জনকল্যাণে বিভিন্ন সময়ে সরকার বিশেষ কিছু উদ্যোগ বা প্রকল্প নেয়। কিছুদিন না যেতেই সেগুলো আবার মুখ থুবড়ে পড়ে। কয়েক বছরে সরকারের নেওয়া কয়েকটি বিশেষ প্রকল্পের সর্বশেষ পরিস্থিতি বিশ্নেষণ করে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে। যথাযথ পরিকল্পনা না থাকা, রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অভাবে জনবান্ধব এসব উদ্যোগ মাঠে মারা যাচ্ছে বলে বিশ্নেষকরা মনে করছেন। তাদের মতে, হুটহাট করে এসব প্রকল্প নেওয়ায় সরকারের শত শত কোটি টাকা পানিতে যাচ্ছে। জনকল্যাণের উদ্দেশ্যে নেওয়া হলেও তা কার্যকর হচ্ছে না।
জনবান্ধব এসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে রাজধানীর চারপাশে নদীপথে ওয়াটার বাস সার্ভিস, সহজে যাতায়াতের জন্য ডেমু ট্রেন, বাসে ইন্টারনেট, সড়কে উল্টো পথে চলাচল বন্ধে কাঁটা প্রতিরোধক, ঢাকার বিমানবন্দর ও বনানী সড়কে পারাপারের জন্য চলন্ত সিঁড়ি, সিটি করপোরেশনের ডাস্টবিন ও সড়কবাতি জ্বালাতে সৌর প্যানেল প্রকল্প ইত্যাদি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিষ্ট জাহিদ হোসেন সমকালকে বলেন, এ ধরনের প্রকল্পগুলো সরকারের নীতিনির্ধারক বা আমলাদের মাথা থেকে আসে। উন্নত বিশ্বের কোনো দেশ ভ্রমণে গিয়ে একটা বিষয় দেখে তারা নিজের দেশে চালু করার কথা ভাবেন। কিন্তু এসব উদ্যোগ টেকসই করতে প্রাতিষ্ঠানিক যে প্রস্তুতি ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থাকা দরকার তা নেওয়া হয় না। এ ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে বিষয়গুলোকে দেশের প্রেক্ষাপটে সামঞ্জস্যপূর্ণ না করেই অন্য দেশের মতো হুবহু করা হয়। সে ক্ষেত্রেও প্রকল্পগুলো মাঠে মারা যায়, টেকসই হয় না।
ওয়াটার বাস: ঢাকার সদরঘাট থেকে গাবতলী পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদ দিয়ে চলাচলের জন্য ২০১০ সালে ওয়াটার বাস সার্ভিস চালু করে সরকার। প্রথমে দুটি ওয়াটার বাস দিয়ে এ প্রকল্পের শুরু। এরপর ২০১৩ সালে আরও চারটি ওয়াটার বাস নামানো হয়। ঢাকার চারপাশে বৃত্তাকার নৌপথে ওয়াটার বাস প্রকল্পে খরচ হয় ৯৪ কোটি টাকা। কয়েক মাস চলার পর লোকসান দিয়ে এখন আর চলছে না ওয়াটার বাস। কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ বাস চালু করা হলেও নির্দিষ্ট ঘাট তৈরি করা হয়নি। ছিল না টিকিট কাউন্টার, যাত্রী ছাউনি ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা।
এ ছাড়া নদীর ড্রেজিংও অন্যতম সমস্যা ছিল। ২০০৪ সালেও ওয়াটার ট্যাক্সি নামানো হয়েছিল। কিছুদিন ঢিমেতালে যাত্রী পরিবহন করলেও সবশেষে নদীপথের এ বিশেষ যানবাহনগুলো আর চলেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার চারপাশে বৃত্তাকার এ নদীপথ সচল রাখা গেলে রাজধানীর সড়কে চাপ কমত। কিন্তু বিআইডব্লিউটিসির সঠিক পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেটি কার্যকর হয়নি।
ওয়াটার বাস প্রসঙ্গে বিআইডব্লিউটিসির পরিচালক (বাণিজ্য) শহিদুল ইসলাম অবশ্য দাবি করেন, প্রকল্পটি বন্ধ করা হয়নি। সীমিত আকারে চালু আছে। বর্তমানে প্রতিদিন তিন ট্রিপ দেওয়া হয়। যাত্রী না হওয়ার কারণে লোকসান হচ্ছে। প্রতিদিন ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা লোকসানের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, নদীর পানির দুর্গন্ধের কারণে যাত্রীরা এ পরিবহন ব্যবহারে আগ্রহী নন। আবার সদরঘাট থেকে গাবতলী পর্যন্ত বাসভাড়া ৩০ টাকা। কিন্তু ওয়াটার বাসের ভাড়া ৪০ টাকা। বাবুবাজার ব্রিজের নিচে নদীতে অনেক জাহাজজট হয়। এ ছাড়া আরও কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।
ডেমু ট্রেন: শহরতলি থেকে দ্রুত বেশি মানুষ আনা-নেওয়া করে রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরগুলোর দৈনন্দিন যাত্রীর চাপ কমানোর লক্ষ্যে আধুনিক কমিউটার ‘ডেমু ট্রেন’ আমদানি করেছিল রেলওয়ে। ৬৮৭ কোটি টাকা খরচ করে চীন থেকে ২০ সেট ডেমু ট্রেন আনা হয়। প্রকল্পের মুখপত্রে বলা হয়েছিল, বছরে ১০০ কোটি টাকা লাভ হবে। দেশের ১১টি রুটে ১৬ সেট ডেমু ট্রেন চালানো হয়। কিন্তু রেলওয়ে প্রথম বছরেই লোকসান দেখিয়েছে ৩৬ কোটি টাকা।
শুরুর দিকে যাত্রী না থাকায় লোকসান গুনতে হয়েছে। এরপর যখন যাত্রীরা ডেমু ট্রেন ব্যবহার শুরু করেছে তখন একের পর এক নষ্ট হতে শুরু করেছে। ডেমুতে এখন কীভাবে কম যাত্রী বহন করা যায়, সে চেষ্টায় রয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। চালুর দুই বছর না যেতেই কয়েক সেট ডেমু ট্রেন বিকল হয়ে পড়েছে, যা এখনও ঠিক হয়নি। জানা গেছে, ডেমু ট্রেন মেরামত করার মতো অভিজ্ঞ প্রকৌশলী না থাকায় নষ্ট ট্রেন চালু করা যাচ্ছে না।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) হাবিবুর রহমান সমকালের সঙ্গে কথা বলেননি। তিনি অপর এক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। তবে রেলওয়ের অপর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, যেসব ডেমু ট্রেন আমদানি করা হয়েছে, তার কোনোটিই বাংলাদেশের রেল অবকাঠামো ও পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। যে কারণে ডেমু ট্রেনের মাধ্যমে যে সেবা দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল তা অর্জিত হয়নি। এমনকি এ প্রকল্প চালুর পর থেকে রেলওয়ে লোকসান গুনে যাচ্ছে। এই ট্রেনে লাইট, ফ্যান, এসি নেই। নেই জানালা, টয়লেট। এই ট্রেন কিনেছে মেকানিক্যাল বিভাগ। কেনার সময় ট্রাফিক ও ইলেকট্রিকাল বিভাগের মতামত নেওয়া হয়নি। ট্রাফিক বিভাগই ট্রেন চলাচল কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এখন অনেক সময় ট্রেন নষ্ট হয়ে পড়ে থাকছে। মেকানিক্যাল বিভাগ ঠিক করতে পারছে না। ফলে ডেমু ট্রেনের সেবা অব্যাহত রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
সোলার প্যানেল : কথা ছিল সূর্যের রশ্মি ও তাপ শুষে নিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে সোলার প্যানেল। আর সূর্য অস্ত যাওয়ামাত্র জ্বলে উঠবে সড়কবাতি। কম খরচে নগরীর একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক আলোকিত করার পাশাপাশি সৌন্দর্য বাড়ানোর লক্ষ্যে স্থাপন করা হয় সোলার প্যানেল। এ প্রকল্পে ব্যয় করা হয় ২ কোটি ২৪ লাখ ২১ হাজার ৬৫০ টাকা। কিন্তু ৬০ ওয়াটের এই সৌরবাতি চাহিদামতো আলো দিতে পারছে না। এতে সৌর বিদ্যুৎনির্ভর এই প্রকল্পে আশাব্যঞ্জক সুফল দেখছে না ডিএসসিসি।
এ পর্যায়ে পরীক্ষামূলক এ প্রকল্পের পরিবর্তে কী করা যায় তা নিয়ে ভাবছেন সংশ্নিষ্টরা। ডিএসসিসি সূত্র মতে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সৌরশক্তি ব্যবহার করে রাতে রাজধানীর সড়ক আলোকিত করতে পরীক্ষামূলকভাবে কাকরাইল মসজিদ থেকে নটর ডেম কলেজ পর্যন্ত সড়কে প্র্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়। বসানো হয় ৬১টি ল্যাম্পপোস্ট। প্রতিটি পোস্টের ওপর বসানো সাড়ে ৫ ফুটের এক জোড়া সোলার প্যানেল। ৬১টি পোলে মোট ১২২টি বাতির এই প্রকল্প বাস্তবায়নে বরাদ্দ ছিল ৩ কোটি ৯৪ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। তবে সর্বনিম্ন দরদাতা ২ কোটি ২৪ লাখ ২১ হাজার ৬৫০ টাকায় এই প্রকল্পের কাজ শেষ করে। কথা ছিল এতে সফলতা এলে পরে রাজধানীর আরামবাগ, বাংলামটর, গুলশান, হাতিরঝিল, নাবিস্কো এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়ও প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। তবে বাস্তবায়নের কিছুদিন পরই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হতে থাকে। কারণ রাতে অধিকাংশ বাতি জ্বলে না। এ প্রকল্পে প্রতিটি বাতির ওয়ারেন্টি ২০ বছরের। আর সোলার প্যানেলের ক্ষেত্রে ৫ বছর ও ব্যাটারির ৩ বছরের গ্যারান্টি। এসব শর্ত কাগজে থাকলেও বাস্তব অবস্থা ভিন্ন।
জানতে চাইলে সৌর বিদ্যুতে সড়কবাতি প্রকল্প বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, প্রকল্পটি পরীক্ষামূলক ছিল। ঢাকার পরিবেশ এ প্রকল্পের জন্য সহায়ক নয়। বিশেষ করে ধুলাবালির কারণে প্যানেলগুলোতে প্রচুর ময়লা জমে, যে কারণে সঠিকভাবে কাজ করতে পারেনি। ফলে প্রকল্পটি ফলপ্রসূ হয়নি। এসব বিবেচনায় নতুন করে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার পরিকল্পনা নেই।
সড়কে কাঁটা প্রতিরোধক: ২০১৪ সালের মে মাসে রাজধানীর হেয়ার রোডে উল্টোপথে গাড়ি চলাচল বন্ধ করতে ঢাকার ট্রাফিক বিভাগ কাঁটাওয়ালা এক ধরনের যন্ত্র বসায়। সপ্তাহ না ঘুরতেই অনিয়ম প্রতিরোধের লক্ষ্যে বসানো ব্যবস্থাটি অকেজো হয়ে পড়ে। এরপর আরও শক্তিশালী কাঁটা বসানো হলেও তাও কাজ করেনি।
শহরের যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ময়লা-আবর্জনার সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য সড়কের পাশে ডাস্টবিন বসিয়েছিল দুই সিটি করপোরেশন। প্রায় ৬ কোটি টাকা খরচ করে গত বছরের মাঝামাঝি সময় বসানো হয় প্রায় সাড়ে ৬ হাজার মিনি ডাস্টবিন। এরমধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বসায় পাঁচ হাজার ৭০০ ডাস্টবিন। সঠিক তদারকির অভাবে ও জনসাধারণের অসচেতনতার কারণে এ প্রকল্পটি এখন অনেকটাই ভেস্তে যেতে বসেছে। এসব ডাস্টবিন উল্লেখযোগ্য ব্যবহার হচ্ছে না। অনেক ডাস্টবিন ভেঙে গেছে, কিছু চুরি হয়ে গেছে। ডাস্টবিনগুলো বসানোর আগে এ নিয়ে তাদের যথেষ্ট পর্যালোচনা ছিল না বলে নগর বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
বাসে ইন্টারনেট: ঢাকার রাস্তায় জ্যামে আটকে থেকেও যাত্রীরা যাতে বাসে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন, এমন ভাবনা থেকে ২০১৪ সালের এপ্রিলে চালু হয়েছিল ডিজিটাল বাস। মতিঝিল থেকে উত্তরার পথে বিআরটিসির ১৫টি বাসে বসানো হয় রাউটার, ছিল বিনা মূল্যে ওয়াই-ফাই ইন্টারনেট। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে এসে সেই বাসের চাকা থেমে থেমে ঘুরলেও ইন্টারনেট বন্ধ। দু-একটি বাসে কচ্ছপগতির ইন্টারনেট নিয়ে রাউটার সচল থাকলেও বেশিরভাগই ফিরেছে সাধারণ বাসের কাতারে।
অনেক ঘটা করে যাত্রা শুরু করেছিল রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে চলন্ত সিঁড়ির আধুনিক ফুট ওভারব্রিজ। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে ওই সড়কের অংশে এটি তৈরি করেছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। তবে গত এক বছরে অন্তত পাঁচবার বিকল হয়েছে এর সিঁড়ি। প্রতিবার বিকল হওয়ার পর বন্ধ থেকেছে এক থেকে দেড় মাস। সর্বশেষ মাসখানেক আগে আবারও বিকল হয়ে পড়ে চলন্ত এ সিঁড়ি দুটি। এভাবে এক বছরের মধ্যে সাত মাসই বিকল থেকেছে এই চলন্ত সিঁড়ি। একই অবস্থা বনানীর চলন্ত সিঁড়ির ফুট ওভারব্রিজটিরও। সমকাল