সংসদীয় কমিটিকে দেয়া বিপিসির চিঠিতে বলা হয়েছে, গত ১৬ বছরে ১৩টি রিফাইনারি কোম্পানি পেট্রোবাংলার কাছ থেকে ১৮৬ কোটি ৯৩ লাখ লিটার কনডেনসেট নিয়েছে। এ ছাড়া আমদানি করা কনডেনসেটের পরিমাণ ছিল ২৬ কোটি ৬৭ লাখ লিটার। আমদানিসহ মোট কনডেনসেট নিয়েছে ২১২ কোটি লিটার। কিন্তু জ্বালানি তেল (অকটেন-পেট্রুল) হিসেবে পরিশোধন করে বিপিসিকে দিয়েছে মাত্র ১০৩ কোটি ৮৭ লাখ লিটার। বিপিসি বলছে, এ সময়ে মোট ১০৮ কোটি লিটার কনডেনসেটের কোনো হিসাব দিতে পারেনি ১৩ রিফাইনারি কোম্পানি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপিসির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, রিফাইনারিগুলো এই ১০৮ কোটি লিটার কনডেনসেট পরিশোধন না করে অকটেন পেট্রুলের সঙ্গে মিশিয়ে ভেজাল আকারে পেট্রুল পাম্পগুলোতে বিক্রি করে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, লিটারপ্রতি অকটেন ও পেট্রুল ও ডিজেলের মাঝামাঝি রেট ৭০ টাকা হিসাবে ধরলে মোট ৭ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। একই সঙ্গে ১৬ বছরে ১০৮ কোটি লিটার ভেজাল তেল বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে।
এ নিয়ে গত সপ্তাহে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ এনেছে এ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। বেসরকারি রিফাইনারি কোম্পানিগুলোকে কনডেনসেট বরাদ্দ দেয়া নিয়ে তারা প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করেছেন। তাদের অভিযোগ, কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে প্রতিমন্ত্রী তার পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কনডেনসেট বরাদ্দ দিচ্ছেন।
গত রোববার জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে একপর্যায়ে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এবং সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি তাজুল ইসলামের মধ্যে যুক্তিতর্ক হয়েছে। এ বিষয়ে কমিটির সভাপতি তাজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, কনডেনসেটের বণ্টনে অসামঞ্জস্য আছে। কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময় সংসদীয় কমিটির কাছে অভিযোগ দিয়েছে। তিনি বলেন, কনডেনসেট নিয়ে বেশকিছু অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে এটা ঠিক। তবে ঢালাওভাবে সবাইকে অভিযুক্ত করা ঠিক হবে না। তার মতে, যারা কনডেনসেট নিয়ে অনিয়ম করেছে, ভেজাল করেছে তাদের প্রতি আমাদের কোনো সহানুভূতি নেই। কিন্তু যারা ভালো কোম্পানি তাদের ক্যাপাসিটি অনুযায়ী কনডেনসেট বণ্টন করার বিষয়ে আমাদের মধ্যে বৈঠকে কথা হয়েছে। তিনি বলেন, কোনো পক্ষ সুবিচার চাইলে তা খতিয়ে দেখার অধিকার সংসদীয় কমিটির আছে। তিনি বলেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখতে ইতিমধ্যে একটি সংসদীয় উপ-কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি অচিরেই এ বিষয়ে প্রতিবেদন দেবে। তখন বিষয়টি নিয়ে মূল কমিটিতে বিস্তারিত আলোচনা হবে।
বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, পেট্রোবাংলার কাছ থেকে ১৩টি রিফাইনারি কোম্পানি কনডেনসেট ক্রয় করেছে। এর মধ্যে সুপার রিফাইনারি, পেট্রোম্যাক্স রিফাইনারি, সুপার পেট্রো রিফাইনারি, অ্যাকোয়া রিফাইনারি, পিএইচপি রিফাইনারি, সিনথেটিক রিফাইনারি, জেবি রিফাইনারি, ইউনিভার্সেল রিফাইনারি, রূপসা রিফাইনারি, সিভিও পেট্রো কেমিক্যাল রিফাইনারি, লার্ক রিফাইনারি, গোল্ডেন রিফাইনারি, চৌধুরী রিফাইনারি রয়েছে। এর মধ্যে সুপার, পেট্রোম্যাক্স ও সিনথেটিক রিফাইনারি বিদেশ থেকেও কনডেনসেট আমদানি করছে।
বিপিসির হিসাব অনুযায়ী গত ১৬ বছরে সুপার রিফাইনারি পেট্রোবাংলার কাছ থেকে কনডেনসেট নিয়েছে ৯২ কোটি ১৬ লাখ লিটার। আর বিদেশ থেকে আমদানি করেছে ২৪ লাখ ৩৮ হাজার লিটার। মোট কনডেনসেটের পরিমাণ ৯২ কোটি ৫৪ লাখ লিটার। কিন্তু পরিশোধনের পর বিপিসির কাছে জ্বালানি তেল বিক্রি করেছে মাত্র ২৭ কোটি ৯২ লাখ লিটার। অর্থাৎ উৎপাদনের সঙ্গে বিপিসির কাছে তেল সরবরাহের হার মাত্র ৩১ দশমিক ২১ শতাংশ। ৬৪ কোটি ৬২ লাখ লিটারের কোনো হদিস নেই। ধারণা করা হচ্ছে বাকি এই ৭০ শতাংশ ভেজাল হয়েছে। অপর দিকে পেট্রোম্যাক্স পেট্রোবাংলার কাছ থেকে ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত কনডেনসেট নিয়েছে ২২ কোটি ২১ লাখ লিটার আর আমদানি করেছে ২৪ কোটি ৮৪ লাখ লিটার। সবমিলিয়ে তাদের কনডেনসেট ক্রয়ের পরিমাণ ছিল ৪৭ কোটি পাঁচ লাখ লিটার। এই কোম্পানি পরিশোধনের পর বিপিসির কাছে তেল আকারে ফেরত দিয়েছে ৪২ কোটি ২১ লাখ লিটার। এই হিসাবে কোম্পানিটির তেল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৯৩ শতাংশ। প্রায় পাঁচ কোটি লিটারের কোনো হদিস নেই। সুপার পেট্রো লিমিটেড নিয়েছে ১৭ কোটি এক লাখ লিটার। আর ফেরত দিয়েছে ১৪ কোটি ১৮ লাখ লিটার। তাদেরও তেল উৎপাদনের পরিমাণ ৯৩.১৮ শতাংশ। খোঁজ নেই বাকি তিন কোটি লিটারের। অ্যাকোয়া রিফাইনারি ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত কনডেনসেট নিয়েছিল ১৭ কোটি ৯৮ লাখ লিটার। আর ফেরত দিয়েছে আট কোটি ৭০ লাখ লিটার। তাদের তেল পরিশোধনের শতকরা হার ছিল ৪৯.৭৯ শতাংশ। পিএইচপি রিফাইনারি ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত কনডেনসেট নিয়েছে সাত কোটি চার লাখ লিটার। তারা বিপিসিকে ফেরত দিয়েছে তিন কোটি দুই লাখ লিটার। বাকি তিন কোটি ৬৯ লাখ লিটারের হদিস মেলেনি। তাদের তেল পরিশোধনের পরিমাণ ছিল শতকরা ৪৫ দশমিক ১৪ শতাংশ। সিনথেটিক রিফাইনারি ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত আমদানিসহ কনডেনসেট নিয়েছিল ছয় কোটি ৪৪ লাখ লিটার। আর জ্বলানি তেল হিসাবে ফেরত দিয়েছে এক কোটি ৯১ লাখ লিটার। বাকি তিন কোটি ৮৭ লাখ লিটারের কোনো হদিস নেই। এই কোম্পানির তেল পরিশোধনের শতকরা হার ছিল ৩৩ দশমিক ১০ শতাংশ। জেবি রিফাইনারি ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত কনডেনসেট নিয়েছে দুই কোটি ৫৪ লাখ লিটার। আর তেল পরিশোধন করে ফেরত দিয়েছে ৯৯ লাখ লিটার। বাকি এক কোটি ৪৭ লাখ লিটার কনডেনসেটের কোনো হিসাব নেই বিপিসির কাছে। এই কোম্পানির তেল পরিশোধনের শতকরা হার ছিল ৪০ দশমিক ৪২ শতাংশ। ইউনিভার্সেল রিফাইনারি ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত কনডেনসেট নিয়েছে তিন কোটি ৪৮ লাখ লিটার। আর পরিশোধন করেছে মাত্র এক কোটি ৭০ লাখ লিটার। হিসাব নাই এক কোটি ৭৭ লাখ লিটারের। কোম্পানির তেল পরিশোধনের শতকরা হার ছিল ৪৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ। রূপসা রিফাইনারি ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত কনডেনসেট নিয়েছে পাঁচ কোটি ৪৭ লাখ লিটার। আর পরিশোধনের পর ফেরত দিয়েছে দুই কোটি ৬৫ লাখ লিটার। দুই কোটি ৬৫ লাখ লিটারের কোনো হদিস নেই। এই কোম্পানির তেল পরিশোধনের পরিমাণ ৪৯ দশমিক ৯০ শতাংশ। সিভিও পেট্রো কেমিক্যাল কোম্পানি ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কনডেনসেট নিয়েছে তিন কোটি ৬৮ লাখ লিটার। আর পরিশোধনের পর ফেরত দিয়েছে মাত্র ১৩ লাখ লিটার। তিন কোটি ৩৫ লাখ লিটার কনডেনসেটের কোনো হিসাব নেই বিপিসির কাছে। এই কোম্পানির কনডেনসেট পরিশোধনের পরিমাণ ৩ দশমিক ৯০ শতাংশ। লার্ক রিফাইনারি ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত কনডেনসেট নিয়েছে তিন কোটি ১১ লাখ লিটার। আর ফেরত দিয়েছে মাত্র ৩০ লাখ লিটার। মোট দুই কোটি ৭৫ লাখ লিটার কনডেনসেটের কোনো হিসাব নেই বিপিসির কাছে। কোম্পানিটির তেল পরিশোধনের শতকরা হার ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ। গোল্ডেন রিফাইনারি ১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত কনডেনসেট নিয়েছে তিন কোটি ১৮ লাখ লিটার। আর ফেরত দিয়েছে এক লাখ ৬০ হাজার লিটার। অর্থাৎ তিন কোটি তিন লাখ লিটার কনডেনসেটের কোনো হিসাব নেই। কোম্পানিটির তেল পরিশোধনের শতকরা হার দশমিক ৫৩ শতাংশ। এ ছাড়া চৌধুরী রিফাইনারি ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত কনডেনসেট নিয়েছে তিন কোটি ৪২ লাখ লিটার। ফেরত দিয়েছে মাত্র ১৭ লাখ লিটার। তিন কোটি ১৪ লাখ লিটার কনডেনসেটের কোনো হিসাব নেই। কোম্পানিটির কনডেনসেট পরিশোধনের পরিমাণ মাত্র ৫ দশমিক ১৩ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, জ্বালানি তেল নিয়ে এই অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় জড়িত কোম্পানিগুলোকে এক বছরের মতো কনডেনসেট সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছিল। এখন মুচলেকা দিয়ে সবাইকে কনডেনসেট সরবরাহ করা হচ্ছে।
সিভিও পেট্রোর উপব্যবস্থাপনা পরিচালক নিজাম উদ্দিন কিছু দিন আগে বলেছেন, জ্বালানি মন্ত্রণালয় ও বিপিসি যেভাবে অভিযোগ করছে তা পুরোপুরি সঠিক নয়। তদন্ত শেষ হওয়ার আগে তাদের কনডেনসেট সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বিধিবিধান অনুসরণ করেই আমরা যাবতীয় কাজ করার কারণে তদন্ত শেষে আবার চালু করা হয়।
বর্তমানে দেশে তিনটি সরকারি ও ১২টি বেসরকারি তেল রিফাইনারি কোম্পানি রয়েছে। তারা পেট্রোবাংলার কাছ থেকে কনডেনসেট কেনে। কনডেনসেট থেকে পেট্রুল, অকটেন ও অন্যান্য জ্বালানি তেল উৎপাদন করে বিপিসির কাছে বিক্রি করে। কিন্তু অভিযোগ আছে কিছু রিফাইনারি পেট্রুলপাম্প মালিকদের সঙ্গে যোগসাজশে ক্রয় করা কনডেনসেট পরিশোধন (রিফাইন) না করেই পুরোটাই ভেজাল আকারে পাম্পগুলোতে বিক্রি করে দিচ্ছে। এর ফলে গাড়ির ইঞ্জিন নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই বিকল হয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি দূষণ হচ্ছে পরিবেশও।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জ্বালানি বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, কনডেনসেট পরিশোধন করতে গিয়ে ২ থেকে ৩ শতাংশ ‘প্রসেস লস’ হয়। কিছু অংশ দিয়ে জ্বালানি তেল ছাড়াও অন্য উপজাত তৈরি হয়। কিন্তু কোম্পানিগুলো এ সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। তিনি বলেন, পুরো কনডেনসেট তারা বিভিন্ন পেট্রুলপাম্পে বিক্রি করে দিয়েছে বলে অভিযোগ আছে। ইতিমধ্যে প্রায় ১৫০০ কোটি টাকার দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ১৩ রিফাইনারির বিরুদ্ধে তদন্ত করছে।
সূত্র জানায়, রিফাইনারিগুলো পেট্রোবাংলার কাছ থেকে প্রতি লিটার কনডেনসেট ক্রয় করে ৪৪ টাকা করে। আর বর্তমানে প্রতি লিটার পেট্রুল ৭৮ টাকা ও ডিজেল বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকা করে। অভিযোগ আছে, কিছু অসাধু রিফাইনারি পেট্রোবাংলার কাছ থেকে ৪৪ টাকায় কনডেনসেট ক্রয় করে তা কোনো রকম পরিশোধন ছাড়াই ভেজাল আকারে পেট্রুল, অকটেন ও ডিজেল বলে পেট্রুলপাম্পের কাছে ৭০-৭২ টাকা দরে বিক্রি করে দিচ্ছে। যুগান্তর