জামায়াতের নতুন কৌশল# রাজপথের কর্মসূচিতে নিষ্ক্রিয়#নাথিং স্পেশাল- শাহ আবদুল হান্নান #শান্তিপূর্ণভাবে করা হলে অবশ্যই সব মানুষের জন্য স্বস্তির অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম

জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ পুরনো। দলটির বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি মানেই ‘জ্বালাও-পোড়াও’ কর্মকাণ্ড। কিন্তু ২০১৬ সাল থেকে এই দলটির ভেতরে পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ওই সময় থেকে দলের নেতাকর্মীরা সাংগঠনিক কাজে সর্বোচ্চ মনোযোগ দেওয়া শুরু করেন। এই পরিবর্তনকে নেতাকর্মীরা দলের ‘রাজনৈতিক নতুন কৌশল’ বললেও জামায়াতপন্থী বুদ্ধিজীবীরা বিষয়টিকে দেখছেন ‘রাজনীতির স্বাভাবিক গতি-প্রকৃতি’ হিসেবেই। তারা বলছেন, দেশের অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রেও এমন পরিবর্তন ঘটে।

গত কয়েক বছরের মতো রাজপথের কর্মসূচিতে নিষ্ক্রিয় থাকতে দেখা গেছে দলটির ডাকা বুধবারের বিক্ষোভ ও বৃহস্পতিবারের হরতালেও। দলের আমির, সেক্রেটারি জেনারেলসহ শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে ডাকা এই দুই দিনের বিক্ষোভ-হরতালে নেতাকর্মীরা ঝটিকা মিছিল করলেও সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েননি। হরতালের আগের রাতেও দলের নীতি-নির্ধারণী-পর্যায় থেকে  ধৈর্য ধরার কঠোর নির্দেশনা ছিল। এছাড়া ১০ অক্টোবর ভারপ্রাপ্ত আমির হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর অধ্যাপক মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে দলের  সব নেতকর্মীকে ধৈর্য ও সহনশীলতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার আহ্বান জানান।

তবে জামায়াতের রাজনীতির পর্যবেক্ষক শাহ আবদুল হান্নান দলটির এই অবস্থানকে বড় ধরনের পরিবর্তন বলে মনে করছেন না। তিনি বলেন, ‘জামায়াত কমবেশি রাজনীতি সব সময়ই করে। কম করে তখনই, যখন তারা দেখে অত্যাচার বেশি, মারপিট বেশি, গুলি বেশি; তখন তারা রাজনীতি কম করে।’

বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়ে জামায়াতের রাজনৈতিক ভাষ্যকার শাহ আবদুল হান্নান বলেন, ‘এই সময়ে দলের নেতাকর্মীরা বইপত্রে চলে যান। মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ান। বিভিন্ন রকমের দাওয়াতি কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন।’ জামায়াতের রাজনৈতিক পরিবর্তন বিষয়ে তিনি আরও বলেন, ‘দলটির দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে, সম্ভব হলে সমাজকে ইসলামের পথে চালিত করা। জামায়াত নীতিগতভাবে শক্তি প্রয়োগের রাজনীতির বিরুদ্ধে। কারণ, ইসলামে কোনও জবরদস্তি নেই। এসব কারণে জামায়াতের কৌশল এমন।’

শাহ আবদুল হান্নান প্রশ্ন রাখেন, ‘অন্য কোনও পার্টির কৌশল চেঞ্জ হয় না?’ সাবেক এই সচিব যুক্ত করেন, ‘বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের অবস্থান দেখুন। পঁচাত্তরে এক রকম ছিল, এখন আরেক রকম।’

ইসলামী ব্যাংকের সাবেক এই চেয়ারম্যান জোর দিয়ে বলেন, ‘এটা তো হতেই পারে। এটা তো এমন কিছু না যে, জামায়াতের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে ঘটছে। নাথিং স্পেশাল। এটা স্মল-ন্যাচারাল। কিন্তু জামায়াতের বিষয়টি লোকে বেশি করে দেখে। এর বিরুদ্ধে এত প্রোপাগান্ডা! সবকিছু ভালো করে দেখতে চায় জনগণ।’  তিনি বলেন, ‘যখন ঘরে বসতে দেবে না, মিটিং করতে দেবে না, তখন তো স্বাভাবিক যে, দলটি নীরব থাকবে।’

জামায়াতের রাজনীতি নীরবতার বিষয়টিকে শাহ আবদুল হান্নান স্বাভাবিক বিষয় বললেও  রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা বলছেন, একাত্তরে বাংলাদেশ ভূমিকার পর বিতর্কিত এই দলটি জিয়াউর রহমানের সময়ে রাজনৈতিক বৈধতা পায়। এরপর নতুন উদ্যমে  রাজনীতি শুরু করে। এরপর আশি ও নব্বইয়ের দশকে রাজশাহী, চট্টগ্রামে জামায়াত ও দলটির অনুজ সংগঠন ছাত্র শিবিরের বিরুদ্ধে রগকাটা ও ছাত্রনেতাদের হত্যাসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। এমনকি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচার কার্যক্রম শুরুর পর ২০১১, ১২, ১৩ ও ১৪ সালে দেশব্যাপী জামায়াত-শিবির তাণ্ডব চালিয়েছিল। এছাড়া চাঁদে সাঈদীকে দেখার গুজব ছড়িয়ে সারা দেশে বিপুল পরিমাণ বৃক্ষনিধনের ঘটনাও ঘটিয়েছিল দলটি।

বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক যতীন সরকার মনে করেন, ‘জামায়াতের রাজনৈতিক আদর্শই বিভ্রান্তিজনক। তারা বাংলাদেশ সৃষ্টির সময় বিভ্রান্ত হয়েছে। এরপরও তাদের বিভ্রান্তি ছিল, এখনও আছে। সরকার কঠোর হওয়ায় হয়তো তারা নীরব আছে। কিন্তু সুযোগ পেলেই তারা স্বমূর্তিতে ফিরে আসবে।’

২০১৬ সালের ১৭ অক্টোবর সোমবার সকাল ১০টায় কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সামনে নির্বাচিত আমিরের বক্তব্যে মকবুল আহমাদ বলেন, ‘‘সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে ইসলামের নামে যেকোনও ধরনের চরমপন্থা-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জামায়াত-ঘোষিত ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে।’’ সাংগঠনিক কার্যক্রমের ওপর জোর দিয়ে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘প্রত্যেককে স্ব-উদ্যোগে দাওয়াতি কাজ ও নিজের পরিবার গঠনের প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। ব্যক্তিগত যোগাযোগ বৃদ্ধি ও সব ধরনের সাংগঠনিক কর্মসূচিকে মানসম্মত ও সময়োপযোগী করতে হবে। আমাদের কার্যক্রমের সঙ্গে জনগণকে আরও ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করে সংগঠনকে জনগণের দলে পরিণত করতে হবে। জাতীয় সংহতি ও ভৌগলিক অখণ্ডতার চেতনায় উদ্বুদ্ব হয়ে দেশের স্বাধীনতা-স্বার্বভৌমত্ব রক্ষায় ভূমিকা পালন করতে হবে।’

মকবুল আহমাদের পরিচালনা-নীতির পুরোটা জামায়াতে গ্রহণ করে। এর সুফল আসে পরবর্তী কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার দু’টি অধিবেশনে। চলতি বছরের জুলাই ও সেপ্টেম্বরে অঞ্চলভেদে অনুষ্ঠিত মজলিসে শুরার অধিবেশনে সদস্যরা দলের সাংগঠনিক কার্যক্রমের ওপর জোর দেওয়ার পক্ষে মত দেন। এ বিষয়ে ঢাকা, ফেনী, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহীসহ কয়েকটি এলাকার কেন্দ্রীয় শুরা সদস্যরা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ‘বিগত দিনে সহিংস কর্মসূচির মধ্য দিয়ে মূলত ক্ষতি হয়েছে জামায়াতেরই।’ এক্ষেত্রে অহিংস-শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমেই রাজনৈতিক সাফল্য প্রত্যাশা করেন তারা।

বৃহস্পতিবার হরতালের সমর্থনে বুধবার ফেনীতে আয়োজিত কর্মসূচি সম্পর্কে জেলার  আমির ও কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য একেএম শামসুদ্দীন আহমেদ বলেছিলেন, ‘আমাদের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালন করা হবে। আমরা হরতালের সমর্থনে লিফলেট বিতরণ করেছি। অহিংস পিকেটিং করেছি।’

জামায়াতের কর্মসূচি পালনে পরিবর্তনের বিষয়ে দলটির শীর্ষ নেতাদের কয়েকটি মামলার আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামের ভাষ্য, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, শান্তিপূর্ণভাবে যেটা হচ্ছে, এটা অবশ্যই স্বাগত জানানোর মতো বিষয়। কারণ, গণতান্ত্রিক দেশ, সংবিধানস্বীকৃত নাগরিক অধিকার। জনগণ রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পারবে। শান্তিপূর্ণভাবে করা হলে অবশ্যই সব মানুষের জন্য স্বস্তির একটা ব্যাপার হবে। এই দিকটিকে আমি ভালোভাবে দেখি।’

কিন্তু এই পরিবর্তন কি দলটির ‘দুর্নাম ঘোচানো’র নতুন কৌশল? এমন প্রশ্নের জবাবে তাজুল ইসলামের উত্তর, ‘তাদের মনে কী আছে, তারা বলতে পারবে। তাদের স্ট্যাটেজি ভিন্ন কথা। কিন্তু আমরা যারা সমাজের অংশ হিসেবে আছি, তারা বিষয়টিকে একটা ট্রান্সফরমিশন বলব। এটা ভালো একটা দিক। সব রাজনীতিবিদই যদি এভাবে চিন্তা করেন, তাহলে দেশের মধ্যে এত হানাহানি থাকবে না।’ তিনি এও মনে করেন, ‘জামায়াতের আসলে উদ্দেশ্য কী, তা কিছু বলার সুযোগ নেই।’

কোনও কোনও বিশ্লেষক মনে করেন, উদারপন্থী গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপির সঙ্গ নিশ্চিত করতেই সহিংস অবস্থান থেকে সরে আসছে জামায়াত। ২০১৬ সালে বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীদের অনেকেরই দলটির প্রতি জামায়াতসঙ্গ ত্যাগের চাপ ছিল। তবে খালেদা জিয়া ও দলের একটি অংশের অনড় অবস্থানসহ ভোটের সমীকরণের কারণে জামায়াতকে পাশেই রাখে বিএনপি। যদিও কৌশলের অংশ হিসেবে পারস্পরিক সম্মতিপূর্ব দৃশ্যমান সম্পর্ক এড়িয়ে চলে জোটসঙ্গী দল দু’টি।

এ প্রসঙ্গে বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘আমাদের মধ্য থেকে বিএনপির ওপর জামায়াত ত্যাগের চাপ ছিল। আর শক্তি প্রদর্শন বিএনপি ছাড়া কিভাবে করবে তারা? নির্বাচন তো অন্য জিনিস।’

তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এমাজউদ্দীনের বিশ্লেষণ হচ্ছে, ‘ক্ষমতাসীন দল বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে স্বাভাবিক হতে দিচ্ছে না। সেক্ষেত্রে বিএনপি বা জামায়াত, কোনও দলেরই শক্তি প্রদর্শনের সুযোগ নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রত্যেকের বিরুদ্ধে অন্ততপক্ষে ১৫০-২০০ মামলা। কিভাবে কর্মসূচি পালন করবে? নির্বাচনের আগে কিছু একটা করতে গেলে সরকার আবার চাপে রাখবে। এত বেশি নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছে যে, জামায়াত আর চাইবে না, নির্বাচনের আগে তাদের আরও নেতাকর্মী গ্রেফতার হোক। এদিকে  বিএনপিরও এই মুহূর্তে হরতাল বা বড় কর্মসূচি দেওয়ার ইচ্ছা নেই।’ সেক্ষেত্রে তারাও সক্রিয় হবে না বলেও মনে করেন তিনি।http://www.banglatribune.com

Check Also

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হচ্ছেন খবরে আসামিপক্ষে শুনানি করেননি সমাজী

জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার সাবেক ৯ মন্ত্রীসহ ১৩ জনকে আন্তর্জাতিক …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।