রোহিঙ্গা ইস্যুতে ঢাকা-দিল্লির মতবিরোধ তুঙ্গে, দুদেশের দূতরা বলছেন দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন

ঢাকা: দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত বলছেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট কোন্ পথে মোকাবেলা করা যায়, সেটা ভারত ও বাংলাদেশ ঠিক এক দৃষ্টিতে দেখছে না বা দেখা সম্ভবও নয়। রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলি বিবিসিকে জানিয়েছেন, মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশের সঙ্গে যেহেতু ভারতের সরাসরি কোন সীমান্ত নেই তাই এ ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিও আলাদা হওয়াটাই স্বাভাবিক । খবর বিবিসির।

ভারত রোহিঙ্গাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করলেও বাংলাদেশ যে এটিকে মূলত মানবিক সঙ্কট হিসেবেই দেখছে সেটিও তিনি বলছেন। সেই সঙ্গেই তিনি জানিয়েছেন, ভারতে ঢুকে পড়া রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা হলে সেটা তারা কিছুতেই মেনে নেবেন না।

গত ৯ই সেপ্টেম্বর খানিকটা হঠাৎ করেই দিল্লির সাউথ ব্লকে গিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব এস জয়শঙ্করের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেছিলেন হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলি। মায়ানমার যাতে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে রাজি হয়, সে ব্যাপারে তাদের ওপর প্রভাব খাটাতে ভারতকে অনুরোধ করেছিলেন তিনি।

নরেন্দ্র মোদি ও অং সান সু চি-র বৈঠকের পর রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের কথা উল্লিখিত না হওয়ায় বাংলাদেশ যে হতাশ, সেটাও গোপন করেননি রাষ্ট্রদূত।

ঐ বৈঠকের পর সে রাতেই ভারত এই সঙ্কট নিয়ে নিজেদের অবস্থান কিছুটা পরিমার্জন করে নতুন বিবৃতি দিয়েছিল। তবে তার প্রায় সোয়া মাস পর সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলি মনে করছেন, আসলে রোহিঙ্গা সঙ্কটকে ভারত ও বাংলাদেশের একই দৃষ্টিতে দেখা বোধহয় সম্ভবও নয়।

বিবিসির এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলছিলেন, ‘এখানে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা বলে মনে হচ্ছে একটা সহজ কারণে রাখাইন অঞ্চলটা ভারতের লাগোয়া নয়। রাখাইন যদি ভারতের লাগোয়া হত, তাহলে বাংলাদেশের মতো ভারতকেও একই পরিণাম ভুগতে হত।’

‘হ্যাঁ, ঠিক আছে এখনকার মতো আপনারা বেঁচে গেছেন। কিন্তু কতদিন? রাখাইনে প্রাকৃতিক সম্পদ, বন্দরের সুবিধা ইত্যাদি কত কিছু নিয়েই তো কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু সেখানে নিরাপত্তা না থাকলে তো এসব কিছুই থাকবে না!’ রাখাইন অঞ্চলে যে আগুন লেগেছে, তার আঁচ গোটা অঞ্চলেই একদিন ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে তিনি প্রকারান্তরে ভারতকে সতর্ক করে দিয়েছেন। এমন কি, রোহিঙ্গারা আসলেই নিরাপত্তা হুমকি কি না, সেই প্রশ্নেও যে দুই দেশের অবস্থানে ফারাক আছে, সেটাও তার কথায় স্পষ্ট হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে ভারত যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বা সুপ্রিম কোর্টে যে হলফনামা দিয়েছে তা তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। একজন বিদেশি কূটনীতিক হিসেবে এই বিচারাধীন বিষয়ে মন্তব্য করাটা সাজে না।’

‘কিন্তু আমি এটা বলতে পারি, আমাদের দেশে যে শরণার্থীরা এসেছেন তাদের ষাট শতাংশই কিন্তু মহিলা, শিশু বা বৃদ্ধ মানুষজন, যারা অসম্ভব দুর্দশার মধ্যে আছেন। তাদের কীভাবে আমি জঙ্গি বলে চিহ্নিত করব?’

ভারতীয় কর্তৃপক্ষের বিশ্বাস, এ দেশে যে চল্লিশ হাজারের মতো রোহিঙ্গা আছেন তারা সরাসরি মায়ানমার থেকে নয়, বাংলাদেশ হয়েই ভারতে ঢুকেছে।

ফলে ফেরত পাঠাতে হলে তাদের আগে বাংলাদেশে পাঠানো হোক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনেকেই তা বিশ্বাস করেন। গত এক সপ্তাহের ভেতর প্রায় জনাচল্লিশেক রোহিঙ্গাকে ভারত সাতক্ষীরা-যশোর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে বিজিবি, বলেও বাংলাদেশের পুলিশ জানিয়েছে।

দিল্লিতে হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলি অবশ্য জোর দিয়ে বলছেন, এই ধরনের প্রচেষ্টা তাদের কাছে কখনোই গ্রহণযোগ্য হবে না।

তার কথায়, ‘বাস্তবতাটা আপনাকে মানতে হবে, যে কোন ডিপোর্টেশন হয় দুটো দেশের মধ্যে। যে দেশ থেকে লোকজন পাঠানো হচ্ছে, আর যারা তাদের গ্রহণ করছে। ভারত থেকে পাঠানো রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মায়ানমার যদি রাজি হয়, ভাল কথা – কিন্তু এখানে তৃতীয় কারো ভূমিকা থাকতে পারে না।’

‘ভারতে তাদের কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে নিয়ে কী করবে সেটা তাদের ব্যাপার, কিন্তু আপনাদের বুঝতে হবে আমাদের সমস্যাটার ব্যাপকতা ভারতের তুলনায় ১০, ১২ বা ১৫ গুণ বেশি। রবীন্দ্রনাথকে ধার করে বলি, এতো সাগরের সঙ্গে শিশিরবিন্দুর তুলনা।’

মাস দুয়েক আগে রোহিঙ্গা সঙ্কট নতুন করে শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশ এই প্রথম এতটা খোলাখুলি ভারতের ভূমিকাকে বিশ্লেষণ করল।

Check Also

প্রত্যেক উপজেলায় একটি সরকারি মাদ্রাসা করার সুপারিশ: সাতক্ষীরা ডিসি

ক্রাইমবাতা রিপোট,  সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ বলেছেন, যদি প্রত্যেকটা উপজেলায় একটা সরকারি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।