দুঃস্বপ্নের শরণার্থী জীবন রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়েই কাটছে দিন ত্রাণ বিতরণ ও শেড নির্মাণে কাজ শুরু করেছে সেনাবাহিনী * মিয়ানমারে ভূলুণ্ঠিত মানবতার জয় বাংলাদেশে

মিয়ানমারে বর্বর নির্যাতনের শিকার হয়ে ও প্রাণভয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসা প্রায় এক মাস হতে চলেছে রোহিঙ্গাদের। ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের শত শত গ্রামে মিলিটারি ও ‘মগ’রা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর একযোগে হামলা করে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। রোহিঙ্গা নারী-প–রুষ-শিশুদের ওপর নির্বিচারে হত্যা-নির্যাতন শুরু করলে তারা দলে দলে সহায়-সম্পদ পেছনে ফেলে চলে আসেন বাংলাদেশে। সীমান্তবর্তী উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় ঠাঁই হয় তাদের। নিজ দেশে নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় পেয়েছেন। সরকারও তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। সহায়তার হাত বাড়িয়েছে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, শিল্প গ্রুপ। পাঠিয়েছে ত্রাণ সহায়তা। সর্বশেষ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও মাথা গোঁজার ঠাই (শেড) নির্মাণে শনিবার থেকে সরকারের নির্দেশে যুক্ত হয়েছে সেনাবাহিনী। তারা কাজ শুরু করেছে উখিয়া ও টেকনাফে।

প্রাথমিকভাবে ৮৪ হাজার পরিবারের জন্য ১৪ হাজার শেড নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে সেনাবাহিনী। একই সঙ্গে দেশ-বিদেশ থেকে আসা ত্রাণের সুষম বণ্টনেও কাজ শুরু করেছে সেনাবাহিনী। এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের দুঃস্বপ্নের শরণার্থী জীবনে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে আসবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। কক্সবাজার আসনের এমপি সাইমুম সরওয়ার কমল যুগান্তরকে বলেন, ‘একসঙ্গে সাড়ে চার লাখের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করায় তাদের আশ্রয় ও খাদ্যের জোগান দেয়া কঠিন হলেও সে পরিস্থিতিই মোকাবেলা করছে বাংলাদেশ। মিয়ানমারে মানবতা ভূলুণ্ঠিত হলেও বাংলাদেশে জয় হয়েছে মানবতার। যা বিশ্ববাসী দেখছেন।’

কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের কুতুপালং থেকে বালুখালী পর্যন্ত এলাকায় শনিবার সরেজমিন দেখা গেছে ত্রাণের জন্য রোহিঙ্গাদের ছোটোছুটি। রাস্তার দুই পাশে খোলা আকাশের নিচে বসে আছেন অনেকে। প্রখর রোদে অনেকে ত্রাণবাহী ট্রাকের পেছনে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন একমুঠো ত্রাণের জন্য। চিকিৎসা ক্যাম্পগুলোতেও ভিড় দেখা গেছে। সেখানে রোহিঙ্গা মায়েরা রোগাক্রান্ত শিশুদের নিয়ে ওষুধ-পথ্যের জন্য ছোটাছুটি করছেন। ত্রাণ ও আশ্রয়ের আশায় কেউবা ছুটছেন বায়োমেট্রিক নিবন্ধন কেন্দ্রের দিকে। তবে শুরুতে যেভাবে উখিয়ার পথে পথে ক্ষুধার্ত মুখ ছিল, তাদের জন্য ট্রাকে ট্রাকে খাবার নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ত্রাণ আসছিল শনিবার সেই চিত্র তেমনটা দেখা যায়নি। দেশ-বিদেশের সাংবাদিকদের উপস্থিতিও উখিয়া-টেকনাফে কমে আসছে। শুধু অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ আর দুঃস্বপ্ন নিয়ে শরণার্থী জীবনে থেকে যাচ্ছে দেশত্যগী ভাগ্যাহত রোহিঙ্গারা।

রুমানার বয়স বছর চল্লিশেক হবে। কোলে ৩ মাস বয়সী বাচ্চা। তার স্বামীর নাম আবদুর রহমান। মিয়ানমারের বুচিদং থেকে আরও ৫ ছেলেমেয়ে নিয়ে পালিয়ে এসেছেন প্রায় এক মাস হতে চলছে। স্বামী আসতে পারেননি। বেঁচে আছেন না মারা গেছেন তাও জানেন না রুমানা। এখনও জোগাড় করতে পারেননি মাথা গোঁজার ঠাঁই। উখিয়ার কুতুপালংয়ে পুরনো শরণার্থী শিবিরে ফাতেমা নামে এক খালা তাদের অস্থায়ীভাবে থাকার জায়গা দিলেও খাবারের জোগান দিতে পারেন না। তাই প্রতিদিন ত্রাণের আশায় রাস্তায় বের হতে হয় তাকে। শনিবারও বের হয়েছিলেন। উখিয়ার বালুখালী এলাকার রাস্তার পাশে সন্তান কোলে দাঁড়িয়ে থাকা রুমানার সঙ্গে কথা হয়। জানান, ‘বেডা’ (স্বামী) নাই। তাই থাকার জায়গা জোগাড় করতে পারেননি এক মাসেও। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ত্রাণের আশায় দিন কাটে, কোনোদিন পেলে খান। না পেলে উপোস থাকেন। আমিনার (৩৫) স্বামীর নাম আবু তাহের। মিয়ানমারের বুচিদংয়ের সিন্ডিপরানে তার বাড়ি। জন্মের সময় একজন, অসুখ-বিসুখে আরও দুই সন্তান মারা গেছে তার। তিন সন্তান নিয়ে পালিয়ে আসার পথে এক সন্তান পালংখালীর ‘মুড়া’র (পাহাড়) ভেতর হারিয়ে গেছে। দুই সন্তান অনাহারে-অর্ধাহারে অসুস্থ অবস্থায় রয়েছে। হারাধনের দশটি ছেলের গল্পের মতোই যেন হয়ে উঠেছে তার জীবন। জানান, অসুস্থ সন্তানদের জন্য ‘দাবাই’ (ওষুধ) আনতে গিয়েছিলেন। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন বালুখালী এলাকায় স্থাপিত একটি অস্থায়ী চিকিৎসা ক্যাম্প। সেখান থেকে ওষুধ নিয়ে তা হাতেই আবার রাস্তার পাশে অপেক্ষা করছেন ত্রাণের জন্য। রেহেনার (২৫) স্বামীর নাম নুর মোহাম্মদ। মিয়ানমারের বুচিদংয়ের ধনসরায় তার বাড়ি। তার কোলে ৪০ দিন বয়সী শিশু। ত্রাণের জন্য তিনিও রাস্তার ধারে অবস্থান করছেন। শামসুন্নাহারের (৩০) স্বামীর নাম আহমদ কবির। ৫ সন্তানের মা। গর্ভে রয়েছে তার আরও এক সন্তান। জানান, গর্ভে সন্তান থাকার কারণে হাঁটতে ‘বেযুইত’ (অসুবিধা) লাগে। তবুও সন্তানদের খাবারের জন্য তাকে বের হতে হয়েছে রাস্তায়। মিনারা (৩৫) ছয় সন্তান নিয়ে পালিয়ে আসার পর ২০ দিন কেটেছে তার উখিয়ার কুতুপালংয়ের পালংখালীর রাস্তায়। কচুরিপানার মতো ভাসমান জীবন তার। ক’দিন ছিলেন কুতুপালংয়ে বোনের ক্যাম্পে। বালুখালী পাহাড়ের পাদদেশে পলিথিনের ছাউনি বানিয়ে কয়েকদিন কাটলেও বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে সেই আশ্রয় ভেসে গেছে। জানালেন, ২০ দিন চলে গেছে এখনও ‘থর’ (স্থির) হতে পারেননি। রাস্তায় রাস্তায় দিন কাটছে তার। রুমানা, আমিনা, রেহেনা, শামসুন্নাহার কিংবা মিনারার মতো লাখ লাখ রোহিঙ্গার দুর্বিষহ শরণার্থী জীবন শুরু হয়েছে উখিয়া-টেকনাফে, শেষ কোথায় এ জীবনের। প্রাণভয়ে নিজ দেশ ত্যাগ করে ভিন দেশে পালিয়ে এলেও খাদ্য সংকট, পানি সংকট, রোদ-বৃষ্টির দুর্ভোগ, বন-জঙ্গলে পশু-পাখির ভয়সহ চোখেমুখে রাজ্যের অন্ধকার নিয়েই যাত্রা শুরু হয়েছে তাদের। তারা জানেন না এ যাত্রার শেষ হবে কবে কিংবা আদৌ শেষ হবে কিনা।

Check Also

ভোমরা বন্দরে চার মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয়

দক্ষিণবঙ্গ সাতক্ষীরার আধুনিক নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিককেন্দ্র ভোমরা স্থল বন্দর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।