কক্সবাজার: উখিয়া কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা স্থানীয় যুবক আলিম উদ্দিন বলেন, গত কয়েকদিন ধরে স্থানীয় দালাল ও কতিপয় রাজনৈতিক নেতার আনাগোনা ছিল কুতুপালংসহ রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায়। বিশেষ করে নতুন স্থাপিত ক্যাম্প ও পাহাড়ী জোনে। কি’ সেনাবাহিনী আসার পরপরই এ চিত্র বদলে যায়। এখন সেই দালাল-নেতাদের খোঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি এলাকাও ত্যাগ করছে অনেকে।
শুধুই আলিম উদ্দিন নয় এরকম জাবের ও ফারুক নামের দুই শিক্ষার্থী জানান, এতদিন রোহিঙ্গাদের নিয়ে ব্যবসা ভাল হয়েছিল এক শ্রেণির দালালদের। এখন আর তাদের ব্যবসা হবেনা। সেনাবাহিনী এ দায়িত্ব যাতে শেষ পর্যন্ত পালন করেন আমরা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
সরজমিনে দেখা গেছে, কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের উখিয়া ডিগ্রি কলেজের গেইটে সেনা সদস্যদের যানবাহন নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ততার দৃশ্য দেখা গেছে। এসব দেখে সাধারণ মানুষের মন্তব্য ‘এবার তো অবশ্যই পরিস্থিতির উন্নতি হবে। সড়কে আর ত্রাণ বিতরণের সেই দৃশ্য দেখতে হবে না। ’ ফেইসবুকে ছবি দেখব না। এভাবেই কলেজ গেইট থেকে টেকনাফের শামলাপুর বাজার পর্যন্ত ঘুরে সেনাবাহিনীর প্রশংসিত কাজ ভেসে উঠে। কেউ ব্যস্ত সড়কে যানবাহন নিয়ে আবার কেউ ব্যস্ত ত্রাণ কার্যক্রম নিয়ে। কারও সাথে কথা বলার ফুসরত নেই। সবাই যার যার মত অর্পিত দায়িত্ব পালন করছে।
শনিবার সেনাবাহিনী দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে পাল্টে গেছে পুরোচিত্র। নির্দিষ্ট স্থানে পরিকল্পিতভাবে দেয়া হচ্ছে ত্রাণ। এতে করে সবাই শৃঙ্খলার ভেতরে চলে এসেছে। রোহিঙ্গারা যত্রতত্র ত্রাণের জন্য ঘুরত। এখন আর সেটি হচ্ছে না।
ক্যাম্প কমান্ডার মেজর মুহাম্মদ রাশেদ আকতার এসপি জানান, পূর্ব সিদ্ধান্ত মতে রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় এসে সেনা সদস্যরা প্রথমে সড়কে শৃঙ্খলা আনতে কাজ শুরু করে। অনিয়ন্ত্রিত যানবাহন ও বি”িছন্ন ত্রাণ বিতরণ এবং রাস্তায় রোহিঙ্গাদের অহেতুক জটলা সরিয়ে দিয়ে সড়ক যোগাযোগ নির্বিঘœ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, কন্ট্রোল রুমে জমা হওয়া দ্র“ত পচনযোগ্য তাজা খাবারগুলো আলাদা করে বিতরণের জন্য নেয়া হচ্ছে। বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের আওতায় আসা রোহিঙ্গারাই এসব ত্রাণের আওতায় আসছে। এর মাধ্যমে বায়োমেট্রিকের সুবিধার মেসেজটা রোহিঙ্গাদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাচ্ছি।
কাজের সুবিধার্থে উখিয়া ডিগ্রি কলেজের পরিত্যক্ত একটি কক্ষকে কোম্পানির কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে উল্লেখ করে মেজর মুহাম্মদ রাশেদ আকতার জানান, উখিয়ায় ৩৬ বীর, ২৪ বেঙ্গল ও ৬৩ বেঙ্গল নামে ৩টি টিম রোহিঙ্গাদের আশ্রয়স্থল উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালীতে কাজ শুরু করে। বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার কয়েক দফা রেকি ও পরিকল্পনা করে ত্রাণ বিতরণের জন্য প্রাথমিকভাবে কিছু স্থান নির্ধারণ করে সেনাবাহিনী।
উখিয়ায় নির্ধারিত ২ হাজার একর জমিতে ১৪ হাজার শেড নির্মাণ করার দায়িত্ব পেয়েছে সেনাবাহিনী। প্রতিটি শেডে ৬ জন করে ৮৪ হাজার পরিবার থাকার সুযোগ পাবেন। শেড নির্মাণের পাশাপাশি জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমও পরিচালনা করবে সেনাবাহিনী।
দেখা গেছে, টেকনাফ সড়কের কুতুপালং থেকে থাইংখালী-বালুখালী পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার এলাকা এক প্রকার ফাঁকা। অথচ এর আগের দিনও ছিল যানবাহনের জট। আবার ত্রাণবোঝাই যানবাহন থেকে ত্রাণের প্যাকেট ছুড়ে মারার কারণে পুরো সড়কে বিশৃঙ্খলা লেগেই ছিল। সড়কের দুই ধারে ত্রাণের অপেক্ষায় ছিল হাজার হাজার রোহিঙ্গা। কিন্তু রাস্তায় এখন রোহিঙ্গা পাওয়া যাবেনা। সবাই ক্যাম্পের ভিতর নিয়ন্ত্রণে। শামলাপুরের যুবনেতা ছৈয়দ কাশেম জানান, সড়কের যানবাহন নিয়ন্ত্রণ ও ত্রাণ বিতরণে সেনাবাহিনী কাজ করায় সর্বত্রই স্বস্তি ফিরে এসেছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে যারা ত্রাণ নিয়ন্ত্রণ কক্ষে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে আসছে, সেগুলো এখন থেকেই সেনা সদস্যরা নির্ধারিত ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে নিয়ে বিতরণ করছে। যা অত্যান্ত ভাল হ”েছ। সেনাবাহিনী যেইভাবে ত্রাণগুলো বণ্টনে শৃংখলা করে দিয়েছে তাতে কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা হয়নি। এক সপ্তাহ আগের চিত্র আর এখনকার চিত্র পুরোটাই পাল্টে গেছে। আগে রোহিঙ্গারা যত্রতত্র ত্রাণের জন্য ঘুরত। এখন আর সেটি হচ্ছে না। সামনে ক্যাম্পের বাইরে কেউ যেতে পারবেনা। তিনি আরো বলেন, সেনাবাহিনীর নির্ধারিত স্থানের বাইরে কেউ ত্রাণ দিচ্ছেন না। তাই রোহিঙ্গাদেরও নির্ধারিত স্থান থেকে ত্রাণ নিতে হচ্ছে। এতে স্থানীয় এলাকাবাসী মহাখুশি। বিতরণ কেন্দ্রে লাইন ধরে ত্রাণ দেওয়ার কারণে কোনো বাড়তি ঝামেলাও পোহাতে হচ্ছে না। এতে রোহিঙ্গারাও বেশ খুশি। বেশি খুশি বৃদ্ধ ও নারী রোহিঙ্গারা। এলাকার অনেক সচেতন ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, সেনাবাহিনী দায়িত্বপালন করায় অনেক খ্যাত-অখ্যাত দালাল ও নেতা এলাকা থেকে পালিয়ে গেছে। এতদিন তারা সরকারি জমি দেখিয়ে রোহিঙ্গাদের জীম্মি করে টাকা আদায়, সীমান্ত থেকে মোটা অংকের মাধ্যমে রোহিঙ্গা আনা-গোনা, ত্রাণ লুটপাটসহ নানা অপরাধ কর্মকান্ড করে আসছিল।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো: আলী হোসেন জানিয়েছেন, প্রতিদিনই রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহযোগিতা আসছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। দৈনিক গড়ে শতাধিক ত্রাণবোঝাই যানবাহন এসে পৌঁছাচ্ছে রোহিঙ্গা শিবিরে। সেনা সদস্যরা এসব ত্রাণ টোকেনের মাধ্যমে বিতরণ করলে আর কোনো ধরণের সমস্যা হবে না। তাই সার্বিক শৃংখলা ফিরে এসেছে তাদের দায়িত্ব পালনের পর থেকে। আমরা চাই রোহিঙ্গাদের নিয়ে কেউ যাতে বিশৃংখলা করতে না পারে।