আত্মগোপনে থেকে জামায়াতে ইসলামীর নতুন নেতৃত্ব তাঁদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
প্রকাশ্যে কোন রাজনৈতিক কর্মসূচী ছিল না। তারা এমনকি কখনো গণমাধ্যমে মুখোমুখিও হতেন না।
জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান নেতৃত্ব ‘নীরব গণসংযোগের’ নীতি বেছে নিয়েছিল।
বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষক শাহ আব্দুল হান্নান সে সময় বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, ” ওনাদের রাজনীতি ১০-১৫ পার্সেন্ট থাকবে। ওনারা মেইনলি জনগণের মধ্যে ইসলামের যে লিটারেচার – অর্থনীতির ক্ষেত্রে, সমাজের ক্ষেত্রে বা রাজনীতির ক্ষেত্রে – সেগুলো পৌঁছানোর চেষ্টা করবেন। বেশি করে মিটিং, মিছিলে তারা যাবেন না।”
সরকারের দিক থেকেও দলটির শীর্ষ নেতৃত্বকে কোন ধরনের ধর-পাকড়ের মধ্যে রাখা হয়নি। যদিও তারা সবসময় গোয়েন্দাদের নজরদারীতে ছিলেন বলে জানা যায়।
কিন্তু গত সোমবার ঢাকার একটি বাসা থেকে জামায়াতে ইসলামীর আমীর, নায়েবে আমীর এবং সেক্রেটারিসহ নয়জনকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ।
জামায়াতে ইসলামী বলছে, ‘ঘরোয়া বৈঠক’ চলাকালে গোয়েন্দা পুলিশ এ গ্রেফতার অভিযান চালায়।
কিন্তু আকস্মিকভাবে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের কেন গ্রেফতার করা হলো?
জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, গত কয়েক বছরের অবস্থা পর্যালোচনা করলে এ গ্রেফতার অভিযানকে সেগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না।
প্রকাশ্যে রাজনৈতিক তৎপরতা না থাকলেও আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র জামায়াতে ইসলামী ভেতরে ভেতরে এক ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
বিভিন্ন জেলায় তাদের নেতা-কর্মীরা সাধারণ মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতার নামে নিজেদের নির্বাচনী প্রস্তুতিও গুছিয়ে রাখছিলেন।
জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির পর্যবেক্ষক এবং দৈনিক নয়া দিগন্তের নির্বাহী সম্পাদক সালাউদ্দিন বাবর মনে করেন, আগামী নির্বাচনের সাথে এ ধরনের গ্রেফতার অভিযানের সম্পর্ক আছে।
জামায়াতে ইসলামী যেহেতু অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি’র মিত্র সেজন্য আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জামায়াতে ইসলামীর সাথে মিলে বিএনপি যাতে কোন সুবিধা করতে না পারে সেজন্য দলটির উপর চাপ তৈরি করতে শীর্ষ নেতাদের আটক করা হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে।
মকবুল আহমাদ আমীর নির্বাচিত হবার পর থেকে জামায়াতে ইসলামী মনে করেছিল, সরকারের সাথে রাজপথে প্রকাশ্য রাজনৈতিক সংঘাতে না জড়ানোই ভালো।
২০১২ সাল থেকে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে যে সহিংসতা হয়েছিল, সেখানে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকাকেও মুখ্য হিসেবে দেখেছে সরকার। সে সময় সহিংসতায় ব্যাপক ভাঙচুর, যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল। এতে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়।
এছাড়া ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে এবং পরে সহিংসতার ক্ষেত্রে বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীর সম্পৃক্ততার অভিযোগ আনে সরকার।
সহিংসতার সেসব অভিযোগ থেকে জামায়াতে ইসলামী মুক্ত হতে চেয়েছে।
কারণ ২০১২ সাল থেকে দলটির অনেক নেতাকর্মী নিহত, আহত হয়েছেন। এমন অবস্থায় নিজেদের কৌশল বদলে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল জামায়াতে ইসলামী।
মি: বাবর বলেন, “জামায়াতে ইসলামীর যে নতুন নেতৃত্ব তারা মোটামুটিভাবে আইনের অধীনে থেকে দলটাকে শান্তিপূর্ণভাবে এগিয়ে নিচ্ছিলেন। একমাত্র রাজনৈতিক কারণ ছাড়া অন্য কোন কারণে তাদের আটকের কারণ দেখছি না।”
আগামী নির্বাচনে জামায়াত ইসলামী অংশ নিতে পারবে কি না সে এখনো পুরোপুরি অনিশ্চিত। কারণ রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল না হলে নির্বাচনে অংশ নেবার সুযোগ নেই। যদিও জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে নিষিদ্ধ কোন দল নয়। সরকারের একটি অংশ মনে করে জামায়াতে ইসলামীর উপর রাজনৈতিক চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। কারণ আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জামায়াতে ইসলামী কোন তৎপরতা করলে সেটি বিএনপিকেও লাভবান করবে।
জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন না থাকলেও দলটি তাদের নীরব কর্মকাণ্ড বন্ধ করেনি। বিভিন্ন জেলায় জামায়াতে ইসলামী তাদের প্রার্থীদের কিভাবে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করাতে পারে সেটি নিয়ে দলের ভেতর আলাপ আলোচনা চলছে।
দলটির এসব কর্মকাণ্ড সরকারের নজরে এসেছে। সে কারণেই শীর্ষ নেতৃত্বকে আটকের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামীর উপর চাপ তৈরি করার চেষ্টা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সালাউদ্দিন বাবর মনে করেন, যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর পূর্বের শীর্ষ নেতৃত্বের সাজা কার্যকর করার পরেও দলটি ছত্রভঙ্গ হয়নি।
“দলটা একটা চেইন অব কমান্ডে চলে। নেতা চলে যায় কিন্তু বিকল্প নেতা তৈরি হয়ে যায় বা বিকল্প নেতাকে সমাসীন করা হয়। কিছু সমস্যা তো হয়েছে। কিন্তু তারা মোটামুটিভাবে নিজেদেরকে একটা চেইন অব কমান্ডের আওতায় নিয়ে আসতে পেরেছে,” বলছিলেন মি: বাবর।
তবে জামায়াতে ইসলামী যাতে কোনভাবেই সংগঠিত হতে না পারে সেজন্য সরকার বরাবরই বেশ তৎপর ছিল।
দেশের যেখানেই জামায়াতে ইসলামীর কিছু নেতা বা কর্মী ঘরোয়াভাবে একত্রিত হয়েছে সেখানেই পুলিশের অভিযানের মাধ্যমে আটক করা হয়েছে।
জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের আটকের পেছনে কোন রাজনৈতিক কারণ আছে কি না সেটি নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা কোন মন্তব্য করতে রাজী হচ্ছেন না।
ক্ষমতাসীন দলের একজন সিনিয়র নেতা বিবিসি বাংলাকে বলেন, জামায়াত নেতাদের গ্রেফতারের সাথে রাজনীতির কোন সম্পর্ক নেই, বরং এটি আইনগত ব্যাপার।
তবে পুলিশ প্রধান একেএম শহিদুল হক বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, জামায়াতে ইসলামীর নেতারা একটি ‘গোপন বৈঠক’ করার জন্য একত্রিত হয়েছিল।
“তারা মামলার আসামী, তাদের অনেকের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট আছে। এখন জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। যে ওয়ারেন্ট আছে আমাদের কাছে, সে ওয়ারেন্টে আমরা আদালতে পাঠাবো,” বলছিলেন মি: হক।
পুলিশ প্রধান বলেন, জামায়াত ইসলামীর নেতাদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে প্রয়োজনে নতুন মামলাও হতে পারে।
রোহিঙ্গা ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতরা নতুন কোন পরিকল্পনা করছিলেন কি না সেটিও খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
তবে জামায়াতে ইসলামীর ওয়েব সাইটে এক বিবৃতিতে দলটির অন্যতম নায়েবে আমীর মুজিবুর রহমান বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর জামায়াতে ইসলামীকে তাঁর ভাষায় নেতৃত্বশূন্য করার জন্য যে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সে ধারাবাহিকতায় জামায়াতের নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে।