নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে যে দেশ যা বলেছে

বাংলাদেশের জন্য বহু প্রতীক্ষিত ও গুরুত্বপূর্ণ ‘নিরাপত্তা পরিষদ’-এর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের স্থানীয় সময় গত বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাত ১টার দিকে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনা শুরু হয় এবং কোন সিদ্ধান্ত ছাড়াই আলোচনা শেষ হয়। তবে আলোচনায় নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলো রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশের ভূমিকার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে। আমাদের সময়.কম।

বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে রাশিয়া আর চীন বাদে সব সদস্য রাষ্ট্র সম্মত হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তর্জাতিক মহলকে অবিলম্বে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানালেও সুনির্দিষ্ট কোনও প্রস্তাব ছাড়াই শেষ হয়েছে ওই বৈঠক। এমনকি কোনও যৌথ বিবৃতিও দেওয়া হয়নি। তবে রাখাইন সংকটে রাজনৈতিক সংলাপ শুরুর ব্যাপারে সম্মত হয়েছে সদস্য রাষ্ট্রগুলো।

সহিংসতা নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ, রাখাইনে ত্রাণের অবাধ প্রবেশ নিশ্চিত করার কথা বলেছে বাকি সদস্যরা।

মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে চীন ও রাশিয়া মিয়ানমারের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ‘জঙ্গিবাদ’কে রাখাইনের প্রধানতম সংকট হিসেবে মত দিয়েছে।

বৈঠকের শুরুতেই আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেজ। বক্তব্যে তিনি সহিংসতা নিরসন, সেনা অভিযান বন্ধ, রাখাইনে মানবিক সহায়তার অবাধ প্রবেশগম্যতা নিশ্চিতের তাগিদ দেন। পাশাপাশি আনান কমিশনের সুপারিশ মেনে নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিতের আহ্বান জানান। আর যারা অনিবন্ধিত, তাদের ক্ষেত্রে স্ট্যাটাস কী হবে তা ঠিক করারও আহ্বান জানান তিনি। পরে সদস্য দেশগুলো একে একে বক্তব্য রাখে বৈঠকে। তারাও রাখাইন রাজ্যে অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে রাখাইনে ত্রাণ সামগ্রীর অবাধ প্রবেশ নিশ্চিত করার দাবি জানায়। পাশাপাশি রাখাইন থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিজেদের বাসভূমিতে ফিরিয়ে নিতেও মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানায় দেশগুলো।

বাংলাদেশ : বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সংকট সমাধানের কিছু সুপারিশ হাজির করা হয়। সেগুলো হলো সহিংসতা বন্ধ ও মানবিক সহায়তা, মিয়নামার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে রাখাইন কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন, বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার ১৯৯২ সালের মিয়ানমার-বাংলাদেশ চুক্তি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উপস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের জন্য মর্যাদা, স্থিতিশীলতা ও সুরক্ষা ফিরিয়ে দেওয়া।

মিয়ানমার, চীন ও রাশিয়া : তবে অতীতের ধারাবাহিকতায় রোহিঙ্গা প্রশ্নে পুরনো অবস্থান ধরে রাখে মিয়ানমার। মিয়ানমারের জাতিসংঘ প্রতিনিধি এই সংকটের সব দায় চাপায় আরসার ওপর। মানবতাবিরোধী অপরাধ কিংবা জাতিগত নিধনের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে মিয়ানমারের প্রতিনিধি জানান, তারা আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে কাজ করছেন। মিয়ানমারের মিত্র রাষ্ট্র চীন ও রাশিয়াও বৈঠকে একই ভূমিকা নিয়েছে। মিয়ানমারের মতো করেই তারা রাখাইন সংকটকে বহুপক্ষীয় সংঘাত আকারে হাজির করেছে। সংকটকে তারা ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যকার সংঘাত হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বাংলাদেশে ¯্রােতের মতো করে হাজির হওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে তারা কোনও অবস্থান নেয়নি। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সংলাপের মধ্য দিয়ে এই সংকট উত্তোরণের তাগিদ দিয়েছে ওই দুই বৈশ্বিক পরাশক্তি।

সেনেগাল : আলোচনায় সেনেগালের প্রতিনিধি বলেন, ‘মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। তাদের ওপর চূড়ান্ত মাত্রার সহিংসতা চালানো হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ ও সরকার এসব জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়ে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছে। আমরা এই পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের সহিংসতার নিন্দা জানাই। পাশাপাশি এই মানবিক বিপর্যয়ের অবসানের আহ্বান জানাচ্ছে সেনেগাল।’ জাতিসংঘের মহাসচিবকে ধন্যবাদ জানিয়ে এবং রাখাইনের দুষ্টচক্রের অবসান ঘটানোর তাগিদ দিয়ে আরও বলেন, ‘চলমান এই পরিস্থিতিতে এক মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে। জাতিসংঘসহ সব ধরনের আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে এই পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে উদ্যোগ নিতে হবে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলো, বিশেষ করে আসিয়ান ও ওআইসিকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। এরই মধ্যে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে মিয়ানমার সংকট নিয়ে আলোচনা হয়েছে, নিরাপত্তা পরিষদেও আলোচনা হয়েছে। ওআইসি কাজ করছে। তবে রোহিঙ্গা সংকটে আনান কমিশনের প্রতিবেদনে এই সংকটের স্থায়ী সমাধানে বেশকিছু প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে।’ রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে অবিলম্বে রাখাইন রাজ্যে সব ধরনের সামরিক অভিযান বন্ধ, আক্রান্ত এলাকাগুলোতে ত্রাণ সহায়তা নিশ্চিত করা এবং রোহিঙ্গাদের নিরাপদে প্রত্যাবাসনের সুযোগ করে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমার সরকারকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। বাস্তবায়ন করতে হবে আনান কমিশনের সুপারিশ।

মিসর : বৈঠকে মিসরের প্রতিনিধি বলেন, ‘মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা হত্যাযজ্ঞের শিকার হচ্ছেন। এরই মধ্যে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। আমরা বিশ্বাস করি, কোনও পক্ষেই ঘৃণা, উসকানিমূলক কথাবার্তা বা সহিংসতা কাম্য নয়। নিজ দেশের মানুষকে রক্ষা করা প্রতিটি দেশের সরকারের দায়িত্ব। কোনও উগ্রগোষ্ঠীর সহিংসতার অজুহাতে বেসামরিক নাগরিকদের জীবন বিপন্ন করা গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা মনে করি, এ সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব হচ্ছে মিয়ানমারকে তার বেসামরিক জনগণের সুরক্ষায় ব্যবস্থা নিতে চাপ দেওয়া। কফি আনান কমিশনের সুপারিশের আলোকে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। মুসলিম রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করতে হবে’। এ সংকট সমাধানে মিয়ানমারের সঙ্গে আমরা সংলাপে প্রস্তুত। বাংলাদেশ বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। আমাদের উচিত এ সময়ে দেশটিকে সব ধরনের সহযোগিতা করা।’ রোহিঙ্গাদের নিজ এলাকায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করা ও রাখাইনে নির্যাতিতদের কাছে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহায়তা নিশ্চিতেরও আহ্বান জানান মিসরীয় প্রতিনিধি।

সুইডেন : বৈঠকে সুইডেনের প্রতিনিধি বলেন, ‘মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন বিপর্যয়কর অবস্থায় পৌঁছে গেছে। এক মাসেরও কম সময়ে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দুই-তৃতীয়াংশ বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। এরই মধ্যে এটি সবচেয়ে করুণ শরণার্থী পরিস্থিতি বলে আখ্যায়িত হয়েছে। আমরা মনে করি, রোহিঙ্গাদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলা সমস্যার সমাধান না হওয়ায় এ অমানবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ লক্ষ্যে আন্তর্জতিক সম্প্রদায় মিয়ানমার সরকারকে সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত। কিন্তু সরকারকে তার রেটরিক বন্ধ করতে হবে। রোহিঙ্গারা যে অসহনীয় দুর্ভোগে পড়েছে, তাকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে হবে। মিয়ানমারে সৃষ্ট এ সংকট সমাধানে নিরাপত্তা পরিষদকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। একইসঙ্গে রাখাইনে মানবিক সহযোগিতার জন্য আসিয়ান ও জাতিসংঘের সব সংস্থার প্রতি আমরা আহ্বান জানাই।’ রোহিঙ্গা ইস্যুকে জটিল ও বহুমাত্রিক অভিহিত করে তিনি বলেন, ‘এখন যে সহিংসতা হচ্ছে এটি সত্যিই গভীর উদ্বেগজনক। সেখানে রোহিঙ্গারা লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার শিকার হচ্ছে। আমরা মনে করি, রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গভীর মনোযোগ দরকার।’ কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশের উদারতা ও মানবিক সহযোগিতার প্রশংসা করেন সুইডেনের এই প্রতিনিধি। তিনি বলেন, ‘আমরা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে সামরিক বাহিনীর অভিযান, সব রকমের সহিংসতা ও বৈষম্য বন্ধের আহ্বান জানাই। প্রতিবেশী দেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হওয়া রোহিঙ্গা মুসলিমদের তাদের নিজ দেশে নিরাপদ, স্বেচ্ছায় ও সসম্মমানে ফেরা নিশ্চিত করতে হবে মিয়ানমারকে। কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে মিয়ানমারকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে হবে। রাখাইনে শান্তি ফেরাতে আন্তঃসম্প্রদায়গত উত্তেজনা ও অবিশ্বাস নিরসন করতে হবে। মিয়ানমার সরকারকেই এ জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।’

ফ্রান্স : নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে ফ্রান্সের প্রতিনিধি বলেন, ‘মিয়ানমারে এখন জাতিগত নিধন চলছে। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের কয়েকশ গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। একমাসের মধ্যে ৫ লাখের বেশি মানুষ প্রতিবেশী দেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আমরা দ্রুত পদক্ষেপ না নিতে পারলে সমস্যা দীর্ঘায়িত হবে। এই সংকট সমধানে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান বের করতে হবে। বৈষম্য না করে সবার নিরাপত্তা রক্ষা করতে হবে। মানবিক সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে, জাতিসংঘের সংস্থাগুলোকে ত্রাণ কর্যাক্রম চালাতে দিতে হবে।’ রোহিঙ্গাদের মানবিক এই সংকটে পাশে দাঁড়ানোয় বাংলাদেশের প্রশংসা করেন ফ্রান্সের প্রতিনিধি। এসময় তিনি বাংলাদেশের প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তা করার আহ্বান জানান। পাশাপাশি এই সংকট সমাধানে জাতিসংঘের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

কাজাখস্তান : বৈঠকে কাজাখস্তানের প্রতিনিধি বলেন, ‘রাখাইন রাজ্যের চলমান পরিস্থিতিতে মিয়ানমার সরকারের ভূমিকা প্রতিবেশী দেশগুলোতে সন্ত্রাসবাদ উসকে দিতে পারে। তাই এই সংকট নিরসন জরুরি। আর এর জন্য অবিলম্বে রাখাইনে সামরিক বাহিনীর অভিযান বন্ধ করতে হবে। রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে হবে। জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থাগুলো যেন নিরাপদে রাখাইনে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।’ রাখাইন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেওয়া পাঁচ লাখ রোহিঙ্গার সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

ইতালি : ইতালির প্রতিনিধি বলেন, ‘আমাদের সামনে সুযোগ রয়েছে মিয়ানমারের এই সংকট নিরসনের। সেই সুযোগ আমরা না নিতে পারলে তা হবে দুঃখজনরক। এই জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি সংকট নিরসনে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। এই সংকটের অন্যতম মূলে রয়েছে রাখাইনের পিছিয়ে পড়া অর্থনৈতিক অবস্থা। তা উত্তরণে কাজ করতে হবে।’ চলমান সংকটে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় ও তাদের প্রতি সংহতি জানানোয় বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানান ইতালির প্রতিনিধি। এই সংকট নিরসনে আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারকে গঠনমূলক আলোচনায় অংশ নিতে হবে। স্বেচ্ছায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত নিতে হবে। রোহিঙ্গাদের মাঝে তাদের আস্থা গড়ে তুলতে হবে। আন্তঃধর্ম সংলাপ আয়োজন করতে হবে। পাশাপাশি যারা যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’ এই সংকট নিরসনে ইতালি সব ধরনের সহায়তা করতে প্রস্তুত বলে জানান তিনি। আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) নিন্দা জানান ইতালির প্রতিনিধি। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা নারী-শিশুদের ওপর যে নির্যাতন চলছে, তা কোনোভাবেই সহ্য করার মতো নয়। রোহিঙ্গারা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত, বৈষম্যের শিকার। রাখাইনে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর, বিশেষ করে ইউএনএইচসিআরের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।’

ইউক্রেন : রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানিয়ে ইউক্রেনের প্রতিনিধি বলেন, ‘বেসামারিক জনগণের ওপর নির্যাতন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিশেষ করে নারী-শিশুদের ওপর যেন নির্যাতন না হয়, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।’ মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়া গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ইউক্রেন চলমান মানবিক সংকটে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিচ্ছে। তাদের ধন্যবাদ জানাই। তবে দেরি হওয়ার আগেই রাখাইনে সব ধরনের সামরিক কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। অত্যন্ত জটিল ও সংবেদনশীল এই ইস্যুর সমাধান স্বল্প সময়ে সম্ভব নয়। তবে আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে এর সমাধান সম্ভব। এ জন্য এই কাউন্সিল ও আন্তর্জাতিক মহলকে এখনই সক্রিয় হয়ে উঠতে হবে। তা না হলে পরিস্থিতির আরও অবনতিই ঘটবে।’ চলমান সংকটে উরুগুয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে উল্লেখ করে দেশটির প্রতিনিধি আলোচনায় বলেন, ‘মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। এর আগেও সেখানে অনেক সহিংসতা হয়েছে। স্বচ্ছতার সঙ্গে এসব অভিযোগের তদন্ত করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা রাখাইনে আরসা গ্রুপের সন্ত্রাসী হামলারও নিন্দা জানাই। তবে বেসামরিক জনগণকে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। ফলে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তাও মিয়ানমার সরকারকেই দিতে হবে। এ জন্য অবিলম্বে রাখাইনে সামরিক তৎপরতা বন্ধ করতে হবে এবং ত্রাণ সহায়তা উন্মুক্ত করতে হবে।’

উরুগুয়ে : মিয়ানমারের এই সহিংস পরিস্থিতি সন্ত্রাসবাদকে উসকে দিতে পারে উল্লেখ করে উরুগুয়ের প্রতিনিধি বলেন, ‘আমরা মনে করি, সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন অন্যান্য সন্ত্রাসী দলগুলোকেও উদ্বুদ্ধ করবে। বিশেষ করে আল কায়েদা বা আইএসের মতো জঙ্গি সংগঠনগুলোকেও এই অঞ্চলে প্রবেশ করতে উৎসাহিত করবে।’ সে কারণেই অবিলম্বে এই সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানান তিনি। পাশাপাশি লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশকেও ধন্যবাদ জানান তিনি।

ইথিওপিয়া : মিয়ানমারে মানবিক সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে বলে বৈঠকে মন্তব্য করেন ইথিওপিয়ার প্রতিনিধি। তিনি বলেন, ‘এই সংকট নিরসনে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তবে আরও বেশি কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে। আনান কমিশনের প্রস্তাব কার্যকরী হতে পারে। আমরা মিয়ানমার সরকারের মন্ত্রী পর্যায়ের কমিটি গঠনের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। বাংলাদেশ ও আসিয়ান সদস্যদের সহায়তা এই সংকট নিরসনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’

বলিভিয়া : বলিভিয়ার প্রতিনিধি নিরাপত্তা পরিষদের এই বৈঠকে বলেন, ‘এরই মধ্যে রাখাইনের প্রায় পাঁচ লাখ মুসলিম সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। আরও অনেকে অভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু হয়েছে। রাখাইনে রোহিঙ্গারা যে সহিংসতার শিকার হয়েছে, তার তদন্ত হতে হবে। এসব সহিংসতায় কেবল রোহিঙ্গা নয়, সংখ্যালঘু সব সম্প্রদায়ই নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে এই সংকট নিরসন করা সম্ভব।’

রোহিঙ্গা সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি সংলাপ ও আলোচনার আহ্বান জানান বলিভিয়ার প্রতিনিধি। তিনি বলেন, ‘রাখাইনে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে জাতিগত পরিচয় ভুলে সব মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নিতে হবে। কফি আনান কমিশনের রোডম্যাপে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ বাতলে দেওয়া আছে। সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে।’ রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এই সংকটের অন্যতম সমাধান হলো রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে হবে। তবে সেই প্রক্রিয়ার আগে এখনই তাদের জন্য কোনও ধরনের স্বীকৃতিসহ স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও সব ধরনের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এটা নিশ্চিত করতে হবে যেন তারা রাষ্ট্রের সব ধরনের সুবিধা পায়।’

কূটনীতিকরা রোহিঙ্গা ইস্যুতে সংলাপের ব্যাপারে একমত হয়েছেন। সংলাপের অংশ হিসেবে আগামী সপ্তাহে রাখাইন তদন্ত কমিশনের প্রধান সাবেক মহাসচিব কফি আনানকে নিরাপত্তা পরিষদে আমন্ত্রণ জানানো হবে। পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে তদন্তের অভিজ্ঞতা বিনিময় করবেন তিনি।

রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য ১৩শ স্কুল করবে ইউনিসেফ

মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য ১৩শ’র অধিক স্কুল স্থাপন করবে ইউনিসেফ। বর্তমানে ইউনিসেফ কক্সবাজারের অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে শিশুদের জন্য ১শ’ ৮২টি স্কুল পরিচালনা করছে এবং এতে ১৫শ’র মত শিশু শিক্ষা লাভ করছে বলে গতকাল শুক্রবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

আগামী বছরের মধ্যে পরিধি বৃদ্ধি করে ১৫শ’ থেকে ২ লাখ রোহিঙ্গা শিশুকে এই কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা আছে ইউনিসেফের। শীর্ষনিউজ।

সংস্থাটির বাংলাদেশ প্রতিনিধি এডওয়ার্ড বেগবেডার বলেন, এই সংকটপূর্ণ সময়ে রোহিঙ্গা শিশুরা অনেক বেশি ভুক্তভোগী, এই সময়ে তাদের নিরাপদ ও প্রাকৃতিক পরিবেশে শিক্ষার সুযোগ দেওয়া উচিত।

তিতিন আরো বলেন, এখনই তাদের পর্যাপ্ত স্বাভাবিক জ্ঞানের প্রয়োজন, যাতে তারা তাদের ভবিষ্যৎ গড়তে পারে।

Check Also

ট্রাইব্যুনালে আ.লীগ নেতাদের বিচার দেখতে এসে যা বললেন সাঈদী পুত্র

জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া সাবেক ৯ মন্ত্রীসহ ১৩ জনকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।