যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ সাতটি দেশ মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান নৃশংসতা নিয়ে আলোচনার জন্য জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়েছে। এই বৈঠকে দেশগুলো নিরাপত্তা পরিষদে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব এন্তোনিও গুতারেসের বক্তব্য দাবি করেছে।
বৈঠক আহ্বানের অনুরোধ করা অপর দেশগুলো হল সুইডেন, মিশর, কাজাখাস্তান ও সেনেগাল। এই সাতটি দেশটি নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স স্থায়ী সদস্য এবং তাদের ভেটো ক্ষমতা রয়েছে। ইথিউপিয়া বর্তমানে নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতিত্বকারী দেশ।
ইথিউপিয়া জানিয়েছে, নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের সাথে আলোচনা করে বৈঠকে দিনক্ষণ নির্ধারণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সাতটি দেশ আগামী সপ্তাহে বৈঠকটি আহ্বানের অনুরোধ জানিয়েছে।
অপর দুই স্থায়ী সদস্য চীন ও রাশিয়া নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমার ইস্যুতে আলোচনায় আগ্রহ দেখায় না। তারা বাংলাদেশের সাথে দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমস্যাটি নিরসনে উৎসাহ দিয়ে থাকে। জাতিসঙ্ঘ সাধারণ অধিবেশন চলাকালে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সমালোচনার মধ্যেও এই দুই দেশ প্রকাশ্যেই মিয়ানমার সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার অজুহাতে গত অক্টোবর থেকে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা নিধন শুরু হওয়ার পর ইস্যুটি নিয়ে নিরাপত্তা কাউন্সিল চার দফা রুদ্ধদার বৈঠক করেছে। কিন্তু এসব বৈঠকের পর বিবৃতি দিতে বাধা দেয় চীন। তবে গত ২৫ আগস্টের পর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দমন অভিযান সীমা ছাড়িয়ে গেলে এবং বাংলাদেশ সীমান্ত অভিমুখে উদ্বাস্তুদের বাধভাঙা স্রোত নেমে এলে বিশ্ব জনমতের প্রেক্ষাপটে ১৫ সেপ্টেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর একটি কড়া বিবৃতি দেয়া হয়। প্রায় ৯ বছর পর নিরাপত্তা পরিষদের সব সদস্যের ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে কোনো ইস্যুতে এমন বিবৃতি দেয়া হলো। বিবৃতিতে রাখাইন রাজ্যে চলমান সহিংসতায় চরম উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এ ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানানো হয়।
সহিংসতা বন্ধের পাশাপাশি নিরাপত্তা পরিষদের ওই বৈঠকে রাখাইনের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা, আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, নাগরিকদের সুরক্ষা দেয়া, সামজিক ও আর্থিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক করা এবং শরণার্থী সমস্যা নিরসনের আহ্বান জানানো হয়েছিল। পরিষদের বিবৃতিতে শরণার্থীদের সহায়তা দেয়ার জন্য বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানানো হয়। জাতিসঙ্ঘ ও অন্যান্য সংস্থাগুলোকে এ বিষয়ে বাংলাদেশকে সহায়তা দেয়ার আহ্বান জানানো হয়। বৈঠকে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা রাখাইন পরিস্থিতির দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদনে দেয়া সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব দেয়।
জাতিসঙ্ঘ সাধারণ অধিবেশনে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ‘নিরাপদ অঞ্চল’ গড়ে তুলে সুরক্ষা দেয়ার যে প্রস্তাব বাংলাদেশ উত্থাপন করেছে, তার জন্য নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন প্রয়োজন। এক্ষেত্রে চীন ও রাশিয়ার কাছ থেকে সম্মতি আদায় করাটা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে এ লক্ষ্যে জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে বাংলাদেশ।
এর আগে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসঙ্ঘকে দৃঢ় ও দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে ট্রাম্পের এই বক্তব্য তুলে ধরেন দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স। পেন্স বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও আমি জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদকে এই সঙ্কটের ইতি টানতে দৃঢ় ও দ্রুত পদপেক্ষ নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
গত বৃহস্পতিবার জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি জানান, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমরা যে ট্র্যাজেডির শিকার হচ্ছে তাতে উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান বন্ধ করতে মিয়ানমারের নেতা অং সান সু চি ও দেশটির সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের চাপ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ জোসেফ ডানফর্ড মিয়ানমারের সেনাপ্রধানকে বলেছেন, ‘এমনটি চলতে পারে না’।
২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে দেশটির সেনাবাহিনীর তথাকথিত ক্লিয়ারেন্স অপারেশন শুরু হওয়ার পর এ পর্যন্ত ৪ লাখ ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। জাতিসঙ্ঘ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এই অভিযানকে ‘জাতিগত নিধন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। আর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুল মেক্রোন এটিকে ‘গণহত্যা’ হিসাবে অভিহিত করেছেন।
বাংলাদেশের সাথে আলোচনায় আগ্রহী মিয়ানমার : রাখাইন সংকট নিয়ে বাংলাদেশের সাথে আলোচনায় আগ্রহ প্রকাশ করেছে মিয়ানমার। দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা থাউং টুন জাতিসঙ্ঘের সাধারন অধিবেশনের সাইডলাইনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সাথে আলোচনা করতে চান।