রোহিঙ্গাদের উৎখাতে রাখাইনে চলছে মানবতাবিরোধী অপরাধ —অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল

বিবিসি বাংলা : আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে রাখাইন রাজ্যে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ করেছে। এই সঙ্কটের ওপর অ্যামনেস্টি বুধবার এক বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্ন করার প্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ, স্যাটেলাইট ছবি, ফটো, ভিডিও এবং অন্যান্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে অ্যামনেস্টি বলছে, এতে উপসংহারে পৌঁছানো যায় যে, হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ এবং শিশু একটি ব্যাপক ও পরিকল্পিত আক্রমণের শিকার হয়েছেন, যা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সমান।

বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ১২০ জন রোহিঙ্গা নারী এবং পুরুষের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদনটি  তৈরি করা হয়েছে বলে অ্যামনেস্টি বলছে। তবে মানবতার বিরুদ্ধে এসব কথিত অভিযোগের ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারের বক্তব্য তাৎক্ষণিকভাবে জানা সম্ভব হয়নি।

এক বিবৃতিতে অ্যামনেস্টি বলছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রোম চুক্তিতে ১১ ধরনের অপরাধকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। রাখাইন রাজ্যের সহিংসতায় এ ধরনের ছয়টি অপরাধ চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছেÑ খুন, বলপূর্বক নির্বাসন, নির্যাতন, ধর্ষণ, নিপীড়ন এবং অন্যান্য অমানবিক কর্মকা-। সবচেয়ে নৃশংস অপরাধের প্রত্যক্ষদর্শীরা এসব তৎপরতার জন্য মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলীয় কমান্ড, ৩৩ লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন এবং সীমান্তরক্ষা বাহিনীকে দায়ী করেছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একজন পরিচালক টিরানা হাসান বলেছেন, এই নৃশংস অপরাধের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার পাওয়ার পথে প্রথম ধাপ হচ্ছে এসব অপরাধের কথা ফাঁস করে দেয়া। যারা এসব অপরাধ করেছে তাদের অবশ্যই বিচার করতে হবে। আরেকটি ভুয়া অভ্যন্তরীণ তদন্তের নামে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এসব ঘটনাকে কোনমতেই ধামাচাপা দিতে পারে না, তিনি বলেন।

ধর্ষণ এবং বিভিন্ন যৌন অপরাধ : অ্যামনেস্টি বলছে, তদন্তে তারা প্রমাণ পেয়েছে যে মংডুর মিন গিই গ্রাম স্থানীয়ভাবে যার নাম তুলাতলী এবং বুথিডং-এর কিউন পক গ্রামের কোন কোন নারীকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সদস্যরা ধর্ষণ করেছে। অ্যামনেস্টি যৌন সহিংসতার শিকার সাতজন রোহিঙ্গা নারীর সাথে কথা বলেছে। তাদের মধ্যে চারজন মহিলা এবং ১৫ বছর বযসী এক কিশোরীকে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। পরিচয় গোপন করে এসকে নামে ৩০ বছর বয়সী এক নারীর সাক্ষ্য এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।

আশ্রয়ের আশায় টেকনাফে সড়কের পাশে বসে আছে শরণার্থীরা। তিনি বলছেন, তারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে মহিলাদের আলাদা করে ফেলে। আমরা পাঁচজন মহিলাকে চারজন সৈন্য আটকে রাখে। তারা আমাদের কাছ থেকে জোর করে টাকাপয়সা ও অন্যান্য জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয়। আমার দুই বছরের ছেলে শফিকে তারা লাঠি দিয়ে মাথায় আঘাত করে। এক আঘাতেই শফি সাথে সাথে মারা যায়। আমার বাকি তিন ছেলেকেও খুন করা হয়। তিনি বলেন, এরপর তারা সব মহিলাকে উলঙ্গ করে। তাদের হাতের লাঠি দিয়ে আমাদের মাথায় আঘাত করার পর আমরা দুর্বল হয়ে পড়ি। তারা লাঠি দিয়ে আমাদের যৌনাঙ্গেও আঘাত করে। এরপর তারা আমাদের ধর্ষণ করে।

অ্যামনেস্টি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নারী ও শিশুদের ধর্ষণের পর রোহিঙ্গা বাড়িগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।

রাখাইনে হত্যালীলা : অ্যামনেস্টির এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২৫ অগাস্ট রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গোষ্ঠীর আরসার হামলার পর মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা বেসামরিক জনগণের ওপর প্রতিশোধমূলক আক্রমণ চালানো শুরু করে। তাদের সাথে কখনও কখনও যোগ দেয় স্থানীয় সশস্ত্র গোষ্ঠী। এসব হামলার মুখে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষরা যখন পালাতে থাকেন তখন সৈন্য এবং পুলিশ সদস্যরা পেছন থেকে তাদের গুলী করে হত্যা করে বলে অ্যামনেস্টি বলছে।

বার বছর বয়সী ফাতিমা অ্যামনেস্টিকে জানিয়েছে, তার আট ভাইবোন, মা-বাবা এবং বৃদ্ধ দাদী একদিন দেখতে পায় গ্রামের অন্য অংশ থেকে ধোঁয়া উড়ছে। ভয়ে তারা দৌড়ে বাড়ি ছেড়ে পালানোর সময় উর্দি পরা কিছু লোক পেছন থেকে তাদের ওপর গুলী চালায়। তার বাবা এবং ১০ বছর বয়সী বোনের গায়ে গুলী লাগে। তার নিজের ডান উরুতেও গুলী লাগে।

এই সঙ্কটের প্রকৃত চিত্র উদঘাটনের জন্য অ্যামনেস্টি রাখাইনে জাতিসংঘ তদন্তের ডাক দিয়েছে।

ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন

রাখাইনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী শতাধিক রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছে বলে দাবি করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। বুধবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে তারা জানিয়েছে, রাখাইনে অনেক নারী ও শিশু রোহিঙ্গাকে হত্যা করতে সামরিক সিস্টেমেটিক অভিযান চালিয়েছে সেনাসদস্যরা। দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ও দেশটির উপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কাছেও আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা যায়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গত আগস্ট মাসের শেষ দিকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল নামার সময় থেকে এ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিস্তারিত তথ্য-প্রমাণ উঠে এসেছে অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে। প্রায় ১২০ প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দী, স্যাটেলাইটের তথ্য-উপাত্ত, ছবি ও ভিডিওর মাধ্যমে বিস্তারিত ও ব্যাপকভিত্তিক বিশ্লেষণে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ দেওয়া হয়েছে।

২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার পর সামরিক বাহিনীর নিধনযজ্ঞ থেকে বাঁচতে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন। কক্সবাজের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন তারা। তাদের সঙ্গে কথা বলেই প্রতিবেদন তৈরি করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। নিজেদের কাছে শক্তিশালী তথ্য-প্রমাণ রয়েছে উল্লেখ করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থাটি জানায়, হাজার হাজার রোহিঙ্গা পুরুষ, নারী ও শিশু সিস্টেমেটিক হামলার শিকার হয়েছে এবং মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ওই অঞ্চলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে হামলা চালিয়েছে। রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার নিয়ে সংস্থাটি জানায়, মিয়ানমারের সীমান্ত পুলিশের ৩৩ লাইট ইনফ্যান্ট্রিও গ্রামগুলোতে হামলার সঙ্গে জড়িত ছিলো। জড়িত ছিলো বৌদ্ধদের উগ্রবাদী চক্রও। অ্যামনেস্টির গবেষক ম্যাথিউ ওয়েলস বেশ কিছুদিন বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থান করেছেন। তিনি বলেন, তারা কয়েকমাসের মধ্যে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করবে যেখানে জড়িতদের ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে তথ্য উল্লেখ থাকবে।তিনি বলেন, গুলীবিদ্ধ রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা করে ডাক্তাররা জানিয়েছেন যে পালিয়ে যাওয়ার সময়ই তাদের পেছন থেকে গুলী করা হয়। ওয়েলস জানান, স্যাটেলাইট ছবি ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে তারা জানতে পেরেছেন রোহিঙ্গাদের বাড়ি, মসজিদসহ পুরো গ্রামই জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।এর আগে মঙ্গলবার মার্কিন মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচও স্যাটেলাইট ছবি প্রকাশ করে জানিয়েছিলো যে রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলো পুড়িয়ে দিয়েছে সেনাবাহিনী।অ্যামনেস্টি জানিয়েছে, মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। অ্যামনেস্টির মিয়ানমারবিষয়ক গবেষক লরা হাইগ বলেছেন, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অপরাধের যেসব তথ্য-প্রমাণ তারা নথিভুক্ত করেছেন, তা অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে করা দেশটির সেনবাহিনীর নির্যাতনের সঙ্গে তুলনীয়। কাচিন, শান ও পালংসহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধেও তারা একই ধরনের অপরাধ করেছে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মিয়ানমারের কর্মকর্তারা সিস্টেমেটিক নির্যাতনের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন। তাদের মতে, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী।

Check Also

ট্রাইব্যুনালে আ.লীগ নেতাদের বিচার দেখতে এসে যা বললেন সাঈদী পুত্র

জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া সাবেক ৯ মন্ত্রীসহ ১৩ জনকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।