ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট:মিয়ানমারের আচরণে গভীর হতাশা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা সংকট নিরসন ইস্যুতে দেশটির কাছে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া আশা করা হয়েছিল তা পাওয়া যায়নি। বিশেষ করে কফি আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নে দেশটি গড়িমসি করছে বলেও ঢাকার অভিযোগ রয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে বাংলাদেশ। এ মর্মে একটি চিঠি নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্যসহ ১৫ সদস্য দেশের কাছে পাঠিয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এদিকে, রোহিঙ্গা পরিস্থিতি সরেজমিন দেখতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানবিক বিষয়ক কমিশনার ক্রিস্টোস স্টাইলিয়ানিডস ৩ দিনের সফরে আজ ঢাকায় আসছেন। এছাড়াও, পোপ ফ্রান্সিসের আসন্ন মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সফর এবং মিয়ানমারে আসন্ন এশিয়া-ইউরোপ মিটিংয়ের (আসেম) মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অপরদিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রভাবশালী সদস্য স্পেন রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশের পক্ষে জোরালোভাবে কাজ করবে। তবে এক্ষেত্রে কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার বিপক্ষে স্পেনের অখণ্ডতার পক্ষে বাংলাদেশের কাছ থেকে এখনই প্রকাশ্যে সমর্থন প্রত্যাশা করে দেশটি।
রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় প্রচেষ্টা সফল হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে পড়েছে। এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশ আবারও আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন আদায়ে জোরালো কূটনীতি শুরু করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের মিয়ানমার সফরকালে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি কফি আনান কমিশন রিপোর্ট বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার একমত হয়েছিল। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেশে আসার পর মিয়ানমার যে বিবৃতি দিয়েছে তাতে আনান কমিশন রিপোর্ট বাস্তবায়নের সিদ্ধান্তটি একতরফা বাদ দিয়ে দিয়েছে। এতে করে রোহিঙ্গা সংকট নিরসন নিয়ে মিয়ানমারের আন্তরিকতার অভাব স্পষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশ চিঠি দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘কফি আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নে মিয়ানমার গড়িমসি করছে। একথা আমরা চিঠি দিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সব সদস্য রাষ্ট্রকে জানিয়ে দিয়েছি। আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয়ভাবে সংকট নিরসনে আস্থা রাখতে পারছি না। কারণ তারা অঙ্গীকার করে তা পালন করে না।’
এদিকে, পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক রোববার সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমরা মিয়ানমারের কাছ থেকে এর চেয়ে ভালো প্রতিক্রিয়া আশা করেছিলাম। যেভাবে শুরু করেছিলাম, এ মুহূর্তে আমরা ঠিক বলতে পারছি না যে আমরা সন্তুষ্ট।’ তিনি স্থানীয় একটি হোটেলে ইউএন ওম্যান আয়োজিত একটি অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে এসব কথা বলেন। জানা গেছে, মিয়ানমার থেকে ফিরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় জাতিসংঘ ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের সঙ্গে বৈঠকেও মন্তব্য করেছেন যে, আন্তর্জাতিক চাপ ছাড়া মিয়ানমার সংকট সমাধানে আগ্রহী হবে না।
জানতে চাইলে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি আবদুল মোমেন রোববার বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের এ বিপর্যয় আমাদের জন্য সুযোগ নিয়ে এসেছে। বর্তমান পরিস্থিতির কারণে রোহিঙ্গা সমস্যার টেকসই স্থায়ী সমাধান খোঁজার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কেননা রোহিঙ্গা সংকটের দ্বিপক্ষীয় সমাধান পেতে অনেক দিন সময় লাগবে। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে চায় না। বাঙালি হিসেবে চিহ্নিত করে, রোহিঙ্গাদের প্রতি অসম্ভব বিদ্বেষ রয়েছে তাদের। ফলে এটা জাতিগত নির্মূল অভিযান যার দ্বিপক্ষীয় সমাধান সম্ভব হবে না। এ সমস্যার সমাধান করতে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক চাপ সৃষ্টি করা দরকার। চীন ও রাশিয়াকে বোঝাতে হবে যে, রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান না হলে গোটা অঞ্চল অনিশ্চিত হবে।’
তিনি আরও বলেন যে, ‘চীন ও রাশিয়াকে পক্ষে আনতে কূটনীতি আরও জোরদার করতে হবে। আমরা নিজেরা না করলে অন্য কেউ এ সংকটের সমাধান করে দেবে না। বাংলাদেশ থেকে উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি শক্তিশালী দেশগুলোর রাজধানীতে পাঠাতে হবে। তাছাড়া, এখন মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া উচিত।’
জাতিসংঘে বাংলাদেশের এ স্থায়ী প্রতিনিধি আরও বলেন, ‘চীন ও রাশিয়ার সম্ভাব্য ভেটোর কারণে নিরাপত্তা পরিষদে জোরালো প্রস্তাব পাস করা সম্ভব হবে না। তবে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে আমরা অনায়াসে প্রস্তাব পাস করাতে পারি। সাধারণ পরিষদের ১৯৩ দেশের মধ্যে ১২৮ দেশের ভোট পেলেই সাধারণ পরিষদে প্রস্তাব পাস হবে। চীন ও মিয়ানমার বিরোধিতা করে এ প্রস্তাব ঠেকাতে পারবে না। সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব পালন মিয়ানমারের জন্যে বাধ্যতামূলক নয়। তবে এটি একটি আইনি দলিল। সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবের আওতায় যুক্তরাষ্ট্র, ইইউসহ অনেক দেশ চাপ সৃষ্টি করতে পারবে। সিরিয়া কিংবা ইরাকের ব্যাপারে নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পাস করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব নিয়ে সেখানে অনেক কিছু হয়েছে।’
আবদুল মোমেনের মতে, ‘রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কালক্ষেপণ করা ঠিক হবে না। আয়রন ইজ হট নাও। লোহা ঠাণ্ডা হয়ে গেলে কিছুই হবে না। ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাধারণ পরিষদে প্রস্তাব পাস করা সম্ভব। তারপর থেকে জানুয়ারির পুরোটাই ধীরে চলে কার্যক্রম। ফেব্রুয়ারি আসতে আসতে পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হয়ে যেতে পারে।’
এদিকে, ইইউ কমিশনার ক্রিস্টোস স্টাইলিয়ানিডস ৩ দিনের সফরে আজ ঢাকায় আসছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে ইইউ কমিশনারের এ সফরকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে। ইইউ কমিশনার ক্রিস্টোস স্টাইলিয়ানিডস একজন মন্ত্রী পদমর্যাদার কর্মকর্তা। ইউরোপীয় ব্যবস্থায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারক। ইইউ ইতিমধ্যে মিয়ানমারের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা এবং মিয়ানমারের জেনারেলদের ইউরোপ ভ্রমণ নিষিদ্ধ করেছে। ক্রিস্টোস স্টাইলিয়ানিডস সোমবার ঢাকায় পৌঁছার পর মঙ্গলবার কক্সবাজার গিয়ে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করবেন। সেখানে কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলবেন। বুধবার তিনি ঢাকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। ঢাকায় ইইউ রাষ্ট্রদূত রেনসি তিয়েরিঙ্ক ইতিমধ্যে বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে মিয়ানমারের সদিচ্ছা নেই বলেই মনে হচ্ছে। এক্ষেত্রে, ইইউ যে আহ্বান জানিয়েছে তাতে মিয়ানমার সাড়া না দিলে দেশটির বিপক্ষে আরও কঠিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের সম্ভাবনা আছে। ইইউ কমিশনারের এবারের সফর মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কঠিন পদক্ষেপ নিতে সহায়ক হতে পারে। ইইউ রাষ্ট্রদূত অবশ্য আভাস দিয়েছেন যে, আসন্ন আসেম সম্মেলনে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আরও অনেক তৎপরতা চালানো হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ২০ ও ২১ নভেম্বর মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে ১৩তম আসেম পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এশিয়া ও ইউরোপের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এ সম্মেলনে মিলিত হচ্ছেন। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি ইতিমধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। মাহমুদ আলী এ সম্মেলনে যোগদান করবেন বলে জানা গেছে। অপরদিকে, ২৯ নভেম্বর ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের প্রধান ধর্মীয় নেতা পোপ ফ্রান্সিস মিয়ানমার সফরে যাচ্ছেন। পোপ অবশ্য মিয়ানমার সফর শেষে বাংলাদেশেও আসছেন। ইইউর অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য স্পেনের রাষ্ট্রদূত আলবারো দে সালাস রোববার সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘পোপের আসন্ন মিয়ানমার সফর এবং মিয়ানমারে আসেম সম্মেলন ইইউর পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের সবচেয়ে বড় সংকেত। ইইউ মনে করে, এ সংকট সমাধান হতে হবে।’
স্প্যানিশ রাষ্ট্রদূত অবশ্য কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার বিপক্ষে স্পেনের পক্ষে এখনই বাংলাদেশের প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে সমর্থন চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, স্পেনের ভৌগোলিক অখণ্ডতার পক্ষে বাংলাদেশের অবস্থান আছে। সম্প্রতি স্পেনের জাতীয় দিবসে বাংলাদেশের সংস্কৃতিকমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এমন মন্তব্য করেছেন। ফলে বাংলাদেশ একটু সময় নিয়ে এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে বিবৃতি দিলেই হতো। কিন্তু কাতালোনিয়ার পার্লামেন্ট স্বাধীনতা ঘোষণার পর বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশের প্রকাশ্যে স্পেনের অখণ্ডতার পক্ষে বিবৃতি এখনই জরুরি হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের এমন প্রকাশ্য সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে রাষ্ট্রদূত ঢাকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন বলে জানান।
স্পেনের রাষ্ট্রদূত জানান, এখন পর্যন্ত ইউরোপীয় ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলো স্পেনের অখণ্ডতার পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান ঘোষণা করেছে। এশিয়ায় চীনের মুখপাত্র স্পেনের অখণ্ডতার পক্ষে বলেছেন। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে কাতারের প্রকাশ্য সমর্থন পেয়েছে স্পেন। তিনি অবশ্য জানান যে, কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বে একমাত্র ভেনিজুয়েলার সহানুভূতি রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। স্পেনের রাষ্ট্রদূত অবশ্য স্মরণ করিয়ে দেন যে, রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের পক্ষে স্পেন অনেক কাজ করেছে। আগামীতেও ইইউ, জাতিসংঘসহ অনেক স্থানে স্পেনের অনেক কাজ করার সুযোগ রয়েছে। তিনি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত করেন যে, কাতালোনিয়ার সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যু আদান-প্রদানমূলক নয় বটে। কিন্তু কাতালোনিয়া ইস্যুতে বাংলাদেশ স্পেনকে সমর্থন দিলে রোহিঙ্গা সংকটে মাদ্রিদের আরও সক্রিয় কাজ করার উৎসাহ সৃষ্টি হবে।jugantor.com