মাহফুজুর রহমান পেশায় একজন আইনজীবী। সিলেটের আদালতে সরকারের অতিরিক্ত কৌঁসুলি (এডিশনাল পিপি) তিনি। পাশাপাশি শাসক দল আওয়ামী লীগেরও নেতা। সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন। সব মিলে মাহফুজ সিলেটে এক শক্তির আধার। যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও বখাটেদের নিয়ে নগরীতে তার রয়েছে সমন্বিত এক ক্যাডার বাহিনী। ফলে মাহফুজ চলেন দাপটের সঙ্গে। এই মাহফুজই সিলেটের বহুল আলোচিত আবদুল আলী হত্যা মামলার অন্যতম আসামি। এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী হিসেবে তার নাম উঠে এসেছে। এখন মামলা থেকে বাঁচতে তিনি বাদীসহ নিহতের পরিবারকে মামলা তুলে নেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। হত্যাসহ নানা ধরনের হুমকিও দিচ্ছেন। শুধু তাই নয়, মামলা তুলে নেয়া বা আসামিদের সঙ্গে মীমাংসায় আসতে বাধ্য করার জন্য প্রভাবশালী সিন্ডিকেট দিয়ে তিনি নিহত আবদুল আলীর পরিবারকে একঘরে করে রেখেছেন। এ কারণে বাদীপক্ষ নিরাপত্তা চেয়ে থানায় চার দফা জিডি করেছে।
সিলেটে আইন ব্যবসার আড়ালেই মাহফুজ সিলেটের তার রয়েছে বিশাল অপরাধ সিন্ডিকেট। এর মধ্যে জেলার পাথর কোয়ারিগুলোর পাথরখেকো সিন্ডিকেট অন্যতম। তিনি এই সিন্ডিকেটের অঘোষিত উপদেষ্টা। তিনিই পাথর রাজ্যে অবৈধ লুটপাটের অন্যতম নেপথ্য নায়ক। তাদের সব আইনি ঝুট-ঝামেলাও তিনিই দেখে দেন। বিনিময়ে পান কোটি কোটি টাকার পাথর লুটের ভাগ। আর এই অবৈধ কর্মকাণ্ডে বাধা দেয়ায় খুন করা হয় আবদুল আলীকে।
সম্প্রতি মাহফুজের বিরুদ্ধে আরেক অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর তা হল- একজন প্রবাসীর স্ত্রীর দায়ের করা মামলাকে পুঁজি করে তিনি বড় ধরনের ফায়দা লুটেছেন। আসামিদের টাকায় বিদেশ ভ্রমণের সুযোগও নিয়েছেন তিনি। আইনজীবী ও সরকারি কৌঁসুলি হওয়ার সুবাদে নারী নির্যাতন মামলায় অভিযুক্ত প্রবাসী পরিবারকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি এসব সুবিধা নেন। ফলে স্বামী, শ্বশুরবাড়ি হারানোর পর ন্যায়বিচার থেকেও বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন মামলার বাদী মমতাজ ও তার পরিবার। অভিযোগ উঠেছে, মাহফুজের ইশারায় স্বামীহারা স্ত্রীর দায়ের করা হত্যা মামলা দ্রুত বিচার আদালতে স্থানান্তরের বিষয়টি ঝুলে আছে পুলিশ সুপার কার্যালয়ে। সিলেট নারী ও শিশু নির্যাতন আদালতে দায়ের করা মামলার বাদী ও পরিবারকে এখন নানাভাবে হয়রানি করছেন অ্যাডভোকেট মাহফুজুর রহমান। সিলেটের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে দেয়া সালিশের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নেও আসামিরা গড়িমসি করছেন তার ইন্ধনেই।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সিলেটের পাথর রাজ্যের নেপথ্য নিয়ন্ত্রক অ্যাডভোকেট মাহফুজ। তার অবৈধ পাথরখেকো সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ পাথর কোয়ারি ভোলাগঞ্জসহ প্রায় সব ক’টি কোয়ারি। এই সিন্ডিকেটের বিরোধী ছিলেন পাথর ব্যবসায়ী আবদুল আলী। যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত সাহসী আবদুল আলী পাথরখেকোদের অন্যায়, অবিচার, লুটপাট, নিরীহদের নির্যাতন, হয়রানি-হত্যার প্রতিবাদ করতেন। এ কারণে কোটি কোটি টাকার অবৈধ পাথর লুটকারীদের চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন আবদুল হক। আবদুল হককে ২০১৪ সালের ২৪ অক্টোবর গুলি করে হত্যা করা হয়; যার নেপথ্যেও ছিলেন অ্যাডভোকেট মাহফুজ। সিলেট নগরীতে থাকা তার আইন পেশার চেম্বার ও একটি অভিজাত হোটেলে দু’দফায় বৈঠকের পর আবদুল আলীকে হত্যা করা হয়। আবদুল আলী হত্যা মামলার এজাহার ছাড়াও হত্যাকাণ্ডের একাধিক শীর্ষ আসামিসহ মামলার সাক্ষীদের দেয়া জবানবন্দিতেও বৈঠকের বিষয়টি উঠে এসেছে।
নিহত আবদুল আলীর স্ত্রী হালিমা বেগমের দায়ের করা মামলার এজাহার অনুযায়ী অ্যাডভোকেট মাহফুজুর রহমানের চেম্বারে বসেই পাথর ব্যবসায়ী আবদুল আলী হত্যার পরিকল্পনা হয়। খুন হওয়ার আগে আবদুল আলী বিষয়টি অবগত হয়েছিলেন। আর এ কারণেই আবদুল আলী চলাফেরায় সতর্কতা অবলম্বন করতেন। যাদিও শেষ পর্যন্ত নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি তিনি।
নথি ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৬ সালের ১০ মে অনুষ্ঠিত জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় আবদুল আলী হত্যা মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু আজো সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি। নিহত আবদুল আলীর স্ত্রী হালিমা বেগমের দাবি, খুনিচক্র রাজনৈতিক ও অর্থবিত্তে প্রভাবশালী হওয়ায় তারা মামলার স্বাভাবিক কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে সরকারি কৌঁসুলি মাহফুজের কারণেই মামলার এমন পরিণতি। জানা যায়, সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পরও মামলাটি এখনও দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর হয়নি। রহস্যজনক কারণে লাল ফিতায় বন্দি হয়ে আছে সিলেটের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে।
এ ব্যাপারে জানতে সিলেটের পুলিশ সুপার মো. মনিরুজ্জামানকে ফোন দেয়া হলে তিনি পরে ফোন দিতে বলেন। আধাঘণ্টা পর ফোন আবার ফোন দেয়া হলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।’ এরপর পুলিশ সুপার কার্যালয়ের কর্মকর্তা ও সাবেক কোর্ট ইন্সপেক্টর পরিচয়ে শফিক আহমদ নামের একজন এসআই যুগান্তরকে বলেন, ‘চাঞ্চল্যকর মামলা মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সুপার কার্যালয়ের বিশেষ কমিটি না থাকায় মামলাটি এতদিনে স্থানান্তর হয়নি। আগামি মাসের আইনশৃঙ্খলা কমিটিতে বিষয়টি উত্থাপন করা হবে।’
আবদুল আলী হত্যাকাণ্ডের পর আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় তৎকালীন পুলিশ সুপারের দেয়া বক্তব্য থেকেও মামলায় প্রভাব বিস্তারের আভাস পাওয়া যায়। নথি অনুযায়ী, পুলিশ সুপার আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় তার বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘মামলাটি তার জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল। নিহত আবদুল আলীর শরীরে ২০-২৮ রাউন্ড গুলি করা হয়েছিল।’
এদিকে আবদুল আলী হত্যার ব্যাপারে দায়ের করা মামলা তদন্তের পর পুলিশ ও সিআইডির দেয়া তিন দফা চার্জশিটেই মুল খুনিদের বাদ দেয়া হয় রহস্যজনক কারণে। বাদীপক্ষের দাবি এ ক্ষেত্রে পেছনে কলকাঠি নাড়েন মাহফুজ। এমতাবস্থায় কোম্পানীগঞ্জ ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক শারমিন আক্তার মাহফুজসহ হত্যা মামলার আসামিদের অন্তর্ভুক্ত করে চার্জশিট গ্রহণ করেন।
নিহত আবদুল আলীর ভাই আবদুল হক জানান, মামলার আসামিরা অত্যন্ত প্রভাবশালী ও বিশাল সম্পদের মালিক হওয়ায় তারা আমাদের হুমকি দিয়ে চলেছে। এ কারণে আমার থানায় ৪টি জিডি করেছি। তারপরও আসামি ও তাদের ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। মামলা প্রত্যাহার বা সালিশে সমাধানের জন্য আসামিরা মরিয়া। আমরা অনড় থাকায় খুনিরা ২৯ সেপ্টেম্বর কোম্পানীগঞ্জে গরু জবাই করে খেয়ে আনন্দ উৎসব করেছে এবং আমাদের একঘরে করার ঘোষণা দিয়েছে। তারা আমাদের সন্তানদের অপহরণের হুমকি দিচ্ছে।
নিহত আবদুল আলী’র পরিবারের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে অ্যাডভোকেট মাহফুজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন,‘ আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগুলো ভিত্তিহীন। আমি থাকি সিলেটে আর অভিযোগকারীরা থাকেন কোম্পানীগঞ্জে। তাদের সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎও হয় না। কাজেই কী করে আমি এগুলো করব।’
মামলা তুলে নিতে প্রবাসীর স্ত্রীকে হয়রানির অভিযোগও তিনি অস্বীকার করেন। আসামিপক্ষ থেকে সুযোগ-সুবিধা নেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি তাদের মামলা চালাচ্ছি। তারা টাকা দিতেই পারে।’
পাথর কোয়ারি সিন্ডিকেটের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথাও তিনি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমি তো আইন ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমি কেন তাদের মদদ দেব?’ যুগান্তর