দেশে সাড়ে ৩ বছরে অপরহণ-নিখোঁজ ২৮৪: ডিডব্লিউ

ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট: দেশে সাড়ে ৩ বছরে অপরহণ-নিখোঁজের শিকার হয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি পেশার ২৮৪ জন ব্যক্তি। যার সর্বশেষ শিকার নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোশিওলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুবাশ্বার হাসান সিজার।
মঙ্গলবার বিকেল থেকে তিনি নিখোঁজ৷ তার বাবা মোতাহার হোসেন বুধবার সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘‘দক্ষিণ বনশ্রীর বাসা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৭টায় আমার ছেলে বের হয়৷ বিকাল ৩টায় তার মোবাইলে ফোন দেই৷ তখন সিজার কল রিসিভ করেনি৷ ঘণ্টাখানেক পর বিকাল ৪টার দিকে সে ফোন করে বলে, জাতিসংঘের একটি বৈঠকে যাচ্ছে, রাতে ফিরবে৷ রাত ৯টা বেজে যাওয়ার পরও ছেলে বাসায় না ফিরলে ফোন দেই৷ কিন্তু তখন থেকেই তার মোবাইল বন্ধ পাই৷”
এরপর ছেলের নিখোঁজের বিষয়টি জানিয়ে খিলগাঁও থানায় একটি জিডি করেন তিনি৷ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সিজারের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি৷

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান ডয়চে ভেলেকে (ডিডব্লিউ) বলেন, ‘‘আমরা তার সন্ধান পেতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছি৷”

সিজার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে কিছুদিন সাংবাদিকতা করেন৷ পরে যুক্তরাজ্যে মাস্টার্স ও অস্ট্রেলিয়ায় পিএইচডি করেন৷ দেশে ফিরে এসে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দেন৷

তিনি বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন৷ বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মীয় সম্পৃক্ততাও গবেষণার বিষয় ছিল তার৷ এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ‘অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন’ প্রকল্পের সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন৷

তার এক বন্ধু ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘সিজারের এ সব কাজ ছিল পুরোপুরি গবেষণাধর্মী৷ এই গবেষণার মধ্যে জঙ্গি দমন বা এ জাতীয় কিছু ছিল না৷ তবে সে সম্প্রতি তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল৷ আর এ কারণেই সম্প্রতি সে তার বাসায় ‘সিসি ক্যামেরা’ লাগিয়েছিল৷”
যদিও পুলিশ কর্মকর্তা মাসুদুর রহমান বলেন, “সিজার তার নিরপত্তাহীনতার কথা জানিয়ে থানায় কখনও কোনো তথ্য দিয়েছে- বলে আমাদের জানা নাই৷”

জার্মান ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডিডব্লিউ এক প্রতিবেদনে বলছে, সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ফরহাদ মজহারের পর গত আড়াই মাসে ৯টি নিখোঁজের ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে৷ ফরহাদ মজহার অবশ্য নিখোঁজ হওয়ার ১৬ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকার বাইরে খুলনা থেকে উদ্ধার হন৷ তবে তিনি উদ্ধার হওয়ার পর সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে এখনও পর্যন্ত কোনো কথা বলেননি৷ শুধু পুলিশ এবং আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন৷

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত, সাড়ে তিন বছরে বাংলাদেশে নিখোঁজ বা অপহরণের শিকার হয়েছেন ২৮৪ জন৷ তাদের মধ্যে লাশ উদ্ধার হয় ৪৪ জন ব্যক্তির৷ নিখোঁজের পর গ্রেপ্তার দেখানো হয় ৩৬ জনকে এবং পরিবারের কাছে বিভিন্নভাবে ফিরে আসেন ২৭ জন৷ তবে এখনও ১৭৭ জনের কী অবস্থা তা জানা যাচ্ছে না৷ তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা পরিবার বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ বলতে পারছেন না৷

আসক-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, এর মধ্যে অনেককেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে৷ এমনকি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাকেও অপহরণের অভিযোগ আছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে৷ তাছাড়া প্রতিটি অপহরণ ও নিখোঁজের ঘটনার পর পরিবারের পক্ষ থেকে সহায়তার জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে যাওয়া হলে, তারা তাদের কোনো উত্তর দিতে পারেনি৷

গত বছরের ১৬ মার্চ অপহৃত হন তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা৷ হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির যে ঘটনা ঘটেছিল। তার নানা দিক নিয়ে গণমাধ্যমে নিজ পরিচয়ে মতামত দেয়ার পর তাকে মানিক মিয়া এভিনিউ এলাকা থেকে তুলে নেয়া হয়৷ সাতদিন পর অবশ্য এয়ারপোর্ট রোড এলাকায় পাওয়া যায় তাকে৷ গত ১৯ জুলাই ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেন তিনি৷ সে সময় জোহা জানান, ‘‘আমাকে আটকের পর মাইক্রোবাসে তুলে চোখ বেঁধে ফেলা হয়৷ এরপর আমাকে কোথায় নেয়া হয়েছে, কোথায় রাখা হয়েছে, তার কিছুই আমি বুঝতে পারিনি৷ আমাকে কতদিন আটক রাখা হয়েছিল, তাও আমি বুঝতে পারিনি৷ উদ্ধার হওয়ার পর পরিবারের কাছ থেকে জানতে পেরেছি৷”

তিনি আরো বলেন, ‘‘তবে প্রথমেই যে আমাকে ইনজেকশন ‘পুশ’ করা হয়েছিল, তা আমি বুঝতে পারি৷ যারা আমাকে মাইক্রোবাসে তুলেছিল তাদের কাউকেই আমি চিনতে পারিনি৷ আমি শুরুতে তাদের পরিচয় জানতে চেয়েছিলাম৷ কিন্তু তারা কোনো জবাব দেয়নি৷”

গার্মেন্ট ব্যবসায়ী ও পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওনা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিক ফিরে আসার পরও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি৷ পুলিশও এটা নিয়ে কোনো তদন্ত করেনি৷
লক্ষ্মীপুরের চিকিৎসক মুহাম্মদ ইকবাল মাহমুদ গত ১৫ অক্টোবর রাতে ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড় থেকে অপহৃত হন৷ ঘটনার সাড়ে সাত মাস পর, এ বছরের ১ জুন চোখ বাঁধা অবস্থায় লক্ষ্মীপুরে তাকে ফেলে যায় অপহরণকারীরা৷
ইকবালের বাবা নুরুল আলম জানান, ‘‘আমার ছেলে কোনোকিছুই বলতে পারে না৷ ঘটনার পর আমরা দৌড়াদৌড়ি করেছি৷ সবার সহযোগীতায় তাকে ফিরে পেয়েছি৷ ইকবাল এখন মোটামুটি ভালো আছে, চলাফেরা করছে৷”

আসক-এর সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান নিখোঁজ এবং অপহৃতদের নিয়ে কাজ করছেন বেশ কয়েক বছর ধরে৷
তিনি ডয়চে ভেলেকে জানান, “যারা নিখোঁজ বা অপহৃত হন, তাদের পরিবার এবং যারা ফিরে আসেন, তাদের কাছ থেকে আমরা কিছু তথ্য পাই৷ অপহরণের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রশিক্ষিত এবং সুশৃঙ্খল ব্যক্তিরা অপহরণের সঙ্গে জড়িত৷ যারা ফিরে আসেন, তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় যে, তাদের অত্যন্ত সুরক্ষিত জায়গায় রাখা হয়েছিল৷ যারা পহারায় থাকে তারাও নাকি সুশৃঙ্খল৷”

নূর খান বলেন, “বাংলাদেশ এত ঘনবসতিপূর্ণ জায়গা যে এখানে সাধারণ অপহরণকারীরা কাউকে অপহরণ করে বেশিদিন রাখতে পারে না৷”
তিনি জানান, “অপহরণ বা নিখোঁজের পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তেমন কোনো তৎপরতাও দেখা যায় না৷ এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিযোগও নিতে চায় না৷”
আরেক প্রশ্নের জবাবে নূর খান বলেন, “নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ড. মুবাশ্বার হাসান সিজারের নিখোঁজের ঘটনাটি নিয়ে এখনও সুনির্দিষ্ট মন্তব্য করার সময় আসেনি৷ তবে তিনি জঙ্গি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে গবেষণা করতেন৷ নিজেও নিজের নিরপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন৷ এর থেকে ধারণা করা যায় যে, ওই গবেষণা সংক্রান্ত বিষয় তার নিখোঁজ হওয়ার পেছনে কাজ করে থাকতে পারে৷ কিন্তু এটা একটা ধারণা মাত্র৷ বাস্তবতা ভিন্নও হতে পারে৷”

উপ-কশিনার মাসুদুর রহমান বলেন, “আমরা নানাভাবে তাকে উদ্ধারে কাজ করছি৷ গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে একাধিক ‘টিম’ কাজ করছে৷ নিখোঁজ হওয়ার সম্ভাব্য কারণগুলোও খতিয়ে দেখছি আমরা৷”

নিখোঁজ বা অপহরণের পর পুলিশের কোনো তৎপরতা থাকে না – এমন অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, “এ ধরনের ঢালাও অভিযোগ মেনে নেয়া যায় না৷ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করলে আমরা তা দেখতে পারি৷”

এদিকে বৃহস্পতিবার সিজারের বাবা ও তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি৷ তবে এ দিন দুপুরের পর তারা সিজারের ব্যাপারে তথ্য জানতে এবং জানাতে গোয়েন্দা দপ্তরে যান বলে খবর পাওয়া গেছে৷

 

Check Also

৩০ জুলাই পর্যন্ত অনেক দল সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি, সংগ্রামে যুক্ত হবে কি না: সারজিস আলম

জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম বলেছেন, …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।