দাঙ্গাবাজ বাহিনী বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করতে এসেছে। চারদিকের চিৎকার চেঁচামেচিতে মা-বাবা আদরের শিশুসন্তানটিকে পেছনের দরজা দিয়ে বের করে দেন, ‘যা বাবা, পালিয়ে যা, অনেক দূরে পালিয়ে যা’। এরপর তারা ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরাতে থাকেন তড়িঘড়ি। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে যায়। ঘরে ঢুকে পড়ে দাঙ্গাবাজরা। বাবাকে নৃশংসভাবে হত্যার পর মাকেও ধর্ষণ শেষে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলে।
ওদিকে আধো আধো কথা বলতে থাকা শিশুটি দৌড়াতে থাকে প্রাণভয়ে। ওই সময় তার চোখে কেবল ভেসে ওঠে মায়ের কোলখানি, যেখানে সে ঘুমাত। মায়ের ঘুমপাড়ানি গান শুনে। ভেসে ওঠে বাবার কাঁধখানি, যেখানে যে খেলত, সবার ওপরে উঠে যাওয়ার খেলা। তার চোখ বেয়ে জল গড়ায়। যে মা-বাবাকে ছাড়া এক মুহূর্তও কাটে না, সে তাদের ছেড়ে কোথায় ছুটছে
এ বর্ণনাটা বহু চলচ্চিত্রের শুরুর স্ক্রিপ্ট যেন। কিন্তু এটা চলচ্চিত্র নয়। আধুনিক বিশ্বের রাষ্ট্র মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের লাখো রোহিঙ্গার ভাগ্যে ঘটতে থাকা নির্মম বাস্তবতা।
এ বাস্তবতার করুণ শিকার মাত্র চার বছর বয়সী আরমান। মায়ের স্নেহের কোল আর বাবার আদরের কাঁধ ছেড়ে ছুটতে না চাইলেও মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাকেও চলচ্চিত্রের গল্পের মতোই পালিয়ে একেবারে দেশান্তরী হতে বাধ্য করেছে। সীমানা, দেশ অবশ্য না বুঝলেও আরমান বোঝে রাতের পর রাত ছুটতে ছুটতে নদী পার হয়ে এপারে এসে সে মা-বাবা থেকে অনেক ‘দূর’ হয়ে গেছে।
বাড়ির আঙিনায় কাঁটা ফুটতেই মা বলে ডাক দিলে যে মা ছুটে আসতেন, নাফ নদীর তীরে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ডাকতে থাকলেও মা ছুটে না আসায় আরমান বোঝে, সে বড্ড দূরে চলে এসেছে। বাবা নাকি তার কাজে অনেক দূর যেতেন। আরমান জানে না, তার বাবা এখানেও আসবেন কিনা, তাকে কাঁধে করে বাড়ি ফিরিয়ে নিতে।
পরনে ছেঁড়া কাপড় আর ক্লান্ত চোখ-মুখ দেখে বোঝা যায়, অনেক বেলা হয়তো খাওয়াও হয়নি। কিন্তু এতটুকুন শিশু, খাবারের কথাও যেন ভুলে গেছে। কিছু খেতে চাইবার বদলে সে কেবল মা-বাবাকে ডাকছে। নদীর ওপারে জ্বলতে থাকা আগুন দেখিয়ে সে বোঝায়, ওই জ্বলন্ত মিয়ানমারে মা-বাবাকে রেখে সে চলে এসেছে এখানে। তাদের দিকে চেয়ে সে এখানে বসে আছে। কিন্তু বয়ে চলা নাফ নদীর ঢেউ যেন আরমানকে বলে যায়, তোমার মা-বাবা নদীতে ওঠার সুযোগ পাননি। আরমান সেদিকে তাকিয়েই ফের কাঁদতে থাকে। তার দু’ফোটা চোখের জল গাল বেয়ে পড়তেই যেন থমকে যায় খোদ নাফ নদী।
রোহিঙ্গাবোঝাই নৌকাগুলো নাফ নদী পার হয়ে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের জেটিঘাটে এসে ভিড়ছে। আরমানের মতো আরও অনেক রোহিঙ্গা শিশু-বৃদ্ধ-মা-তরুণ-তরুণী এপারে পালিয়ে আসছে। কূলে নৌকা ভিড়তেই আরমানের চোখ যায় সেদিকে। বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায় আরমান। এসব মানুষের ভিড়ে সে মা-বাবাকে খোঁজে। তার পাড়ার চাচা-মামাদের খোঁজে। যেন কেউ তার মা-বাবার খোঁজ নিয়ে আসবে।
নৌকা থেকে নেমে আসা মানুষগুলো আরমানের পাশ ঘেঁষে চলে যাচ্ছে। যে যার মতো করে ছুটছে। কেউ কারও খোঁজখবর নেয়ার সময় নেই। কে কাকে দেখবে? মিয়ানমারের বাহিনী যে এখন পর্যন্ত সোয়া ৪ লাখ মানুষকেই বাস্তুহারা করে দেশান্তরে পাঠিয়েছে।
প্রাণভয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটে আসা এই লাখো মানুষের এক যুদ্ধশিশু আরমান। মা-বাবার কথা বলতেই বাঁ হাতে চোখ মোছে। ডান হাতে নদীর ওপারে ইশারা করে; ‘আম্মা-আব্বু ওই’।
রোহিঙ্গা নারী-পুরুষদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে তার অর্ধেকের বেশি শিশু। এর মধ্যে শত শত শিশু রয়েছে যাদের সঙ্গে পরিবারের কোনো সদস্য নেই।
তাহলে কীভাবে এসব শিশু এপারে আসছে-এমন প্রশ্নের উত্তরে রোহিঙ্গাদের জবাব, রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার আর্মিরা মূলত রাতের বেলায় আগুন দেয়। এতে যেসব গ্রাম আক্রান্ত হয় তাৎক্ষণিক ওইসব গ্রামের মানুষ ছোটাছুটিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তখন পরিবারের বাবা-মা-আত্মীয় স্বজন নিজেদের ছেলে-মেয়ে পাহাড়ের দিকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করে। আবার অনেক শিশু রাতের আঁধারে পালাতে গিয়ে পাহাড় ও নাফ নদীর পাড়ে চলে আসে।
এমন অনেক পরিবার আছে যারা পালানোর সময় তাদের সন্তানদের হারিয়ে ফেলে। এর মধ্যে অনেক শিশু এমনও আছে-যাদের মা-বাবাকে মিয়ানমার আর্মি গুলি করে মেরে ফেলেছে কিংবা তাদের ঘরে আগুন দেয়ায় মা-বাবা পুড়ে গেছে। কোনোমতে শিশুটি বেঁচে গেছে।
এ অবস্থায় ওসব শিশু যখন তাদের মা-বাবা কিংবা আত্মীয়স্বজনদের খুঁজে না পায়, তখন দল বেঁধে আসা মানুষগুলোর মধ্যে ঢুকে পড়ে। তাদের সঙ্গেই এসব শিশু নাফ নদীর পাড়ে চলে আসে।
ওখান থেকে কারও দয়া হলে নৌকায় তুলে শিশুদের এপারে শাহপরীর দ্বীপে নিয়ে আসা হয়। অনেক সময় দেখা যায়, শিশুদের বাঁচাতে এপারের নৌকায় তুলে দিয়ে ওপারে মা-বাবা থেকে যায়।
আরমানের মতো রহিম নামে এক শিশু জানায়, তার বাবা-মা কোথায় সে জানে না। নদীর ওপার থেকে তার পরিচিত একজন তাকে নৌকায় তুলে দেয়। সেখান থেকে শাহপরীর দ্বীপে আসে। সেখান থেকে সাবরাং ইউনিয়ন হয়ে ট্রলারযোগে টেকনাফে আসে। পানি আর গাছের পাতা খেয়ে গত চারদিন কেটেছে তার। এখানে এসে কিছু খাবার পেয়েছে সে। কিন্তু উখিয়া কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প যেতে তার কাছে ভাড়ার টাকা নেই।
মোহম্মদ আজিজ নামে এক শিশু জানায়, মিয়ানমারের আকিয়াব অঞ্চলের মংডু এলাকার তাদের বাড়ি ছিল। গত ১৪ সেপ্টেম্বর রাতে তাদের বাড়িতে আগুন দেয়া হয়। রাতের আঁধারে পালাতে গিয়ে বাবা-মাকে হারিয়ে ফেলে সে। পরে নৌকায় আরেক চাচার মাধ্যমে এপারে আসে। বাবা-মা বেঁচে আছেন কিনা জানে না আজিজ।
আরমান-রহিম-আজিজই শুধু নয়, মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর গণহত্যার মুখে সেখান থেকে পালিয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা শিশু একাকি বাংলাদেশে চলে এসেছে। কিন্তু কে দেখবে এদের? কে নেবে যত্ন, কে করবে স্নেহ-আদর, কে দেবে মমতা-ভালোবাসা? যত্ন-আদর-ভালোবাসার অভাবে যদি রোহিঙ্গাদের এই প্রজন্মটাই নষ্ট হয়ে যায়, তার দায় নেবে কে?