রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে শিগগিরই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে চীন ও যুক্তরাজ্যের যৌথ প্রস্তাব উঠছে। চীন বরাবরই রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে দ্বিপক্ষীয়ভাবে নিষ্পত্তির কথা বলে আসছে। কিন্তু চীন এই প্রথম বহুপক্ষীয় ফোরাম নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব উত্থাপনের উদ্যোগ নেয়ায় রোহিঙ্গা সংকটের ব্যাপারে বড় ধরনের বরফ গলার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এ প্রস্তাবের নেপথ্যে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচটি রাষ্ট্রেরই সমর্থন আছে বলে জানা গেছে। ফলে প্রস্তাবটি পাস হওয়ার জোর সম্ভাবনা আছে। পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক মঙ্গলবার রাতে নিরাপত্তা পরিষদে চীন ও যুক্তরাজ্যের যৌথ প্রস্তাব আনার বিষয়টি যুগান্তরকে জানান। তবে প্রস্তাবটি সম্পর্কে তিনি বিস্তারিত কিছু বলেননি।
এদিকে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে ‘প্লেজিং কনফারেন্স’ (প্রতিশ্রুতি সম্মেলন) নামে বিশ্ব সম্মেলনের ডাক দিয়েছে জাতিসংঘের একাধিক সংস্থা। আগামী ২৩ অক্টোবর জেনেভায় মন্ত্রী পর্যায়ের এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখ ৮২ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। আগে থেকে আছে প্রায় চার লাখ। এদের মানবিক সহায়তায় প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহে এ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও কুয়েত এ সম্মেলনের প্রতি সংহতি জানিয়েছে। জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক দফতর ইউসিএইচএ, আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থা আইওএম এবং জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর এই প্লেজিং কনফারেন্সের আয়োজন করছে। জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে দেয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা সম্প্রদায় এবং তাদের উদারভাবে আশ্রয়দানকারী বাংলাদেশের প্রয়োজনের সময়ে বিশ্ব তাদের পাশে আছে- এমন বার্তা দিতেই এ সম্মেলন।
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে একাধিক দফায় আলোচনার পরও চীন এবং রাশিয়ার সম্ভাব্য ভেটোর আশঙ্কায় কোনো প্রস্তাব উত্থাপন করা সম্ভব হয়নি। গত বছরের অক্টোবরে প্রথম দফায় রোহিঙ্গাদের ঢলের পর নিরাপত্তা পরিষদের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিয়ানমারের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়ে একটি বিবৃতি দেয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু জাতিসংঘে চীনের স্থায়ী প্রতিনিধি মাথা নেড়ে তা নাকচ করে দেন। তারপর গত ২৫ আগস্টের পর বড় ধরনের রোহিঙ্গা ঢল শুরু হলে আবারও নিরাপত্তা পরিষদ বৈঠকে বসে। সেখানে সহিংসতা বন্ধের আহ্বানসংবলিত একটি বিবৃতি দেয়া সম্ভব হয়। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এ সংকট সমাধানে নিরাপত্তা পরিষদের চেয়ারম্যানকে চিঠি দেন। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদ উন্মুক্ত বিতর্ক আয়োজন করে। সেখানে স্থায়ী সদস্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স কড়া ভাষায় মিয়ানমারের সমালোচনা করলেও চীন ও রাশিয়া কার্যকর অ্যাকশনের বিরোধিতা করে। নিরাপত্তা পরিষদে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের বক্তব্য শোনা হয় আলাদা বৈঠকে। পর্দার আড়ালে কাজ চলতে থাকে। এবার চীন ও ব্রিটেনের যৌথ প্রস্তাবকে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের পথে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বড় ধরনের সাড়া বলে মনে করা হচ্ছে।
এদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া শুরু করেছে। ইইউ মিয়ানমারের জেনারেলদের ইউরোপে প্রবেশে নিষিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশ চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও একই ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করুক। বিশ্বব্যাংকও মিয়ানমারের ঋণ বাতিল করেছে। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে ঋণ দেয়ার বিষয়ে আলোচনা করছে। অপরদিকে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বিশ্বব্যাপী এমন আলোড়নের মধ্যে রাখাইন রাজ্য থেকে তাদের বিতাড়ন অব্যাহত রেখেছে মিয়ানমার। এ বছরের ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখ ৮২ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।
নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক যুক্ত বিবৃতিতে জাতিসংঘ জানিয়েছে, শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি, জরুরি ত্রাণ সমন্বয়ক ও মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল মার্ক লোকক ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন বিষয়ক এজেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের (আইওএম) মহাপরিচালক উইলিয়াম লেসি সুইং এমন সম্মেলন করার পরিকল্পনা নিয়েছেন। ওই তিন সংস্থার প্রধানের যুক্ত বিবৃতিতে রোহিঙ্গা সংকটকে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাওয়া সংকট হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। তারা এটাকে বড় একটি জরুরি মানবিক সংকটও বলেছেন।
জাতিসংঘের মতে, এ অঞ্চলে কয়েক দশকের মধ্যে এটাই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ‘শরণার্থীর’ প্রবেশ। তাদের সহায়তা নিশ্চিতে বাংলাদেশ সরকার, স্থানীয় দাতব্য সংস্থা, স্বেচ্ছাসেবক, জাতিসংঘ ও এনজিওগুলো কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু এ সহায়তাকে যথেষ্ট মনে করছে না জাতিসংঘ। যুক্ত বিবৃতিতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক সহায়তা, নিরাপত্তা ও মৌলিক আশ্রয় নিশ্চিতের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। বিবৃতিতে বলা হয়, অনেক স্থানে এখনও বিশুদ্ধ পানির সুবিধা নেই। পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই। এতে আশ্রয়গ্রহণকারী ও স্থানীয়দের জন্য বৃদ্ধি পাচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।
এ তিন সংস্থার যুক্ত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় নিশ্চিতে সীমান্ত খুলে দিয়েছে। পালিয়ে আসা মানুষের জন্য নিশ্চিত করেছে নিরাপত্তা ও আশ্রয়। রোহিঙ্গাদের প্রতি স্থানীয়দের আর্তি আর উদারতা আমাদের হৃদয়ে নাড়া দিয়ে গেছে। এবার জেনেভায় মানবাধিকার সমন্বয় সংস্থা (ওসিএইচএ), আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) ও জাতিসংঘের শরণার্থী কমিশন ইউএনএইচসিআর সম্মেলনে বসছে। ওই বৈঠকে বিভিন্ন দেশের সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করবে। ভাগ করে নেবে দায়িত্ব। যুক্ত বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা রোহিঙ্গা সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান, পালিয়ে আসার পরিসমাপ্তি ঘটানোর লক্ষ্যে তৎপরতা জোরদারের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতি আহ্বান জানাই। রোহিঙ্গারা যাতে নিরাপদে ও সম্মানের সঙ্গে ফিরে যেতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।’
ইউএনএইচসিআর প্রধান ফিলিপ্পো গ্রান্ডি, জাতিসংঘ সাহায্য বিষয়ক প্রধান মার্ক লোকক এবং আইওএম প্রধান উইলিয়াম লেসি সুইং বলেছেন, এ সংকটের উৎপত্তি মিয়ানমারে, সমাধানও সেখানেই হতে হবে। তারা বলেন, পালিয়ে আসা পরিবারের নিরাপত্তা ও আশ্রয়ের লক্ষ্যে বাংলাদেশ তার সীমান্ত খুলে রেখেছে। আমরা স্থানীয় জনগণকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার প্রশংসা করি।
সম্মেলনের সঙ্গে সংহতি জানিয়েছে ইইউ ও কুয়েত। তাদের দেয়া এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এ সংকট সারা বিশ্বের সরকারগুলোর কাছে দায়িত্ব পালনের সংহতি ও এ দায় ভাগাভাগি করে নেয়ার সুযোগ এনে দিয়েছে। এ লক্ষ্যে একটি জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান এরই মধ্যে হাতে নেয়া হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের ঢল ফের বেড়েছে : এদিকে জাতিসংঘ জানিয়েছে, গত ২৫ আগস্টে শুরু হওয়া সহিংসতার পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা পাঁচ লাখ ৮২ হাজারে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসা ঢল হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে। একসঙ্গে প্রায় ৪৫ হাজার এসেছে বাংলাদেশে। জাতিসংঘ জানায়, রোহিঙ্গাদের গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ায় গত ২৪ ঘণ্টায় ১০-১৫ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছে। নতুন করে আসা এসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে আটকে আছে। দীর্ঘদিন ধরে হেঁটে আসায় নারী ও শিশুসহ তারা ক্ষুধার্ত ও পানিশূন্যতায় ভুগছে। ইউএনএইচসিআর জরুরি ভিত্তিতে তাদের বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতি দেয়ার জন্য বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ করছে। সোমবার কিছু এরিয়ার ফুটেজ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা। যাতে দেখা যাচ্ছে উখিয়ার পালংখালীর কাছে নাফ নদী পার হয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করছে। মাঝে রোহিঙ্গাদের আসার পরিমাণ অনেক কমে গিয়েছিল। কিন্তু দু’দিন ধরে নতুন করে সীমান্তে আবারও রোহিঙ্গাদের স্রোত দেখা যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা চায় বাংলাদেশ : মিয়ানমারের জেনারেলদের ইউরোপে প্রবেশে ইইউ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর যুক্তরাষ্ট্রও একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করুক- এটাই চায় বাংলাদেশ। সম্প্রতি ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা সংলাপে রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্য থেকে বিতাড়নের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র যে ভূমিকা নিয়েছে তার প্রশংসা করেছে বাংলাদেশ। ওই বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অ্যামেরিকাস অনুবিভাগের মহাপরিচালক আবিদা ইসলাম। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা চাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন পদক্ষেপ নিক যাতে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে সুস্পষ্ট ফল পাওয়া যায়। এদিকে শিগগিরই বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অংশীদারি সংলাপ ঢাকায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আগামী ৩১ অক্টোবর অংশীদারি সংলাপের ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এতে যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা নেতৃত্ব দেবেন। তারপর আগামী ৫ নভেম্বর হবে প্লেনারি বৈঠক। এ বৈঠকে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের আন্ডার সেক্রেটারি টম শ্যানন। ঢাকার কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চাইবে। ইইউ যেভাবে মিয়ানমারের জেনারেলদের নিষিদ্ধ করেছে একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও নিষেধাজ্ঞা চাওয়া হবে। এবার হচ্ছে ষষ্ঠ অংশীদারি সংলাপ। ২০১২ সালে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরকালে দু’দেশের মধ্যে নিয়মিত অংশীদারি সংলাপ করার লক্ষ্যে চুক্তি সই করেন। তারপর থেকে প্রতিবছর একবার ঢাকায় এবং একবার ওয়াশিংটনে অংশীদারি সংলাপ হচ্ছে।
গ্রামের পর গ্রাম জ্বালানোর প্রমাণ দিল এইচআরডব্লিউ : মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উত্তর অংশের ২৮৮ গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার প্রমাণ দিল মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। এসব গ্রামে ২৫ আগস্টের আগে বসতভিটা ছিল, ছিল সাজানো-গোছানো সংসার, যার সবই এখন অতীত। মঙ্গলবার নতুন করে প্রকাশিত স্যাটেলাইট চিত্র বিবৃতিতে এইচআরডব্লিউ এ প্রমাণ দিয়েছে। এর আগে মধ্য সেপ্টেম্বরে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল রাখাইনে রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে সহিংসতার স্যাটেলাইট ছবি প্রকাশ করে। সেখানেও ফুটে ওঠে ধ্বংসযজ্ঞ। এইচআরডব্লিউর ডেপুটি এশিয়া পরিচালক ফিল রবার্টসন বলেন, এ চিত্রই প্রমাণ করে, কেন মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে স্রোতের মতো বাংলাদেশে ঢুকছে। বার্মিজ সেনারা গণহত্যা, ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী নানা কর্মকাণ্ড চালিয়েছে, এতে মানুষ আসতে বাধ্য হয়েছে।jugantor.com