রাজনৈতিক দলের সংলাপ বিপরীত মেরুতে- দুই দল সমঝোতা না হলে সহিংসতার আশঙ্কা বিশ্লেষকদের

ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট:একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে রাজনৈতিক অঙ্গন। ইতিমধ্যে ‘নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা’ ইস্যুতে দুই মেরুতে অবস্থান নিয়েছে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এ ইস্যুতে দুই দলের মধ্যে সংলাপ বা সমঝোতার সম্ভাবনা দিন দিন ক্ষীণ হয়ে আসছে। চলছে কথার লড়াই। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ। সংলাপ ইস্যুতে বিএনপি অবস্থান ‘হ্যাঁ’ হলেও ক্ষমতাসীনদের অবস্থান পুরো উল্টো ‘না’। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সামনের দিনগুলোতে ফের রাজপথে সংঘাত ও সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, এবার নির্বাচন নিয়ে সমঝোতা না হলে ২০১৩ সালের চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
বিশ্লেষকদের অভিমত, দুই দলকে তাদের বিপরীতমুখী অবস্থান থেকে সরে আসতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। আগামী নির্বাচন নিয়ে দুই দল ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারলেই দেশে শান্তি আসবে। না হলে আবারও সৃষ্টি হবে অস্থিরতা।
জানা গেছে, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দশম সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের যে অবস্থান ছিল তাতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। গত নির্বাচনের মতোই আগামী নির্বাচনেও নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থায় সংবিধানে নির্ধারিত পদ্ধতি বহাল রাখতে দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে দলটি। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা ও সরকারের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে মন্ত্রিসভা রয়েছে সেই মন্ত্রিসভাই ছোট করে নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা গঠন করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন।
অন্যদিকে বিএনপি নেতাদের দাবি, নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি এখনও অমীমাংসিত। বিষয়টির সুরাহা না হওয়ায় রাজনীতিতে চাপা অস্থিরতা বিরাজ করছে। নির্বাচন নিয়ে জনমনে অনিশ্চয়তা আছে। এজন্য সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের উপায় বের করতে হবে। এজন্যই সরকারকে বারবার সংলাপে বসার তাগিদ দেয়া হচ্ছে।
এদিকে প্রধান নির্বাচন কমিশন স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছেন, নির্বাচনী ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সৃষ্ট রাজনৈতিক বিরোধ নিরসনে সমঝোতার কোনো উদ্যোগ নির্বাচন কমিশন নেবে না। ক্ষমতাসীন দলের নেতারাও একই সুরে কথা বলছেন। তারা জানান, এ দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের নয়। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যকার বিপরীতমুখী অবস্থানের সমাধান কী হবে এবং সমঝোতার দায়িত্বই বা কে নেবে- এ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের রাজনীতিটাই বিপরীতমুখী অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। বড় দুটি দল সব সময় উল্টো অবস্থানে থাকে। দেশ ও জনগণের চিন্তা তাদের মাথায় নেই। তারা দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পারছে না। ফলে বারবার দেশে সংঘাত-সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানেও দুই দলের মধ্যে বিপরীতমুখী অবস্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আগামী নির্বাচনেও এ ধারা অব্যাহত থাকলে আমাদের জন্য অনেক খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে বলে মনে হয়।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এজন্য রাজনৈতিক একটা সুষ্ঠু পরিবেশ প্রয়োজন। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পরিবেশ ভালো থাকায় ইসি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পেরেছে। কিন্তু বর্তমানে রাজনৈতিক পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে। দেশের সবচেয়ে পুরনো দল আওয়ামী লীগ এবং আরেক দল যাদের বয়স প্রায় চল্লিশ বছর- এ দুটি দল একই অবস্থানে আসতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচন হলে তা আরও সংঘাতময় হয়ে উঠবে। আগামীতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের অর্জনগুলো ম্লান হয়ে যেতে পারে।
সাখাওয়াত বলেন, এ মুহূর্তে আমরা আন্তর্জাতিক সংকটের মধ্যে আছি। বিপদ যেন আমাদের মাকড়সার জালের মতো আটকে ফেলেছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো নানা খেলায় মেতে উঠেছে। রোহিঙ্গারা দীর্ঘমেয়াদে আমাদের দেশে অবস্থান করলে একটা ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এ সংকট মোকাবেলায় আমাদের জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন। কিন্তু সেই ইস্যুতেও দুই দল বিপরীতমুখী অবস্থানে।
তিনি বলেন, এ পরিস্থিতি উত্তরণে দুই দলকেই আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। আলাপ-আলোচনা ছাড়া এ সংকট উত্তরণ সম্ভব নয়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান  বলেন, ‘সংলাপের সম্ভাবনা বাস্তবে খুবই ক্ষীণ। কারণ দৃশ্যত দু’পক্ষ এখনও অনড়। একদল হ্যাঁ বললেও প্রধান দল বলছে না। এ পরিস্থিতিতে কিভাবে সংলাপ হবে।
তিনি বলেন, বড় দুই রাজনৈতিক দলের এমন বিপরীতমুখী অবস্থান অব্যাহত থাকলে আবারও সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকেই দেশ এগিয়ে যাবে। তাই দেশের কল্যাণের কথা চিন্তা করে আশা করব দুই দলই সংলাপে বসবে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক সেমিনারে তিনি বলেছেন, বিএনপি সমঝোতার দরজা নিজেরাই বন্ধ করে দিয়েছে। তাদের সঙ্গে এখন সমঝোতা বা সংলাপের কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ফেনীর সাজানো হামলার ঘটনা সংঘাতের উসকানি। সংঘাতের উসকানি দিয়ে সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টি হবে না।
তিনি বলেন, আমরা চাই বিএনপি নির্বাচনে আসুক। ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার যে কথা বলা হয়, সেটার যাতে পুনরাবৃত্তি না হয় আমরা সেটাই চাই। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালনা করুক সেটা আমরা চাই। নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগ বা বিএনপির পক্ষপাতিত্ব করুক সেটা আমরা চাই না। আমরা চাই নিরপেক্ষ নির্বাচন।
তিনি বলেন, তারা কখনও বলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, কখনও বলে সহায়ক সরকার। আসলে বিএনপি কি চায়, সেটা এখনও পরিষ্কার নয়। তত্ত্বাবধায়ক বা সহায়ক সরকার এটা নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার নয়। কিন্তু তারা সেটি নির্বাচন কমিশনে নিয়ে গেছেন। বিএনপির উদ্দেশ্য একটা অবাধ, নিরপেক্ষ, ইনক্লুসিভ, পার্টিসেপটরি, ক্রেডিবল, অ্যাকসেপ্টেবল ইলেকশন নয়; তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় যাওয়া।
অন্যদিকে একই দিন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের মন্তব্যের জবাবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন- অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেতে পারবে না জেনেই আলোচনা-সমঝোতার সব প্রস্তাব এড়িয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘যতই বলুক, যাই বলুক সমঝোতায় তাদের আসতেই হবে। অন্যথায় প্রমাণিত হবে জাতির কাছে তাদের (আওয়ামী লীগ সরকার) কোনো দায়বদ্ধতা নেই।’ মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সব সময়েই বলে তারা সমঝোতা করবে না। মনে রাখতে হবে, তারা কিন্তু অতীতেও সমঝোতা চায়নি। তবে সমঝোতায় তাদের আসতে হয়েছিল। আমরা বিশ্বাস করি, আলোচনা-সমঝোতা ছাড়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না।’
মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা বারবার বলেছি আমরা সংঘাত চাই না। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে যেন জনগণের আশা পূরণ হয়, সে জন্য প্রয়োজন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।
এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে সরকারের উদ্দেশে বলেন- যদি সমঝোতায় না আসেন দেশের মাটিতে গণবিস্ফোরণ ঘটবে। কারণ দেশের মানুষের সহ্য সীমা এখন পেরিয়ে গেছে। মানুষের এখন অন্য কোনো পথ নেই। তিনি আরও বলেন, আমাদের নেত্রী যদি বাইরে বের হন তাহলে কী রকম জোয়ার উঠে আপনারা তখন টের পাবেন। তখন সংলাপ-সমঝোতা করতে আপনারা বাধ্য হবেন।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন  বলেন, রাজনীতিতে এ ধরনের বক্তব্য থাকবেই। তবে কোন দলের জনতার শক্তি কত বেশি তার ওপর নির্ভর করবে সবকিছু। এজন্য শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। দেখা যাক জনমত কার পক্ষে যায়।
সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার  বলেন, দুই দলের মধ্যে সমঝোতার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। সংলাপ ইস্যুতে এক দল হ্যাঁ এবং অপর দল না অবস্থানে আছে। এমন বিপরীতমুখী অবস্থানে কোনো কিছু আশা করা যায় না। তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতিতে তাদের যদি শুভবুদ্ধির উদয় না হয় তাহলে দেশে আবারও সংঘাত-সহিংসতা অনিবার্য।
দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সংলাপ কখনও সুখকর ছিল না। নানা উদ্যোগের পর শেষ পর্যন্ত দুই দল সংলাপে বসলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। ১৯৯৪ সালের ১৩ অক্টোবর কমনওয়েলথের ওই সময়ের মহাসচিবের বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান স্টিফেন ঢাকায় আসেন। এরপর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক করেন তিনি। সেটাই ছিল দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আনুষ্ঠানিক প্রধান সংলাপ। তখনও নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে মখোমুখি অবস্থানে ছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। কিন্তু কমনওয়েলথ মহাসচিবের দূত স্যার নিনিয়ান দুই প্রধান দলকে মানাতে ব্যর্থ হলে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আবির্ভাব ঘটে। এরপর ২০০৬ সালের ৫ অক্টোবর নির্বাচনের আগে মুখোমুখি অবস্থানে থাকা দুই দল সংলাপে বসে। তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের সঙ্গে একাধিকবার সংলাপে বসেছিলেন ওই সময়ের ক্ষমতাসীন বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই সংলাপে আসেনি কোনো ইতিবাচক ফল। এছাড়া দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আবারও দুই দল মুখোমুখি অবস্থান নেয়। দুই দলের বিপরীতমুখী অবস্থান থেকে এক টেবিলে বসাতে সংলাপের তাগিদ আসে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের তরফ থেকে। দুই নেত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে সরাসরি কথা বলেন তিনি। জাতিসংঘের রাজনীতিবিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো ২০১৩ সালের ৬ ডিসেম্বর ৫ দিনের সফরে ঢাকায় আসেন। তিনি দুই দলের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত কোনো ফয়সালা দিতে পারেননি। তারানকোর উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতারা সংলাপে অংশ নিলেও শেষ পর্যন্ত তা ফলপ্রসূ হয়নি। যুগান্তর

Check Also

শেখ হাসিনার ভাইরাল অডিওর নির্দেশনা বাস্তবায়ন, গ্রেপ্তার ১০

শেখ হাসিনার ভাইরাল হওয়া অডিও ক্লিপের নির্দেশনা বাস্তবায়নকারী দশজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। শনিবার (৯ নভেম্বর) …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।