শেষ দিকে মোস্তাফিজ আর শুভাশিসের মারমুকি ব্যাটিং দেখে মনে হচ্ছিল, ওয়ানডে সিরিজের জন্যই প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ। পচেফস্ট্রমে লজ্জাজনক ৩৩৩ রানে হারের পর ব্লুমফন্টেইনে যে ইনিংস ব্যবধানে পরাজয় ঘটতেছে, তা মোস্তাফিজরা হয়তো বুঝে গিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম ইনিংস শেষেই। ফলো অনে পড়ার পরও লিটন দাস কোনো কোনো ব্যাটসম্যানের ডাবল সেঞ্চুরি এবং দলীয় ৬০০ রানের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন; কিন্তু বাস্তবতা যে তার চেয়ে অনেকদুর, সেটা বোধকরি তখনও বুঝতে পারেননি বাংলাদেশের এই ব্যাটসম্যান।
ক্রিকেট গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা ঠিকই। কিন্তু এতটা অনিশ্চয়তা তো কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। এ যেন সপ্তম আসমান জয় করে ফেলার অলিক কল্পনার মত। সেই অলিক কল্পনার ঘোর কাটিয়ে ওঠার আগেই দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশ অলআউট ১৭২ রানে। প্রথম ইনিংসে অলআউট হয়েছিলো ১৪৭ রানে।
ব্লুমফন্টেইনে তাই টেস্টের তৃতীয় দিনের লাঞ্চের পরপরই ইনিংস এবং ২৫৪ রানের ব্যবধানে হারতে হলো বাংলাদেশকে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এটাই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পরাজয়। যে যুগে বাংলাদেশ লড়াই করারও স্বপ্ন দেখতে সাহস পেতো না, তখনও এত বড় ব্যবধানে হারেনি টাইগাররা। এখন যখন লড়াই নয়, জয়ের স্বপ্ন দেখার সাহস তৈরি হয়েছে, তখন পরাজয় মানতে হয় আগের চেয়েও বড় ব্যবধানে। স্বপ্নের ঘোরে থাকা লিটন কুমার দাস বোল্ড হয়েছিলেন ১৮ রানে। যদিও প্রথম ইনিংসে তিনি করেছিলেন সর্বোচ্চ ৭০ রান।
ঘরের মাঠে শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার সাথে ১-১ এ টেস্ট সিরিজ ড্র করেছিল মুশফিকুর রহীম অ্যান্ড কোং। সেই সুখস্মৃতি নিয়েই দক্ষিণ আফ্রিকা গিয়েছিল বাংলাদেশ টেস্ট দল। তবে সুখস্মৃতি কোন কাজেই লাগল না। দু প্লেসিস বাহিনীর কাছে যে ইনিংস ব্যাবধানে হেরে ‘ধবল ধোলাই’ হতে হলো বাংলাদেশ দলকে!
প্রথম ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকার করা ৫৭৩ রান তাড়া করতে নেমে প্রথম ইনিংসে মাত্র ১৪৭ রানে অল আউট হয়েছে বাংলাদেশ দল। ফলো অনে পড়ে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নামে সৌম্য-ইমরুলরা।
তৃতীয় দিন সকালে যখন বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ে নামে, তখন তাদের হাতে ছিল ১০ উইকেট আর পিছিয়ে ছিল ৪১৯ রানে। এই পাহাড় টপকাতে গিয়ে হয়তো রানের বোঝায় পিস্ট হয়ে একে একে সাজঘরে ফিরতে থাকে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা।
প্রথম ইনিংসে ৫ উইকেট নেয়া রাবাদা, এই ইনিংসেও তুলে নেন ৫টি উইকেট। তার সাথে প্রোটিয়া বোলার পেহলুকাইয়ো নেন ৩ উইকেট। ওয়েইন পারনেল ও অলিভিয়ের নেয় ১টি করে উইকেট।
প্রথম ইনিংসে করেছিলেন ৭০ রান। তারপরই লিটন কুমার দাস সংবাদ সম্মেলনে শুনিয়েছিলেন আশার বাণী। বলেছিলেন, দ্বিতীয় ইনিংসে রান ৬০০ করা সম্ভব। তবে সেটা কথার কথা হয়েই থাকল। স্কোরবোর্ডে ১৩৯ হতেই টাইগারদের ছয় ব্যাটসম্যান সাজঘরে। এরপর বাকিরা ফিরতে আর খুব বেশি সময় নেননি।
১০ উইকেট পুরো হাতে নিয়েই তৃতীয় দিন দ্বিতীয় ইনিংসে খেলতে নামে বাংলাদেশ; কিন্তু দিনের শুরুতেই মাত্র ৩ রানে সাজঘরে ফেরেন ওপেনার সৌম্য সরকার। রাবাদার বলটি সৌম্য সামনের পা এগিয়ে খেলতে গেলে ব্যাটের কোনায় লেগে দ্বিতীয় স্লিপের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যেতে শুরু করে। তবে দু প্লেসিস ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্যাচটি লুফে নেন।
ইনিংসের নবম ওভারের শেষ বলটি বাউন্স দেন রাবাদা। যেটিকে জাগিয়ে খেলতে গেলে ডিপ স্কয়ার লেগ অঞ্চলে দাঁড়ানো কেশব মহারাজের হাতে ক্যাচ তুলে দেন মুমিনুল। ফলে মাত্র ১১ রান করেই সাজঘরে ফিরতে হয় এই টেস্ট স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যানকে।
দিনের শুরুতেই দুই উইকেট হারিয়ে যখন ধুঁকছিল বাংলাদেশ, তখন এক পাশ আগলে ওয়ানডে স্টাইলে ব্যাটিং করে যাচ্ছিলেন ইমরুল কায়েস। তবে তাকে বেশিদূর এগোতে দেননি ওলিভিয়ের। এই বোলারের বল ছেড়ে দিয়ে অনেকটা ব্যাট দিয়ে খোঁচা মারতে গিয়ে ডি ককের হাতে ক্যাচ তুলে দেন ইমরুল। ফল, ৩২ রান করেই সাজঘরে ফিরতে হয় এই ওপেনারকে।
নিয়মিত বিরতিতে উইকেট পড়ার ধারাবাহিকতা ধরে রাখলেন মুশফিকুর রহীম। প্রোটিয়া পেসারদের একের পর এক বাউন্সারে কুপোকাত হতে হচ্ছিল বাংলাদেশকে। একবার তো অলিভিয়েরের বাউন্সারে মাথায় আঘাত পেয়েছেন মুশফিক। যে কারণে তাকে হাসপাতালে পর্যন্ত যেতে হলো। উইকেট যাওয়ার ধারাবাহিকতায় লাঞ্চের আগেই শেষ সংযোজন ছিল মুশফিকুর রহীম।
পারনেলের ওভারের পঞ্চম বলটি মুশফিক ছেড়ে দিলেও সামান্য প্যাডে লেগে উইকেট রক্ষকের হাতে যায়। সাথে সাথে আবেদন করেন পারনেল। আবেদনে সাড়াও দেন আম্পায়ার। তারপরও রিভিউ নিয়েছিলেন মুশফিক। তবে রিভিউ নেয়ায় ফল হয়নি। রিভিউতে স্পষ্টই দেখা গেছে তিনি এলবির ফাঁদে পড়েছেন। ফলে ২৬ রান নিয়েই মাঠ ছাড়তে হয়েছে টাইগার দলপতিকে।
লিটন কুমার দাস ১৮ রান করে পেহলুকাইয়োর বলে সরাসরি বোল্ড হয়ে সাজঘরে ফেরেন। এর পরের ওভারেই রাবাদার বলে এলগারের হাতে ক্যাচ তুলে সাজঘরে ফেরেন ওয়ানডে স্টাইলে খেলতে থাকা মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। আউট হওয়ার আগে মাহমুদুল্লাহর সংগ্রহ ছিল ৪৩। বাংলাদেশের ইনিংসে তিনিই ছিলেন সর্বোচ্চ সংগ্রাহক।
সাব্বির রহমান ১২ বল খেলে করলেন মাত্র ৪ রান। পেহলুকাইয়োর বলে দু প্লেসিসের হাতে ক্যাচ দিযে ফিরলেন তিনি। পরে যারা ব্যাট করতে নেমেছিলেন, তারা শুধুই নিয়মরক্ষা করতে মাঠে নেমেছিলেন। তাইজুল, রুবেল, সুভাশিস এবং মোস্তাফিজরা শুধু পরাজয়ের ব্যবধান কমিয়েছেন। শেষে তো ১০ বল খেলে শুভাশিস করলেন ১২ রান। বাউন্ডারিই মেরেছেন তিনি ৩টি। কোনো সিঙ্গেলস নেই। মোস্তাফিজ করেছেন ৭ রান। একটি মেরেছেন বিশাল ছক্কা।
প্রথম ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকার ৫৭৩ রানের বিপরীতে ব্যাট করতে নেমে গতকাল ১৪৭ রানেই অলআউট হয়েছে বাংলাদেশ। এক লিটন দাস ছাড়া বাকিরা ব্যস্ত ছিলেন আসা-যাওয়ার মিছিলে। দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটসম্যানদের জন্য যেটা ব্যাটিং স্বর্গ বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের জন্য সেটাই যেন মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছিল।