বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রথম থেকেই মানুষ হত্যা, বিরোধীদলীয় লোকজন হত্যা, নিজেদের দলীয় লোকদের হত্যার সঙ্গে কিছুদিন থেকে যুক্ত হয়েছে পারিবারিক হত্যা। বাংলাদেশের সমাজের কতখানি অপরাধীকীকরণ বা ক্রিমিনালাইজেশন হয়েছে, এসব হত্যাকাণ্ডকে বলা যায় তার এক ব্যারোমিটার। কিন্তু এখানে আরও বলা দরকার, এ অপরাধীকীকরণ শুধু হত্যাকাণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই।
একেবারে প্রথম থেকেই লুটপাট, ঘুষ, দুর্নীতি, চুরি বাংলাদেশে ধনসম্পদ অর্জন ও সম্পত্তি করার উপায় হিসেবে প্রচলিত রয়েছে। বর্তমানে আমরা দেশজুড়ে যেভাবে নানা ধরনের বিচিত্র অপরাধ ঘটতে দেখছি তার ভিত্তি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্যায়েই রচিত হয়েছিল।
এটা কোনো নতুন কথা নয়। এ কারণে দেখা যাবে বাংলাদেশে এ মুহূর্তে যত অপরাধ ঘটছে তার মধ্যে এমন কোনো অপরাধ নেই যা ১৯৭২ সালের পর থেকেই আগের যে কোনো সময়ের থেকে বেশি মাত্রায় দেখা যায়নি। অর্থাৎ ১৯৭২ সাল থেকে অপরাধীকীকরণ নতুনভাবে এদেশে সৃষ্টি হয়ে এখন তা এক মারাত্মক বিপজ্জনক বিন্দুতে এসে দাঁড়িয়েছে।
যে কোনো দেশে অপরাধ যখন পারিবারিক পর্যায়ে নিয়মিতভাবে, ব্যাপকভাবে ও নিষ্ঠুরভাবে ঘটতে থাকে তখন বুঝতে হবে, সেই সমাজ এমন এক সংকটের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছে যা ক্ষমতাসীনদের দ্বারাই অবশ্যম্ভাবীরূপে সৃষ্টি হয়েছে।
কারণ যারা ক্ষমতায় থাকে, দেশের শাসন পরিচালনা করে, তারা নিজেরা যদি সৎ জীবনযাপন করে, চুরি-দুর্নীতি-ঘুষ ইত্যাদি থেকে বিরত থাকে, নিজেরা অপরাধী না হয় এবং অপরাধীর বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করে, তাহলে সে সমাজে অপরাধের বিস্তার, বৈচিত্র্য ও নিষ্ঠুরতা বৃদ্ধি না পেয়ে মানুষের জীবন স্বাভাবিক থাকে।
তাই সমাজে যদি মানুষের জীবনের অবস্থা এর বিপরীত দাঁড়ায়, যেমন দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশে, তাহলে তার থেকে এ বিষয়টিই স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, সমাজের ওপর তলার অর্থাৎ শাসক শ্রেণীর ও তাদের সরকারের লোকরাই সমাজে অপরাধের বিস্তার ঘটানোর নিয়ামক শক্তি।
বাংলাদেশে সাংবাদিক হত্যা, ক্রসফায়ারে হত্যা, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী হত্যা, খুন ও গুপ্তহত্যা হল নিয়মিত ব্যাপার। এসব হত্যার কোনো বিচার ও শাস্তির প্রয়োজন আছে বলে ক্ষমতাসীনরা মনে করে না।
ক্ষেত্রবিশেষে কোনো মামলা হলে তার তদন্ত শেষ করতে পুলিশ সময় নেয় চার-পাঁচ বছর বা তারও বেশি। অথচ অনেক নিরপরাধ ব্যক্তির বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করে তাদের হয়রানি করা হয়, এমনকি তাদের শাস্তি পর্যন্ত হয়ে যায়। বিপরীতে সরকারি লোক অথবা তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত লোকরা হাজার রকম অপরাধ করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয় না।
তাদের বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা হয় না। দেশে বর্তমানে দুর্নীতি, ধর্ষণ, হত্যাকাণ্ড যে হয়েই চলেছে, তার সঙ্গে অপরাধের প্রতি সরকারের এ দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতি অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত। সরকারের কাজ তাদের অধীনস্থ বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে অপরাধ দমন করা, অপরাধীদের বিচার করা ও শাস্তি দেয়া।
কিন্তু তার পরিবর্তে তারা নিজেরাই যদি বড় ধরনের এবং বিচারবহির্ভূতভাবে অপরাধ করে চলে তাহলে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অপরাধের বিস্তার এক স্বাভাবিক ব্যাপার হবে বৈকি। বাংলাদেশে এখন এ ‘স্বাভাবিক’ ব্যাপারটিই ঘটছে।
গুরুতর ও ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড এখন বাংলাদেশে পারিবারিক বৃত্তের মধ্যেই ঘটছে। পিতা হত্যা করছে স্ত্রী ও সন্তান, মাতা হত্যা করছে স্বামী ও সন্তান, সন্তান হত্যা করছে পিতা-মাতা। এসব ঘটনার বিবরণ এখন প্রায় প্রতিদিনের সংবাদপত্রেই দেখা যায়। এটা ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে শোনাই যেত না।
শুনলেও তা ছিল ব্যতিক্রমী ও কদাচিৎ ঘটনা। এমনকি বাংলাদেশে সত্তর ও আশির দশকেও এসব ক্ষেত্রে অবস্থার অবনতি ঘটলেও এখন যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তার তুলনায় তা অনেক ভালো ছিল। কিন্তু এখন বাংলাদেশে পিতামাতা ও সন্তানের মতো নিকটতম আত্মীয়, ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব, দলীয় লোক কাউকেই আর আপন মনে করা হয় না।
কোনো ক্ষেত্রই অপরাধের বাইরে নেই। অপরাধ এখন পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশে।
ধর্ষণের ঘটনা এখন নিয়মিত ঘটছে। স্কুলের ছাত্রীদের পেছন নেয়া, তাদের বিবাহের কথা বলে ধর্ষণ করা, জোর করে ধরে নিয়ে ধর্ষণ করা, পার্টিতে আমন্ত্রণ করে ধর্ষণ করার ঘটনা তো আছেই। এছাড়া অন্য লোকেরাও ব্যাপকভাবে ধর্ষণ করছে। এমনকি শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীদের ধর্ষণ অথবা ধর্ষণের চেষ্টা, অফিসের সহকর্মীদের হয়রানি ও ধর্ষণের চেষ্টা করার ঘটনাও ঘটছে। পারিবারিক বৃত্তের মধ্যেও ধর্ষণ কাণ্ড হচ্ছে।
অর্থাৎ ধর্ষণ এখন বিচিত্র ও ব্যাপকভাবে হচ্ছে। যা আগের যে কোনো সময়ে ছিল কল্পনার অতীত। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে ধর্ষণ এখন পরিণত হয়েছে সব রকম অপরাধের তালিকার খুব উপরের দিকে। বাংলাদেশের অনেক নারী এখন নানা বাধাবিপত্তি উত্তীর্ণ হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছেন এবং সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করছেন। এভাবে ধর্ষণের ব্যাপকতা ও মাত্রা যে নারীর এ অগ্রগতি বাংলাদেশে ম্লান করে দিচ্ছে এতে সন্দেহ নেই।
দেশে সুষ্ঠুভাবে ও সুশৃঙ্খলভাবে সমাজব্যবস্থা পরিচালনা করা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতদেরই দায়িত্ব। এ কারণে সমাজে যেসব সমস্যা ও সংকট দেখা দেয় তার মোকাবেলা করাও শাসকদের কাজ।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় জনগণ আশা করেছিলেন, পাকিস্তানি শাসনের শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্ত হয়ে তারা এমন এক স্বাধীন দেশের অধিবাসী হবেন যেখানে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত হবে, জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা থাকবে, কাজ এবং খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, স্বাস্থ্য ইত্যাদির সংস্থান হবে।
কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে অল্প দিনের মধ্যে জনগণ উপলব্ধি করলেন, দেশের নতুন শাসক শ্রেণীর অধীনে তাদের সে আশা পূরণ হওয়ার নয়। উপরন্তু ভয়াবহভাবে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।
বাংলাদেশের জনগণের এমনই দুর্ভাগ্য, তারা স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকশ্রেণী ও তাদের সরকারের দ্বারা প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত পরাধীনতার অবস্থা থেকে মুক্ত হননি।
উপরন্তু পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতিই ঘটে চলেছে। অথচ যে ক্ষমতাসীনরা এর জন্য দায়ী, তাদের এ দায়িত্ব স্বীকারের মতো নৈতিক চরিত্র নেই। নিজেদের কোনো দোষত্রুটি স্বীকারের কথা তাদের মুখ থেকে কেউ শোনে না।
সমাজে যত খারাপ কিছুই ঘটুক, তার দায়িত্ব নিজেরা স্বীকার না করে অন্যদের ঘাড়ে এসবের দায়িত্ব তারা চাপিয়ে দেয়, তাদের দায়ী করে, যার কোনো ভিত্তি নেই, কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু যেহেতু তারা ক্ষমতাসীন, এজন্য তাদের কথার ‘গুরুত্ব’ ও ‘দাম’ আছে।
এ পরিস্থিতিতে দেশে অপরাধের জগৎ যে শক্তিশালী হবে, অপরাধের মাত্রা ও ব্যাপকতা যে বৃদ্ধি পাবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন ছাড়া এ অবস্থার পরিবর্তন যে সম্ভব নয়, এটা মস্ত বোকার পক্ষেও বোঝা নিতান্তই সহজ ব্যাপার।
০৪.১১.২০১৭
বরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল