স্টাফ রিপোর্টার : রাখাইন সংকট নিরসনে মিয়ানমারের জাতিগত নিধন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ প্রত্যাবাসনকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ সফররত মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের জনসংখ্যা, শরণার্থী ও অভিবাসনবিষয়ক ভারপ্রাপ্ত সহকারী মন্ত্রী মি. সাইমন হেনশ বলেছেন, মিয়ানমারকে অবশ্যই রোহিঙ্গাদের নিরাপদে তাদের বাড়িঘরে ফিরিয়ে নিতে হবে। এটাই সংকটের সর্বোত্তম সমাধান। এ ব্যাপারে নেপিদোর ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। মিয়ানমার এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিচ্ছে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গতকাল শনিবার সকালে গুলশানে আমেরিকান ক্লাবে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। চার সদস্যের প্রতিনিধি দল নিয়ে বৃহস্পতি ও শুক্রবার কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের দেখে এসে ঢাকায় সাংবাদিক সম্মেলন করেন মি. হেনশ। সাংবাদিক সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র মিজ হেদার নোয়ার্ট, ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত মিজ মার্শিয়া বার্নিকাট প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
সাইমন হেনশ বলেন, রাখাইনের এই সমস্যা একটি জটিল ও মারাত্মক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। দুই মাসে ছয় লাখ মানুষ বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন। বাংলাদেশ এই মানুষগুলোকে আশ্রয় দিয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনের নির্দেশনা অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি দেখতে আমরা এখানে এসেছি। সামগ্রিকভাবে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে পর্যালোচনা করছে যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের এ ভারপ্রাপ্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারে রাজনৈতিক সমঝোতা দরকার। তাদেরই দায়িত্ব নিতে হবে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার। এই ক্ষেত্র তৈরি করতে যা করা দরকার, তাদেরই করতে হবে। এছাড়া রাখাইনে যে নৃশংসতার খবর মিলেছে, তার তদন্ত করতে হবে এবং যারা এ নৃশংসতায় জড়িত তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
তিনি বলেন, বিপুলসংখ্যক মানুষের একসঙ্গে পালিয়ে আসা নিঃসন্দেহে একটি গুরুতর বিষয়। বিষয়টি নিয়ে আমরা একাধিক বার মিয়ানমারের সঙ্গে কথা বলেছি। সেখানে নিরাপত্তার বিষয়টি উঠে এসেছে। ঢাকায় আমরা বাংলাদেশ সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গেও এ ব্যাপারে আলোচনা করেছি। শরণার্থী শিবিরগুলোর পরিস্থিতি নিয়ে তাদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। সেখানকার পরিস্থিতি বেদনাদায়ক। ছয় লাখ মানুষ ভয়ানক পরিস্থিতিতে রয়েছেন। মিয়ানমারকে অবশ্যই নিরাপদ ও স্থিতিশীল পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে; যাতে রোহিঙ্গারা তাদের বাড়িঘরে ফিরে যেতে পারে।
সাইমন হেনশ বলেন, বহু শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে। কিন্তু এখানকার পরিস্থিতি ভয়াবহ। শরণার্থীদের খাবার ও আশ্রয়ের সমস্যা রয়েছে। তবে রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ যেভাবে এগিয়ে এসেছে তা অভূতপূর্ব। সেখানে অনেক সংস্থা শরণার্থীদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু এতো বিপুলসংখ্যক মানুষকে আমরা বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছি না। এই জটিল পরিস্থিতিতে আমাদের আরো কাজ করে যেতে হবে।
গত সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে ৭২তম জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা হিসেবে ২৬২ কোটি ৩০ লাখ টাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র। গতকালের সাংবাদিক সম্মেলনেও এর পুনরাবৃত্তি করেন সাইমন হেনশ। তিনি বলেন, অন্যান্য দেশও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এই সংকট উত্তরণে আমাদের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।
সাংবাদিক সম্মেলনে হেনশের বক্তব্যের আগে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র মিজ হিদার বলেন, রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে হোয়াইট হাউজ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। ওয়াশিংটনের আলোচনার মধ্যে এই বিষয়টি ওপরের দিকে রয়েছে।
এর আগে গত শুক্রবার দুপুরে তিনি কক্সাজারের উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি ক্যাম্পের সার্বিক পরিস্থিতি দেখেন এবং রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেন। তার সঙ্গে থাকা প্রতিনিধি দলে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও শ্রম ব্যুরোর ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি স্কট বাসবি, দক্ষিণ ও কেন্দ্রীয় এশিয়া বিষয়ক ব্যুরোর ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি টম ভাজদা, পূর্ব-এশিয়া ও প্যাসিফিক বিষয়ক ব্যুরোর অফিস ডিরেক্টর প্যাট্রিসিয়া মাহোনি।
বাংলাদেশ সফর শেষে মার্কিন প্রতিনিধিদলটি একইভাবে মিয়ানমার সফর করবে। দেশটির কর্তৃপক্ষের কাছে তারা রাখাইনে শর্তহীনভাবে ত্রাণ সংস্থা ও সংবাদকর্মীদের প্রবেশের অনুমতি চাইবে। এছাড়া মগসেনা ও উগ্র বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের দমন-পীড়নে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের সসম্মানে ও নিরাপদে রাখাইনে প্রত্যাবাসন-প্রক্রিয়া নিয়ে মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলবেন তারা।
উল্লেখ্য, ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অভিযানের মুখে এখন পর্যন্ত ৬ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে রাখাইন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এই অভিযানকে ‘জাতিগত নিধনকান্ড’ আখ্যা দিয়েছে জাতিসংঘ। ইইউ ও বৃটেন ইতিমধ্যে মিয়ানমারের ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও এ বিষয়ে চাপ দিয়ে আসছে মিয়ানমারের ওপর। রোহিঙ্গা সংকট তৈরির দায়ে সম্প্রতি মার্কিন আইনপ্রণেতারা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপেরও দাবি তোলেন।