ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট:আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পাবনা-২ (সুজানগর উপজেলা এবং বেড়া উপজেলার আংশিক) আসনে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের এক ডজনের বেশি প্রার্থী মনোনয়ন পেতে ইতোমধ্যে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ চায় আগামী নির্বাচনে জয়ের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে আর বিএনপি চায় আসন পুনরুদ্ধার। মনোনয়নপ্রত্যাশীরা দলীয় নেতাকর্মী সমর্থকদের কাছে টানা এবং নিজের পক্ষে সমর্থন আদায়ে এখন থেকেই নানা কৌশলে কাজ করে যাচ্ছেন।
তবে এবারের নির্বাচনে দুই দলের কর্মী-সমর্থকেরা চান এলাকার তৃণমূল নেতাকর্মীদের সাথে যাদের সম্পর্ক ভালো, দলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাদের উপস্থিতি বেশি, তারাই যেন এবারের নির্বাচনে মনোনয়ন পান। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে ছবিসংবলিত পোস্টার ছাপিয়ে জানান দিচ্ছেন নিজেদের প্রার্থিতার কথা। এ আসনে মূলত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে লড়াই হয়। এবারো তাই হবে। বিএনপির প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে তেমন কোনো ঝামেলা নেই। তবে আওয়ামী লীগে প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে এখনই তোলপাড় শুরু হয়েছে। কে হবেন নৌকার কাণ্ডারি তা নিয়ে শুধু ভোটার নয়, রাজনৈতিক মহলেও ঝড় বইছে। আগামী নির্বাচনে নতুন মুখ এগিয়ে আসছে, তাই আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। প্রার্থী বাছাইয়ের ওপর নির্ভর করবে আসনটি আওয়ামী লীগের হাতে থাকবে নাকি বিএনপির দখলে চলে যাবে। এ নিয়ে হিসাব-নিকাশ চলছে দুই দলে। সবখানে আলোচনা এখন একটাইÑ কে পাবেন পাবনা-২ আসনে (সুজানগর-বেড়া আংশিক) আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মনোনয়ন।
পাবনা-২ আসনটি সুজানগর উপজেলার ১০টি এবং বেড়া উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। দেশ স্বাধীনের পর থেকে চলতি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত আসনটি থেকে পাঁচবার আওয়ামী লীগ, চারবার বিএনপি এবং একবার জাতীয় পার্টির প্রার্থী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তবে বিগত নির্বাচনের ফলাফল তথা নির্বাচনী মাঠের বাস্তব অবস্থা অনুযায়ী মূলত আসনটিতে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির শক্ত অবস্থান রয়েছে। সে কারণে এলাকার সচেতন মহল মনে করছেন আসন্ন নির্বাচনে আসনটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দলীয় প্রার্থীর মধ্যে। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের ৯ জন মনোনয়নপ্রত্যাশী মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন।
পাবনা-২ আসনে ১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আহমেদ তফিজ উদ্দিন মাস্টার নির্বাচিত হন। এরপর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি দলীয় প্রার্থী মির্জা আবদুর রশিদ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মির্জা আবদুর রশিদ সংসদ সদস্য থাকাকালে ১৯৮২ সালে আবার রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়। ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মকবুল হোসেন সন্টু সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। জাতীয় পার্টি দীর্ঘ ৯ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপির হ্যাভিওয়েট প্রার্থী ওসমান গনি খান (ওজি খান) সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৯৬ সালে দুই দফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম দফা ১৫ ফেব্রুয়ারি এবং দ্বিতীয় দফা ১২ জুন। প্রথম দফা অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী এ কে এম সেলিম রেজা হাবিব এবং দ্বিতীয় দফা অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আহমেদ তফিজ উদ্দিন মাস্টার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে তফিজ উদ্দিন মাস্টার নির্বাচিত হওয়ার দুই বছর পর মারা গেলে ১৯৯৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব:) এ কে খন্দকার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী এ কে এম সেলিম রেজা হাবিব সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে এয়ার ভাইস মার্শাল (অব:) এ কে খন্দকার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপি বর্জন করলে আওয়ামী লীগ প্রার্থী খন্দকার আজিজুল হক আরজু বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বিগত নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী আসনটিতে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির শক্ত অবস্থান রয়েছে। সে কারণে আসন্ন সংসদ নির্বাচনে উভয় দল আসনটি দখলে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই বিএনপি এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন, হামলা-মামলা শুরু হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এর মাত্রা বহুগুণ বেড়ে গেছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা বিরোধী দলের সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি হাতে নিলেই হুমকি-ধমকি দিয়ে অথবা মামলার ভয় দেখিয়ে বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। মিথ্যা মামলায় দল দু’টির হাজার হাজার নেতাকর্মী গত ৯ বছর ধরে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তবুও দু’টি রাজনৈতিক দলের নেতারা বিভিন্ন মাধ্যমে দলের কর্মী-সমর্থক ও ভোটারদের সাথে নিবিড়ভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। মিথ্যা মামলায় জর্জরিত দল দু’টির নেতাকর্মীদের প্রতি এলাকার সাধারণ মানুষের সহানুভূতি ও সমর্থন বেড়েছে। ক্ষমতাসীন দলের প্রতি সাধারণ মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলেছে।
আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে যারা নির্বাচনী মাঠে গণসংযোগ ও প্রচারণা চালাচ্ছেন তারা হলেনÑ পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সুজানগর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আহমেদ ফিরোজ কবির, প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মির্জা জলিল, বর্তমান এমপি খন্দকার আজিজুল হক আরজু, রাকসুর সাবেক জিএস খোন্দকার জাহাঙ্গীর কবির রানা, ট্যারিফ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মজিবুর রহমান, আবদুল আজিজ খান, ডা: কে এম শফিউল আলম বাদশা, বেড়া উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদের এবং সাবেক ছাত্রনেতা আবদুল মতিন। অপর দিকে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে যারা নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর পাশাপাশি দলের হাইকমান্ডের সাথে লবিং করছেন তারা হলেনÑ সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপি কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এ কে এম সেলিম রেজা হাবিব, পাবনা জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক শিল্পপতি আবদুল হালিম সাজ্জাদ, বিএনপি কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য কৃষিবিদ হাসান জাফির তুহিন ও অ্যাডভোকেট আরশেদ আলম। এ ছাড়া জেলা জাতীয় পার্টি সভাপতি মকবুল হোসেন সন্টু মনোনয়ন চাইতে পারেন।
বর্তমান সংসদ সদস্য খন্দকার আজিজুল হক আরজু নির্বাচনী এলাকায় অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। তবে বিভিন্ন ইস্যুতে সুজানগরের স্থানীয় নেতাকর্মীদের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ায় অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। তিনি সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নির্বাচনী এলাকায় গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে নৌকা প্রতীকে ভোট চাচ্ছেন। সুজানগর উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের একটাই দাবি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বেড়া উপজেলা থেকে নয়, সুজানগর উপজেলা থেকেই যেন প্রার্থী মনোনয়ন দেয়া হয়। সুজানগর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আহমেদ ফিরোজ কবির, ড. মির্জা জলিল, খোন্দকার জাহাঙ্গীর কবির রানা, ড. মজিবুর রহমান, আবদুল আজিজ খান, ডা: কে এম শফিউল আলম বাদশা, আবদুল কাদের এবং আবদুল মতিন নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা এবং গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। কর্মী-সমর্থকদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন।
এ দিকে জামায়াতে ইসলামীর কর্মী-সমর্থকেরাও বসে নেই। তারা আগামী নির্বাচন সামনে রেখে দলকে সংগঠিত করতে নীরবে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। সাবেক সংসদ সদস্য এ কে এম সেলিম রেজা হাবিব, আবদুল হালিম সাজ্জাদ, হাসান জাফির তুহিন ও অ্যাডভোকেট আরশেদ আলম একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিভিন্ন মাধ্যমে এলাকায় গণসংযোগ ও প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ আসনে দুইবার নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য এ কে এম সেলিম রেজা হাবিব এলাকায় বহু উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। বিপদে-আপদে স্থানীয় নেতাকর্মীদের পাশে থেকে সাহায্য করছেন। ফলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনিই দলের মনোনয়ন পাবেন বলে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীরা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
যদি জোটগতভাবে নির্বাচন হয়, তা হলে ২০ দলীয় জোটের প্রধান দল বিএনপির জন্য পাবনা-২ আসনটি নির্ধারিত হয়ে আছে। দলগত অবস্থান আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রায় সমান সমান। জনসমর্থন এবং ভোটের হিসাবে জামায়াতে ইসলামী তৃতীয় অবস্থানে আছে। রাজনীতির মাঠে জাতীয় পার্টির জনসমর্থন তেমন নেই বললেই চলে। জোটের রাজনীতিতে পাবনা-২ (সুজানগর উপজেলা এবং বেড়া উপজেলার আংশিক) আসনে ২০ দলীয় জোটের অবস্থান অত্যন্ত মজবুত। তবে এলাকার সচেতন ভোটারদের অভিমত, এ আসনে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি প্রার্থীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। তবে দল বা জোটের প্রার্থী বাছাইয়ের ওপর ভোটের হিসাব-নিকাশ, জয়-পরাজয় অনেকটাই নির্ভর করবে।
Check Also
কুমিল্লা ও ফরিদপুরকে বিভাগ করার সুপারিশ দেবে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন
কুমিল্লা ও ফরিদপুরকে বিভাগ করার সুপারিশ করতে যাচ্ছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) সচিবালয় …