পঞ্চানন মল্লিক
দেখতে দেখতে বছর ঘুরে আবার এলো সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। দীর্ঘ একটি বছর হিন্দু ধর্মের ভক্তবৃন্দ অধির আগ্রহে দিন গুণতে থাকবে, কখন আসবে সেই মাতৃ আগমনের ক্ষণ। ভক্তের মঙ্গল কামনায় কাঙ্খিত সে শুভক্ষণে মা পতিগৃহ কৈলাশ ছেড়ে পিতৃগৃহ বসুন্ধরায় আসবেন। আনন্দে মুখর হবে চারিদিক। বাজবে মঙ্গল ঘন্টা। মায়ের শ্রীচরণ স্পর্শ লাভে ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষমান ভক্ত হৃদয় যেন গেয়ে ওঠে, ‘এসো মা-এসো মা, এসো দুর্গতি নাশিনী দুর্গা মা। কর পল্লবখানি রেখে ঐ রাঙা পায়, আমরা ভক্তবৃন্দ ডাকিগো মা তোমায়। জগতের মহা মঙ্গলও কামনায়, মর্তে নেমে এসো মা। একহাতে শঙ্খ-একহাতে ঘন্টা, ত্রিশুলো লয়ে এসো মা উগ্রচন্ডা। অসুর বধিতে এসো অসুর বিনাশিনী, রুদ্র মুর্তি ধরে গিরিরাজ নন্দিনী। দানবের কারাগারে যে আজ বন্দিনী, মুক্ত কর তারে মা। এসো মা –এসো মা। ভক্তের এ আহবানে সাড়া দিয়ে অবশেষে মা পা রাখেন এ মর্ত্য ধামে। সঙ্গে আসেন ছেলে-মেয়ে গনেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী, সরস্বতী। এই আগমন এবং পরবর্তীতে প্রস্থানে একেক বছর একেক বাহন হয় মায়ের। কখনো তিনি আসেন গজে, কখনো ঘটক, কখনো নৌকা আবার কখনো দোলায় চড়ে। আবার ফিরে যান ঠিক এই চার বাহনের যেকোন একটিতে করে। এই বাহনেই নির্ধারণ হয় মর্ত্যবাসী জীবের এক বছরের শুভ-অশুভ, ভালো-মন্দ। মহালয়ার দিনই সুচনা হয় মায়ের আগমনী পর্বের। ঐদিন মন্দিরে মন্দিরে চন্ডী পাঠের মাধ্যমে দেবী দুর্গাকে মর্ত্যালোকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এদিন থেকে দেবী পক্ষ এবং দুর্গাপূজার ক্ষণ গণনা শুরু। এদিন দেব-দেবীকূল পূজার জন্য নিজেদেরকে জাগ্রত করেন। এর ঠিক সাতদিন পরে ষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে দুর্গোৎসবের শুরু। মাকে পেয়ে ভক্তবৃন্দ আনন্দে গেয়ে ওঠেন, ‘মা এসেছে বাপের বাড়ি সঙ্গে ছেলে মেয়ে, আমরা আনন্দ করি মাকে কাছে পেয়ে। বোধনের বাজনা বাজে মন্দিরের মাঝে, নবরূপে এলেন আবার আমাদের মা-যে। বরণ করে নিলাম তারে রক্ত জবা দিয়ে।। মাকে পেয়ে আমরা যত পাপি-তাপীর দল, চোখের জলে ভিজিয়ে দেব মায়ের চরণ তল। হৃদয়ের লোভ লালসা দিয়ে বিসর্জন, মায়ের পায়ে করব মোরা আত্ম সমর্পন। জড়ো হাতে মায়ের কাছে নেব কিছু চেয়ে। ঠিক এমনি করে যেন একদিন ব্যাকুল হয়েছিল রাজা সুরাথার মন। মারকেন্দীয় পুরান মতে, চেদী রাজ বংশের রাজা সুরাথা খ্রিষ্টের জন্মের ৩০০ বছর আগে কলিঙ্গে (বর্তমানে উড়িষ্যায়) দুর্গা পূজার প্রচলন করেছিলেন। হারানো রাজ্য ফিরে পাবার অভিপ্রায়ে মূলত তিনি এ পূজা করেছিলেন। ত্রেতা যুগে লংকার রাজা বারন সীতাকে হরন করলে তাঁকে উদ্ধারের জন্য ব্রহ্মার পরামর্শে রামচন্দ্র প্রথম শরৎকালে দেবীর পূজা করেন। এ পূজা ‘অকাল বোধন’ বা শারদীয় দুর্গাপূজা নামে পরিচিত। পূজা আসলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মন ভরে ওঠে হাসি আনন্দে। পূজা প্যান্ডেলগুলো ভরে ওঠে মানুষের মিলন মেলায়। ছোট বড়, ধনী-দরিদ্র, ছেলে বুড়ো, নারী পুরুষ সবাই ভিড় করে মন্দিরে। মেতে ওঠেন জগজ্জননীর বন্দনায়, ধর্মীয় আরাধনায়। সবাই এক সুরে গেয়ে ওঠেন, ‘দশভূজা মা, অসুর বধকারিনী। জগতের কল্যাণ দাত্রী, পাপ-তাপ হারিনী। শান্তির সুধা নিয়ে এলে এই দুনিয়ায়, ভবো সংসার চলে মাগো তব করুণায়। পাপ-তাপ ঘোচে মাগো তব কৃপায়, চিত্তের আনন্দ দামিনী।। করে লয়ে কুসুম ডাকি মাগো তোমায়, শত কোটি প্রনাম ও দু’টি রাঙা পায়। পাপি-তাপী অনাথের পরম আশ্রয়। কাঙালের বিপদ তারিনী। দশ ভূজা মা।” প্রতিদিন পূজা শেষে হয় অঞ্জলী পর্ব। ভক্তবৃন্দ উপোস থেকে পূজা শেষে পুষ্পাঞ্জলী দেন। মায়ের কাছে কয়মনো বাক্যে সুখ সমৃদ্ধি, উন্নতি চেয়ে, নিজের ও সন্তানের রোগমুক্তি, পাপমুক্তি চেয়ে প্রার্থনা জানান। দুর্গতি নাশিনী মা তাদরেকে সকল বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করবেন এই থাকে তাদের কামনা বাসনা। পূজা উপলক্ষে ষষ্ঠী থেকে নবমী পর্যন্ত প্রতিদিন সন্ধ্যায় মন্দিরে চলে সন্ধ্যারতি। ঢাকের বাদ্যের তালে নানা রকম অঙ্গ ভঙ্গিমায় মাকে বরন করেন নৃত্য শিল্পীরা। পূজা উপলক্ষে বসে মেলা বা বাজার। বাজারে থাকে উপচে পড়া ভিড়। মিষ্টান্ন, খেলনা, কসমেটিক্স বিক্রি হয় দেদারছে। কোন কোন জায়গায় পূজা উপলক্ষে রাতে ধর্মীয় যাত্রাপালা, মনোজ্ঞ সাং¯কৃতিক অনুষ্ঠানও অনুষ্ঠিত হয়। এসব অনুষ্ঠানে সমবেত হয়ে মানুষ ক্ষণিকের জন্য হলেও হাসি আনন্দে মেতে ওঠেন। সার্ব্বজনীন দুর্গোৎসব পরিনত হয় মানুষের মিলন তীর্থে। চারিদিকে বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। জাতি ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এ পূজায় আজকাল সকলেই সমবেত হন। ধর্মীয় সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশে এ পূজা হৃদয়ে হৃদয়ে সৌহার্দের মেল বন্ধন সৃষ্টি করুক এমনটি আমাদের প্রত্যাশা।