আগামী জাতীয় সংসদ ও পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ইলেকশন কমিশনকে (ইসি) কারিগরি সহায়তা দেয়ার আশ্বাস দিয়েছে জাতিসংঘ। বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনে পাঠানো এক চিঠিতে এ আশ্বাস দেয়া হয়।
এতে ইসিকে জানানো হয়েছে, শিগগিরই জাতিসংঘের ‘প্রজেক্ট ফরমুলেশন টিম’ বাংলাদেশ সফরে এসে নির্বাচনী সহায়তা প্রকল্প তৈরি করবে।
ওই প্রকল্পের আওতায় নির্বাচনী উপকরণ কেনা, নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ এবং ভোটার এডুকেশনসহ বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতা করা হবে। সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিএনপিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দলের বর্জনের মুখে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
এর পরের বছর ২০১৫ সালের মাঝামাঝিতে ইসি শক্তিশালীকরণ সংশ্লিষ্ট একটি প্রকল্পের মেয়াদ শেষের আগেই তাতে অর্থছাড় বন্ধ করে দেয় জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)।
‘স্ট্রেংথিং ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট ইন বাংলাদেশ (এসইএমবি)’ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১১ সালে শুরু হয়ে ২০১৬ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশন সব দলকে নিয়ে নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দেয়ার পর নির্বাচনী সহায়তায় নতুন প্রকল্প নেয়ার কথা ইসিকে জানাল জাতিসংঘ। আর এ সহায়তা দেয়ার ঘোষণা ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে কমিশন।
ইসির নির্বাচন পরিচালনা-১ শাখা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারির মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ওই নির্বাচনের পরপরই ২০১৯ সালের প্রথমার্ধে পঞ্চম উপজেলা পরিষদের ভোট গ্রহণ করার কথা রয়েছে নির্বাচন কমিশনের।
এ কারণে দুটি নির্বাচনের উপকরণ একসঙ্গে কেনার পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। জাতীয় সংসদ ও উপজেলা নির্বাচনে কী পরিমাণ অফিসিয়াল সিল, মার্কিং সিল, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের সিলসহ (লক) নির্বাচনী সামগ্রীর প্রয়োজন হবে তার সম্ভাব্য সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে। শিগগিরই এসব উপকরণ কোন প্রক্রিয়ায় এবং কীভাবে কেনা হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত চেয়ে ফাইল তোলা হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব মো. মোখলেসুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন কমিশনে এসেছে। পুরো প্রতিবেদন না পড়ে মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে এটুকু বলা যায়, নির্বাচনে উপকরণ কেনা বা কারিগরি সহায়তা দিতে জাতিসংঘ ইতিবাচক মত দিয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জাতিসংঘের সহায়তায় একটি প্রকল্প তৈরি করা হবে। পাশাপাশি কমিশনের নিজস্ব উদ্যোগে নির্বাচনী উপকরণ কেনার প্রস্তুতিও রাখা হবে।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারি বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এর আগের ৯০ দিনের মধ্যে ভোট গ্রহণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এছাড়া ২০১৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত পাঁচ দফায় ৪৬৮টি উপজেলা পরিষদের ভোট গ্রহণ করা হয়। ওই সব উপজেলার মেয়াদ ২০১৯ সালের প্রথমার্ধে শেষ হবে। এর আগেই এসব উপজেলায় ভোট গ্রহণ করতে হবে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার ইসিতে পাঠানো জাতিসংঘের চিঠির সঙ্গে সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া নিডস অ্যাসেসমেন্ট মিশনের (মূল্যায়ন মিশন) প্রতিবেদনও রয়েছে। ওই প্রতিবেদনে নির্বাচনী উপকরণ কেনা, নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, ভোটার এডুকেশনসহ বাংলাদেশের চাওয়া বিভিন্ন সহায়তা পূরণের আশ্বাস দেয়া হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়েছে, শিগগিরই জাতিসংঘের প্রজেক্ট ফরমুলেশন টিম বাংলাদেশ সফরে আসবে। ওই টিম প্রকল্প তৈরির কাজ করবে। এরপরই ওই প্রকল্প চূড়ান্ত করা হবে। তবে প্রকল্পের মেয়াদ কতদিন হবে তা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। ইসির সংস্থাপন শাখা সূত্রে জানা গেছে, গত আগস্টে জাতিসংঘের পাঁচ সদস্যের মূল্যায়ন মিশন বাংলাদেশ সফর করে।
সংস্থাটির ইলেক্টোরাল অ্যাসিস্ট্যান্স কার্যালয়ের পাবলিক আউটরিচ অ্যাডভাইজার সভেতলানা গালকিনার নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলে ছিলেন লার্স জোসেফ আলফোনস ডি গিয়ার ও ইয়াও ইভরাড কুয়াডিও।
পরে গত ১৪ জুন বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী রবার্ট ডি ওয়াটকিনসের কাছে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫ ধরনের কারিগরি সহায়তা চেয়ে চিঠি দেয় নির্বাচন কমিশন।
ইসির সাবেক সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ স্বাক্ষরিত এ চিঠিতে যেসব বিষয়ে কারিগরি সহায়তা চাওয়া হয় তার মধ্যে রয়েছে- ১. সক্ষমতা বৃদ্ধি, ভোটার সচেতনতা সৃষ্টি, ইলেকশন অবজারভার মিশন ইত্যাদি।
২. নির্বাচনী উপকরণ যথা অমোচনীয় কালির কলম, ইসির মনোগ্রামযুক্ত অটো মার্কিং সিল, ব্যালট পেপার মার্কিং পেন, ব্যালট বক্স সিল, অটো অফিসিয়াল সিল, ভোটিং স্ক্রিন ইত্যাদি।
৩. জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেমসের (জিআইএস) সহায়তায় সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ।
৪. আইটি নির্ভর নির্বাচন ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন (অভিযোগ ব্যবস্থাপনা, প্রার্থীদের প্রচারণা ও ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ম্যানেজমেন্ট, নির্বাচন তফসিল ঘোষণা, প্রার্থীর তথ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি)।
৫. নির্বাচনী আইন ও জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত সাপোর্ট ইত্যাদি।
নির্বাচনে কী পরিমাণ উপকরণ লাগবে : নির্বাচন পরিচালনা-১ শাখার উপসচিব মো. শাহেদুন্নবী চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক কার্যপত্রে দেখা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অফিসিয়াল সিলের প্রয়োজন হবে ২ লাখ ৭৪ হাজার এবং উপজেলা পরিষদের জন্য ৩ লাখ ৪ হাজার।
সম্ভাব্য ভোটকক্ষের সংখ্যার চেয়ে ৫ শতাংশ বেশি ধরে এ হিসাব করা হয়েছে। একইভাবে সংসদ নির্বাচনে ৫ লাখ ৪৮ হাজার এবং উপজেলা নির্বাচনের জন্য ৬ লাখ ৮ হাজার মার্কিং সিল কেনার প্রয়োজন হবে। সংসদ ও উপজেলা পরিষদের জন্য স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের লক লাগবে ৩৪ লাখ ৪০ হাজার।
নবম ও দশম জাতীয় সংসদ এবং চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের লক এসইএমবি প্রকল্পের আওতায় ইউএনডিপি সরবরাহ করেছিল। কিন্তু ওই প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ২০১৬ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের লক বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি থেকে কেনা হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আগামী নির্বাচনে সম্ভাব্য ভোট কেন্দ্র ৪৩ হাজার ৩৬৩টি ও ভোটকক্ষ ২ লাখ ১৭ হাজার ৪৪০টি ধরা হয়েছে। দশম জাতীয় নির্বাচনে ৩৭ হাজার ৭০৭টি ভোট কেন্দ্র ও ১ লাখ ৮৯ হাজার ৭৮টি ভোটকক্ষ ছিল।
অপরদিকে ৪৯০টি উপজেলা পরিষদে সম্ভাব্য ভোট কেন্দ্র ৩৯ হাজার ৪৪৫টি এবং ২ লাখ ৫০ হাজার ৮১টি ভোটকক্ষ হতে পারে বলে ধারণা করছে নির্বাচন কমিশন। আগামী নির্বাচনে সম্ভাব্য ১০ কোটি ৫০ লাখ ভোটার ভোট দেবেন এমন হিসাব করে সম্ভাব্য এসব ভোট কেন্দ্র ও ভোটকক্ষের হিসাব তৈরি করা হয়েছে।