। তাদের পণ্য সমগ্রী সবাই আগ্রহভরে কিনে নিত। তাদের এই তৈজসপত্রের ব্যবহার বৃদ্ধির প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিশেষভবে তদারকি করা দরকার তা না হলে দিনে দিনে এই ব্যবহার্য জিনিসপত্র দ্রব্য সমগ্রী আমাদের মাঝ থেকে যেমনি হারিয়ে যাবে তেমনি এই কুমোর সম্প্রদায় তাদের বাপ-দাদাদের পুরনো ঐতিহ্য হারিয়ে এক সময় শুধু স্মৃতি মন্থন করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।
১৯-০৯-১৭