ক্রাইমবার্তা রিপোর্ট:রোহিঙ্গাদের দেখতে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে ফেনীতে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে অতর্কিত হামলা চালানো হয়েছে। ফেনী শহরের অদূরে মোহাম্মদ আলী বাজার এলাকায় আজ শনিবার বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে এই হামলা চলে। খালেদা জিয়ার গাড়ি হামলা এড়াতে সক্ষম হলেও বহরে থাকা গণমাধ্যমের গাড়িসহ শতাধিক গাড়ি নির্বিচারে ভাঙচুর করা হয়। সাংবাদিকসহ অর্ধশত নেতাকর্মী এতে আহত হয়েছেন।
এছাড়া ফেনী শহরসহ খালেদা জিয়ার যাত্রাপথের বিভিন্ন স্থানে আরো বাধার খবর পাওয়া গেছে। ফেনীতে হামলার পর পুলিশী নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে খালেদা জিয়া ফেনী সার্কিট হাউজ থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখে রওয়ানা হন।
বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে খালেদা জিয়ার গাড়ি পেরিয়ে যাওয়ার পর ফেনী শহরের চার কিলোমিটার আগে মোহাম্মদ আলীবাজারে একদল যুবক হামলা চালায়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় গণমাধ্যমের আটটি গাড়িসহ বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের শতাধিক গাড়ি।
একাত্তর, ডিবিসি, চ্যানেল আই ও বৈশাখী টেলিভিশন, একুশে টিভি, যমুনা, এটিএন নিউজের গাড়ি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এছাড়া প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের একটি মাইক্রোবাসও হামলামুখে পড়ে।
একাত্তর টিভির আলোকচিত্রী আলম হোসনে, সিনিয়র প্রতিবেদক শফিক আহমেদ গুরুতর আহত হয়েছেন।
বৈশাখী টিভির সিনিয়র রিপোর্টার গোলাম মোর্শেদও আহত হন।
এছাড়া কালের কণ্ঠ, নয়া দিগন্ত, যুগান্তর, যায়যায়দিন, সংগ্রাম, জিটিভি, আমাদের সময়সহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা হামলার শিকার হন।
সাংবাদিক পরিচয় দেয়ার পরও কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী মারধরের শিকার হন।
একাত্তর টিভির এক কর্মী ভিডিও ধারণ করতে গেলে তিনিও মারধরের শিকার হন।
একজন হামলাকারী দৌঁড়ে এসে ওই আলোকচিত্রীকে বলেন, একাত্তর-মেকাত্তর বুঝি না, তুই ক্যামেরায় ছবি কিল্লাই তুলবি? তোর ক্যামরা ভাঙিয়া হালামু। এ সময়ে ক্যামেরা নিয়ে টানা হেচড়া করে তারা।
হামলাকারীরা প্রকাশ্যে লাঠি হাতে বহরে থাকা গাড়িগুলোর সামনে গ্লাস ভাঙচুর করতে থাকে। বিএনপি ঢাকা মহানগর দক্ষিণসহ অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের বহু গাড়ি ভাঙচুর হয়। নেতাকর্মীদের গাড়ি থেকে নামিয়ে পিটিয়ে আহত করা হয়। পরে হামলার শিকার সাংবাদিকরা ফেনীর লালপুলের একটি হোটেলে এসে উঠে। সেখানে একদল সন্ত্রাসী এসে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপনারা এখান থেকে চলে যান। আমাদের নির্দেশনা আছে। নইলে বড় ধরনের বিপদ পড়বেন।’
এরকম হুমকির মুখে সাংবাদিকরা খাবার না খেয়ে হোটেল ত্যাগ করেন।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল বাশার জানান, তাদের বহরে থাকা মহানগর দক্ষিণের ১০/১১টি গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবক, ছাত্রদল, যুবদলের অনেক গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। অনেকে ভয়ে পালিয়ে যান।
হামলাকারীরা বহরে আসা গাড়িগুলো বেঁছে বেঁছে ভাঙচুর করতে দেখা গেছে। মোহাম্মদ আলী বাজারের কাছে বহরের বাইরে দূরপাল্লার বাসসহ ট্রাক ও প্রাইভেট কারগুলো ভাঙচুর করেনি। হামলাকারীদের হাতে অস্ত্রও দেখা গেছে।
খালেদা জিয়ার বহর কুমিল্লার দাউদকান্দি অতিক্রমের আগে দুপুরের দিকে দাউদকান্দিতে বিএনপির কয়েকটির গাড়ি ছাত্রলীগের সশস্ত্র যুবকরা ভাঙচুর করেছে বলে জানিয়েছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু।
এসময় বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদ, খন্দকার মাশুকুর রহমান বুলুর সাথে ছিলেন।
এছাড়া, মুন্সিগঞ্জের ভবের চর ও কুমিল্লার ইলিয়টগঞ্জের কাছে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা দুপুরে বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালায় বলে স্থানীয় বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেছেন। মুরাদনগরে হামলার ঘটনা ঘটেছে। ফেনীতে যাত্রাবিরতির সময় খালেদা জিয়ার সাথে নেতাকর্মীদের সাক্ষাৎ ঠেকাতে জেলার বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সড়কে অবরোধ করে বলে স্থানীয় বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেছেন।
এর আগে ফেনী সার্কিট হাউজে খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান, আবদুল আউয়াল মিন্টু, প্রচার সম্পাদক শহিদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, ফেনী জেলা সভাপতি আবু তাহের, সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন মিস্টার, সিনিয়র যুগ্মসম্পাদক রেহানা আখতার রানু প্রমুখ।
চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে রাত কাটিয়ে আগামীকাল রোববার বেলা ১১টায় সড়ক পথে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা হবেন বিএনপি নেত্রী। সেখানে সার্কিট হাউজে রাত কাটিয়ে সোমবার উখিয়ার বালুখালী, বোয়ালমারা ও জামতলী রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন ও ত্রাণ বিতরণের পরিকল্পনা রয়েছে তার।
আজ শনিবার সকাল পৌনে ১১টায় ঢাকার গুলশানের বাসা থেকে রওনা হওয়ার সময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদুসহ সিনিয়র নেতারা খালেদার সাথে ছিলেন।
শোডাউন: খালেদা জিয়ার যাত্রাপথে নেতা-কর্মীদের ঢল ছিল চোখে পড়ার মতো। কমপক্ষে দুইডজন স্পটে আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশী নেতারা ব্যাপক শোডাউন করেছেন। বেগম খালেদা জিয়াকে একনজড় দেখার জন্য সাধারণ মানুষও এতে শরীক হন। হাজার হাজার নেতা-কর্মী প্ল্যাকার্ড উচিয়ে, মাথায় ব্যান্ড বেধে শ্লোগানের তালে তালে পথে পথে তাদের নেত্রীকে শুভেচ্ছা জানান। খালেদা জিয়া গাড়ির ভেতর থেকে হাত নেড়ে শুভেচ্ছার জবাব দেন।
বিভিন্ন স্থানে পুলিশি বাধার খবর পাওয়া গেলেও শেষ পর্যন্ত কোনো কিছুই নেতা-কর্মীদের রুখতে পারেনি। খালেদা জিয়ার এ সফরকে কেন্দ্র করে দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে ব্যাপক প্রাণচাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে।
যাত্রাপথে রাজধানীর নয়া পল্টন, মতিঝিল, হাটখোলা, যাত্রবাড়ি, কাঁচপুর ব্রিজ মোড়, সোনারগাঁও মোড়, মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া, ভবেরচর, কুমিল্লার দাউদকান্দি, ইলিয়টগঞ্জ, নিমসার, চান্দিনা, ময়নামতি সেনানিবাস মোড়, কুমিল্লার বিশ্বরোড, চৌদ্দগ্রামের মিঞাবাজার, ফেনীর মহিপালসহ বিভিন্ন স্থানে হাজার হাজার নেতা-কর্মী মহাসড়কের দুই পাশে দাঁড়িয়ে খালেদা জিয়াকে শুভেচ্ছা জানায়। বিএনপি চেয়ারপারসন গাড়ির ভেতর থেকে হাত নেড়ে নেতা-কর্মীদের শুভেচ্ছার জবাব দেন। এসব জায়গায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের প্রতিকৃতির পাশাপাশি সংসদীয় নির্বাচনী এলাকার সম্ভাব্য প্রার্থী নেতা-কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে শোডাউন করে।
ঢাকার যাত্রাবাড়িতে সালাহউদ্দিন আহমেদ ও নবীউল্লাহ নবী, শনির আখড়ায় রতন চেয়ারম্যান, চিটাগাং রোডে নারায়ণগঞ্জের শাহ আলম, মো. গিয়াসউদ্দিন, অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান, আতাউর রহমান আঙ্গুর, অধ্যাপক রেজাউল করীম, বদরুজ্জামান খসরু, তৈমুর আলম খন্দকার, মোস্তাফিজুর রহমান ভুঁইয়া দীপু, নজরুল ইসলাম আজাদ, মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় আবদুল হাই, কামরুজ্জামান রতন, মীর সরফত আলী সপু, কুমিল্লার দাউকান্দিতে খন্দকার মোশাররফ হোসেন, খন্দকার মারুফ হোসেন, হোমনায় অধ্যক্ষ সেলিম ভুঁইয়া, দেবীদ্বারে আবদুল আউয়াল খান, ব্রাহ্মনপাড়ায় সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদ, আলেখার চরে হাজি আমিনুর রশীদ ইয়াসিন, বিশ্বরোডে কুমিল্লার সিটি মেয়র মনিরুল হক সাক্কু, চৈতি আবুল কালাম, মোবাশ্বের আলম ভুঁইয়া, মোরতাজুল করীম বাদরু, চৌদ্দগ্রামের মিঞাবাজারে কামরুল হুদা, ফেনী সদরে রেহানা আখতার রানু, ভিপি জয়নাল তাদের সমর্থকদের নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনকে শুভেচ্ছা জানান। কুমিল্লার মুরাদনগরের সাবেক এমপি শাহ মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদের হাজার হাজার নেতা-কর্মী-সমর্থক ইলিয়টগঞ্জে খালেদা জিয়াকে শুভেচ্ছা জানায়।
ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কে বিভিন্ন স্থানে হাজার হাজার নেতা-কর্মীর ও সাধারণ মানুষ ঢল নামে। ফলে ওই সবস্থানে ব্যাপক যানজটেরও সৃষ্টি হয়। ঢাকার চট্টগ্রাম সড়কে খালেদা জিয়ার গাড়িবহর কাঁচপুর ব্রিজের আগেই ব্যাপক যানজটের মুখ পড়ে। ঘণ্টা খানেক তার গাড়ি বসেছিলো। এসময়ে তার নিরাপত্তা কর্মীরা গাড়িটি ঘিরে রাখে।
নেতা-কর্মীদের স্রোত ডিঙিয়ে সামনে এগুতে বিএনপি চেয়ারপারসনের গাড়ির ধীর গতিতে চলার কারণে ফেনীতে পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় ছয় ঘণ্টা। সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে গুলশানের বাসা ‘ফিরোজা’য় বিএনপি চেয়ারপারসনের গাড়িবহর রওনা হয় চট্টগ্রামের পথে। বিএনপি চেয়ারপারসনের এই বহরের সাথে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদুসহ নেতৃবৃন্দ রয়েছেন।
গুলশান থেকে খালেদা জিয়ার যাত্রার পূর্ব মুহূর্তে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা দলের চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বিদেশ থেকে চিকিৎসা করে আসার পরই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রোহিঙ্গাদের দেখতে যাবেন এবং ত্রাণ বিতরণ করবেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি রওনা হচ্ছেন। তার এ সিদ্ধান্ত কর্মীদের মধ্যে অত্যন্ত আশা সৃষ্টি করেছেন, দেশনেত্রী মানুষের জন্যে, মানবতার জন্যে ছুটে যাচ্ছেন কক্সবাজারের রোহিঙ্গাদের পাশে।
এব্যাপারে সরকারের সহযোগিতা চেয়ে তিনি বলেন, আমরা আশা করি, পথিমধ্যে সরকারের সব ধরণের সহযোগিতা পাবো। আমাদেরকে পুলিশের মহাপরিদর্শক আশ্বাস দিয়েছেন যে, তারা দেশনেত্রীর যে নিরাপত্তা তা নিশ্চিত করবেন এবং একই সাথে এই সফর যাতে সুন্দরভাবে হয়, তাতে সহযোগিতা করবেন। দলের নেতা-কর্মীরা সুশৃঙ্খলভাবে রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়ে বেগম জিয়াকে যাতে শুভেচ্ছা জানাতে পারে সেজন্য জেলা নেতাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানান বিএনপি মহাসচিব। আমাদের নেতা-কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে তাদের নেত্রীকে সামনে দেখবেন সেজন্য যেন কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়- সেটাও আমরা নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছি। তারা রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে সন্মান জানাবেন, সংবর্ধনা জানাবেন।
দশ হাজার রোহিঙ্গা পরিবারের জন্য ত্রাণ: খালেদা জিয়ার এই সফরে দশ হাজার রোহিঙ্গা পরিবারের মধ্যে এবার ত্রান-সামগ্রী বিতরণ করা হবে বলে জানিয়েছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কি পরিমাণ ত্রাণ দেয়া হযে এটা বলা যাবে না। তবে এবার দশ হাজার পরিবারকে আমরা ত্রান দেয়ার ব্যবস্থা করবো