ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট:গোলাম মাওলা রনি :বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সবচেয়ে মর্মান্তিক এবং দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতিতে কেন আমার মনে সংগঠনটির আমিরকে প্রশ্ন করার সাধ জাগল তা নিয়ে দু-চারটি কথা বলার আগে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং প্রেক্ষাপট নিয়ে কিছু বলা আবশ্যক। বর্তমানের অস্বস্তিকর এবং গুমোট রাজনৈতিক পরিস্থিতির শুরুটা হয়েছিল বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতার শেষ বছর থেকে যখন বিএনপি অতিমাত্রায় জামায়াতনির্ভর হয়ে পড়েছিল এবং কোনোমতে যেনতেন ধরনের একটি ধামাচাপা মার্কা নির্বাচনের জন্য সদরে-অন্দরে নানামুখী তত্পরতা চালাচ্ছিল।
এরশাদ সরকারের পতনের পর নির্বাচনে কারচুপি, বিনা ভোটের নির্বাচনে এমপি পদে লোক নিয়োগের সংস্কৃতি এবং দুরাচার চালু হয়েছিল কুখ্যাত মাগুরার নির্বাচন এবং ঢাকার তেজগাঁও সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে জাল জালিয়াতির মাধ্যমে।
বিগত বিএনপি জোট মাগুরা ও তেজগাঁওয়ের সফলতার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এমন কিছু করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিল যেমনটি বর্তমান সরকার করেছে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হলো— বিএনপি-জামায়াত জোট যা পারেনি বর্তমান সরকার তা পেরেছে। ফলে বর্তমানের অস্বস্তিকর রাজনীতি হয়তো ২০০৭ সালেই আরম্ভ হতো এবং আওয়ামী লীগসহ তাদের মহাজোটের শরিকদের কপালে তাই ঘটত যা এখন বিএনপি-জামায়াতের কপালে ঘটছে। যদি সেদিন বিএনপি-জামায়াত সফল হতো এবং ১/১১-এর ঘটনা না ঘটত।
বিরোধী দল আজ রাজপথে দাঁড়াতে পারে না পুলিশি অনুমতির অভাবে। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে নির্বিচারে সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে হত্যা, গুম, ক্রসফায়ার, গ্রেফতার এবং নির্বিচারে গুলিবর্ষণের বহু অভিযোগ করতে করতে বিরোধী দল ক্লান্ত হওয়ার আগে একবারও চিন্তা করেনি যে, আইনগুলো তারাই করেছিল এবং সেই আইনের অপপ্রয়োগের শুরুটা তাদের হাতেই হয়েছিল। বর্তমান সরকার শুধু সাবেক সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলেছে মাত্র।
প্রশাসনে দলীয়করণ, অযোগ্য লোকদের যোগ্য পদে বসানো, যোগ্য লোকদের নাজেহাল এবং নির্বাসনে পাঠানো, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় কার্যালয় বানানো, সব সরকারি নিয়োগ-বদলি ও পদোন্নতিতে দলীয় লোকদের একচ্ছত্র আধিপত্যের যে সংস্কৃতি বর্তমানে চালু রয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়, তার নির্লজ্জ অপপ্রয়োগ এবং অপব্যবহার শুরু হয়েছিল ২০০১ সালের পর।
স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস মাত্র ৪৬ বছরের। প্রথম ১০ বছর ছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সুসময় ও দুঃসময়ের জটিল সমীকরণ। অন্যদিকে, সময়টা ছিল জামায়াতের জন্য নীরবে বেড়ে ওঠা এবং সময় ও সুযোগমতো রাজনীতিতে অভিষিক্ত হওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণ। পরবর্তী ১০ বছর ছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অগ্নিপরীক্ষা এবং জামায়াতের বিস্তার লাভের সুবর্ণ সুযোগ। স্বাধীনতার তৃতীয় দশক ছিল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের জন্য ঐশ্বরিক সুযোগ এবং গণতন্ত্রের জন্য তুলনামূলক নিরাপদ অভয়াশ্রম। চতুর্থ দশকটি ছিল সবার অর্থাৎ রাজনীতিসংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর মন-মস্তিষ্ক ও চরিত্রের জটিলতা, অপকর্ম, অনিয়ম এবং কুকর্মের বীজ থেকে ফসল জন্মানোর ক্রান্তিকাল। পঞ্চম দশকে এসে পূর্ববর্তী দশকের শ্রমের ফসল এমনভাবে ফলদায়ক হয়েছে যার ফলভারে সৃষ্টি হয়েছে নতুন এবং অদ্ভুত এক গণতন্ত্রের; যা নিয়ে দুনিয়াব্যাপী আলোচনা-সমালোচনার অন্ত নেই।
স্বাধীনতার পঞ্চম দশকের রূঢ় বাস্তবতা হলো— নব্য গণতন্ত্রের জন্য শক্তিশালী বিরোধী দলের দরকার নেই। অন্যদিকে, বিরোধী দলের চরিত্র, আকার-আয়তন এবং নিয়তিও পাল্টে গেছে। একদল বিরোধীকে বলা হচ্ছে গৃহপালিত, অন্য দলকে বলা হচ্ছে পকেট বা বগলজাত গোষ্ঠী। বিরোধীদের কিছু অংশ পাচ্ছে রাজভোগ আর অন্য অংশ করছে হা পিত্যেশ। এক গ্রুপ ভয় পেয়ে দেশ-বিদেশে পালিয়ে থাকছে, অন্য গ্রুপ মামলা-হামলার শিকার হয়ে জেল-জুলুম ভোগ শেষে সুবোধ বালক-বালিকার ন্যায় গৃহমুখী হয়ে রাজনীতির আদর্শলিপি পাঠ শুরু করেছে এবং প্রেমময়ীর আঁচলের সার্থকতা খুঁজে বেড়াচ্ছে। বিশাল গ্রুপের বিরোধী অংশটি সরকারের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায় নিজেদের মধ্যে এমন প্রতিযোগিতা শুরু করেছে যা দেখে কট্টর সরকার সমর্থকরা আশ্চর্য হয়ে বলছেন, ও আমার খোদা! এসব হচ্ছেটা কী!
রাজনীতির উল্লিখিত বাস্তবতায় সবাই ইয়া নফিস, ইয়া নফিস শুরু করেছেন। সরকারের হাতে একটুও সময় নেই বিরোধী দল নিয়ে ভাবার। নিজেদের সব সামলানো নিয়ে তারা এতটাই ব্যস্ত যে, বিরোধী দলের কর্মকাণ্ডের দিকে নজর করার সময় নেই, তেমনি তারা সেটার প্রয়োজনও মনে করছে না। বিরোধী দল এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। সরকার পতন এবং ক্ষমতায় যাওয়ার চেয়ে কোনোমতে টেনেটুনে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তারা দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। নিজেদের দৃশ্যমান পরিণতি ক্ষমতাবানদের হাতে এবং অদৃশ্য পরিণতি বিধাতার হাতে সঁপে দিয়ে এক অতি আশ্চর্যজনক বেশ ধারণ করে সময় পার করে দিচ্ছে। বর্তমান কালের এই অপ্রিয় ও নির্মম বাস্তবতার জন্য কেবল জামায়াতে ইসলামীর অনুগত নেতা-কর্মী ছাড়া রাজনীতিসংশ্লিষ্ট সবাই একবাক্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নামক দলটিকে দায়ী করেছেন এবং তারা প্রকাশ্যে জামায়াতিদের সংশ্রব ও সংসর্গ এড়িয়ে চলছেন।
সরকারি দল এবং তাদের মিত্ররা দশমুখে জামায়াতবিরোধী প্রচার চালাচ্ছেন। অন্যদিকে জামায়াতের রাজনীতি দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে শেষ মুহূর্তে জামায়াতকে নির্মূল করার আইনগত এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়াও শেষ পর্যায়ে। সরকারি হিসাবে জামায়াতের সমর্থক দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৮%। এই বিশাল কর্মী ও সমর্থক গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ও সাংগঠনিক শক্তির কেন্দ্রগুলো প্রায় ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। শক্তির এককগুলোকে একটি থেকে অন্যটিকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। অব্যাহত প্রচার-প্রপাগান্ডা এবং কঠোর সরকারি নীতিমালা ও রক্তচক্ষুর শাসানির কারণে বাংলাদেশের কেউ যেমন প্রকাশ্যে বলতে পারছেন না যে, আমি জামায়াত করি তেমনি জামায়াতের মিত্ররাও সাহস ও নৈতিক মনোবল নিয়ে বলতে পারছেন না যে আমরা জামায়াতের সঙ্গে আছি এবং থাকব।
গত সাত বছরের কঠোর বাস্তবতা হলো জামায়াতের অর্থনৈতিক ভিত্তি ভেঙে পড়েছে। মূল নেতৃত্ব ধীরে ধীরে গত হয়েছেন। বর্তমান নেতৃত্ব মূলত আদি ও আসল জামায়াতের তৃতীয় বা চতুর্থ সারির পর্যায়ে থেকে সামনের দিকে এগোনোর প্রক্রিয়ায় ছিলেন। সব কিছু স্বাভাবিক থাকলে বর্তমান নেতৃত্ব আগামী ১০ বছরেও সংগঠনটির দ্বিতীয় সারির নেতৃত্বে পৌঁছতে পারতেন কিনা সন্দেহ। ফলে জামায়াতের নীতি-আদর্শ এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে বর্তমান নেতৃত্বের আত্মিক বন্ধন থাকা সত্ত্বেও চরম বাস্তবতায় সব কিছু সামাল দেওয়া এবং সব দায়দায়িত্বের ভার বহন করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। দলীয় কার্যালয় বন্ধ থাকা, প্রকাশ্য রাজনীতির নৈতিক মনোবল হারিয়ে ফেলা, সীমাহীন হতাশা, বিপদাপদ, বালা-মুসিবত, রাজনৈতিক বন্ধুহীনতা, দলীয় রাজনীতির প্রথাগত কাজকর্ম প্রকাশ্যে না করতে পারা এবং রাজনৈতিক ময়দানে অচ্ছুত হওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বন্ধুদের সাম্প্রতিক দুঃখ-দুর্দশা ও বিপর্যয়ের কারণে জামায়াতে ইসলামীকে ইতিহাসের সবচেয়ে কষ্টকর সময় পার করতে হচ্ছে।
এত কিছুর পরও বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতের নেতিবাচক প্রভাব একটুও কমেনি। জামায়াতের প্রতিপক্ষরা তাদের চিরায়ত জামায়াতভীতি কাটিয়ে ওঠা তো দূরের কথা উল্টো নিত্যনতুন আশঙ্কায় উত্কণ্ঠিত হয়ে পড়েছে। প্রতিপক্ষের অতি আগ্রহ এবং বাড়াবাড়ি মূল্যায়নের কারণে বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্ক অটুট রয়েছে। অথচ বর্তমান পরিস্থিতিতে চমৎকার একটি রাজনৈতিক রসায়ন সৃষ্টির জন্য কৌশলগত কারণে হলেও জামায়াত ও বিএনপির মধ্যে নিরাপদ দূরত্ব অপরিহার্য। অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াতের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এবং রাজনীতির ময়দানে গণতন্ত্রের বাতাস ফিরিয়ে আনার স্বার্থে সরকারি ও বিরোধী জোটে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ ছাড়া আলাদা রসায়ন সৃষ্টি হবে না। জামায়াত যদি ভিন্ন প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে যায় তবে সরকারি শিবিরে ভাঙন এবং বিএনপি শিবিরে নতুন শক্তিসমূহের আগমন অপরিহার্য হয়ে পড়বে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সব পক্ষের জন্য একটি নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হবে যা মোকাবিলা করতে গিয়ে গণতন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ ছাড়া কোনো পক্ষের কাছে বিকল্প পথ খোলা থাকবে না।
দেশীয় রাজনীতির দুর্দশা এবং জামায়াতের নির্মূল হওয়ার সম্ভাবনা থেকে দলকে এই মুহূর্তে বাঁচানোর জন্য সবচেয়ে সাহসী ভূমিকা রাখতে পারেন জামায়াতের বর্তমান আমির। আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে আমার মনে জামায়াতের আমিরকে প্রশ্ন করার সাধ জেগেছে অন্য একটি কারণে। এই মুহূর্তে সরকারের বড় বিপদ ও বিপত্তির কারণ হলো ধর্মীয় উগ্রবাদ মোকাবিলা করা। সরকার শত চেষ্টা করেও দেশের ৯০ ভাগ মুসলমান জনগোষ্ঠী থেকে ৮ ভাগ জামায়াতিকে আলাদা করতে পারছে না। সরকারি শক্তিসমূহ জামায়াতিদের টার্গেট করতে গিয়ে নিরীহ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রায়ই বিপদের মুখে ফেলে দিচ্ছে। এতে একদিকে যেমন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হচ্ছে অন্যদিকে ধর্মীয় উগ্রবাদ বিভেদ ও বিসম্বাদ সৃষ্টি হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে জামায়াত যদি অত্যন্ত খোলামেলা হৃদয় নিয়ে পরিস্থিতি বিবেচনা না করে এবং নিজেদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিরপেক্ষভাবে মূল্যায়ন না করে তবে নিজেদের কর্মী-সমর্থকরা আরও বিপদ ও বিপত্তিতে পড়বে। আগামীতে তাদের ওপর পুরো জাতি এমন সব দায়দায়িত্ব, অভিযোগ এবং কলঙ্ক আরোপ করবে যার জন্য তারা মূলত দায়ী নয়। জামায়াতকে বুঝতে হবে, বর্তমান পরিস্থিতির জন্য নিজেদের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যর্থতা, অন্যের কাঁধে ভর করে এগিয়ে যাওয়ার উদগ্র বাসনা, নিজেদের আধুনিক রাজনীতির নিয়ামকসমূহ থেকে দূরে রাখা, দল-রাজনীতি এবং সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রে অতিরক্ষণশীলতার নীতি গ্রহণ, অন্যরা যখন জামায়াতের অর্থবিত্ত, ক্ষমতা ইত্যাদি নিয়ে বাড়াবাড়িমূলক তথ্য-উপাত্ত পেশ করে, তখন নীরব থেকে সেসব প্রপাগান্ডাকে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করা, কোনো কারণ ছাড়াই বার বার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত পরিবর্তন এবং সুযোগসন্ধানী হওয়ার চেষ্টা, নিজেদের ওপর অতিমাত্রায় বিশ্বাস ও আস্থা, অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের অযোগ্য, অনুপযুক্ত এবং অধার্মিক ভাবা, নিজেদের খোদার বিশেষ আশীর্বাদপুষ্ট মনে করা ইত্যাদি কারণ দায়ী।
আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় দেখেছি, জামায়াতের অন্ধভক্ত দলীয় কর্মীরা দলীয় নেতৃত্ব সম্পর্কে সমালোচনা করতে জানেন না। দলের সিদ্ধান্তের বিকল্প চিন্তা তারা করতে পারেন না। দলীয় নেতৃত্বের হুকুম-আহকামের বিপরীতে কোনো কিছু বিশ্বাস করেন না। কর্মীদের এসব গুণ শান্তির সময়ে যেমন প্রশংসার দাবি রাখে তেমনি বিশৃঙ্খল পরিবেশে এগুলো জীবন-জীবিকা এবং অস্তিত্বের সংকট বলে বিবেচিত হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে একমাত্র শীর্ষ নেতৃত্বই পারেন তাদের কর্মীদের সঠিক ও যথার্থ দিকনির্দেশনা প্রদান করতে। জামায়াতের আমিরই হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি সত্য বললে দেশের ১২ ভাগ জনগোষ্ঠী বিশ্বাস করবে এবং সেভাবে নিজেদের পরিচালিত করবে। এ অবস্থায় জামায়াত আমির যদি নিম্নলিখিত প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজাসাপেক্ষে ভবিষ্যতের জন্য কর্মপন্থা উদ্ভাবন করতেন তাহলে সব পক্ষের কল্যাণ হতো : এক. তৎকালীন জামায়াত নেতৃত্ব কেন হঠাৎ করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় নেমে পড়েছিল। পুরো পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল অথবা সামরিক সরকারের সঙ্গে জামায়াতের তো কোনো দহরম-মহরম ছিল না। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের সময় পূর্ব পাকিস্তানে জামায়াতের দৃশ্যমান কোনো প্রভাব প্রতিপতি ছিল না। ’৭১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত জামায়াতের কোনো তত্পরতার খবর পাওয়া যায় না। কেন তারা ’৭১ সালের এপ্রিল থেকে হঠাৎ করে ইয়াহিয়া ও টিক্কা খানের দোসর হতে গেল?
দুই. মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কেন জামায়াতকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করলেন? কেন তিনি জামায়াতকে বিশ্বাস করার অল্প কয়েক মাস পর পুনরায় অবিশ্বাস শুরু করলেন এবং জামায়াতকে কোণঠাসা করার জন্য মাওলানা মান্নানকে মাঠে নামালেন? প্রেসিডেন্ট জিয়ার মৃত্যুর পর জামায়াতের ভূমিকা কী ছিল? প্রেসিডেন্ট এরশাদের শাসনের প্রথম তিন বছর জামায়াতের রাজনৈতিক অবস্থান, ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের ভূমিকা, আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্য করে এরশাদের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং পরবর্তীতে এরশাদবিরোধী রাজনীতির ময়দানে জামায়াতের ভূমিকা, নীতি ও আদর্শ কী ছিল?
তিন. কেন এবং কী কারণে ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে ঐক্য হয়নি। কী এমন ঘটনা ঘটল যার কারণে ১৯৯৪ সালের শেষের দিকে বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্য বাড়ল? তারপর ২০০১ সালে কেন এবং কী কারণে আওয়ামী লীগের সঙ্গে দূরত্ব ও বিএনপির সঙ্গে মিত্রতা সৃষ্টি হলো? কোন যুক্তিতে বিএনপির শরিক হিসেবে সরকারে যোগদান করা হয়েছিল? ১/১১-এর এর সময় জামায়াতের ভূমিকা এবং মইন উদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকারের ব্যাপারে তাদের নমনীয় মনোভাবের পেছনে কী অন্তর্নিহিত কারণ ছিল?
চার. যুদ্ধাপরাধ বিচারের ব্যাপারে কি কেবল সরকার ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিসমূহ দায়ী নাকি দলের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা একটি গ্রুপ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করেছে? ৫ জানুয়ারির নির্বাচনপূর্ব সহিংসতা, সন্ত্রাস, অবরোধ এবং ২০১৫ সালের জানুয়ারি-পরবর্তী সহিংসতা, অরাজকতা, ইত্যাদিকে জামায়াত কীভাবে মূল্যায়ন করে? দলের তরুণ তুর্কি যারা মূলত ভালো ছাত্র এবং দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে তাদের দিয়ে সহিংসতা করানো হয়েছে নাকি ভাড়া করা লোক এসব করেছে?
পাঁচ. সামাজিকভাবে ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের সাধারণ মানুষ ব্যক্তিগতভাবে এবং অর্থনৈতিক লেনদেন ও ব্যবসায়িক কজে বিশ্বাস করলেও কেন রাজনৈতিকভাবে একচুলও বিশ্বাস করে না? কেন দেশের ৮৮ ভাগ মানুষ সামাজিকভাবে তাদের এড়িয়ে চলে এবং একান্ত প্রয়োজন না হলে কেন সামাজিক বা আত্মীয়তার বন্ধনে জড়াতে চায় না? বিভিন্ন সময়ের রাজনৈতিক মিত্ররা কেন তাদের শুধু ব্যবহার করে কিন্তু বিশ্বাস ও আস্থায় রাখে না। কেন তাদের সামাজিক ও পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলোতে মিত্ররা নিমন্ত্রণ পর্যন্ত জানান না?
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও কলামিস্ট।