ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট:আমি অসুস্থ নই, আবার ফিরে আসবো অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগে লিখিত বলেছিলেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহা। শেষ পর্যন্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে আর ফেরা হলো না। অস্ট্রেলিয়া থেকে সিঙ্গাপুরে এসে সেখানেই বাংলাদেশ হাইকমিশনে ইস্তফাপত্র দিয়ে প্রধান বিচারপতির পদ ছাড়লেন এস কে সিনহা। পদত্যাগের এই ঘটনা বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে নজীরবিহীন। কোনো প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের ঘটনা এই প্রথম। স্বৈরাচার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের সময়েও কোনো প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগ করতে হয়নি। গতকাল শনিবার সকালে পদত্যাগপত্রটি বঙ্গভবনে পৌঁছে। এখন নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিবেন।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায় আপিলে বহালের পর প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ওপর চাপ বাড়তে থাকে। আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা গত ২৮ সেপ্টেম্বর তাকে পদত্যাগের সময় বেঁধে দিয়েছিল। এরপর এক মাসের ছুটি নেন প্রধান বিচারপতি। সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশন অভিযোগ করে আসছে চাপের মুখে প্রধান বিচারপতিকে ছুটি নিতে হয়েছিল। গত ১৩ অক্টোবর ছুটি নিয়ে প্রধান বিচারপতি অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পর সরকারের আইনমন্ত্রী ও এটর্নি জেনারেল বলেছিলেন এস কে সিনহার দায়িত্বে ফেরা সম্ভব নয় ও সুদূরপরাহত। নানা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত পদত্যাক করতে হলো তাকে।
গত বুধবার এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ইঙ্গিত দিয়ে বলেছিলেন, প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ করলেও কোনো সাংবিধানিক শূন্যতার সৃষ্টি হবে না। সংবিধানে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তের ব্যাপারে বলা আছে।
জানা গেছে, সিঙ্গাপুরের স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় রাষ্ট্রপতি বরাবারে তিনি পদত্যাগ করেন। এই পদত্যাগপত্র সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশ হাই কমিশনে জমা দেন তিনি। গতকাল পদত্যাগপত্রটি বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে পৌঁছেছে। যদিও দুপুর পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতু মন্ত্রী এই পদত্যাগের বিষয়ে বলেছেন, প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ করেছেন কিনা তা এখনও নিশ্চিত নই। তবে যতটুকু জানি তার পদত্যাগপত্র এখনও রাষ্ট্রপতির কাছে পৌঁছায়নি। একইসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও বলেছেন, আমি এখনও নিজে এ সম্পর্কে কিছু জানি না। এজন্য কোনও মন্তব্য করতে পারছি না।
প্রধান বিচারপতির ছোট ভাই নরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, তিনি (এস কে সিনহা) আমাদের ফোন করে জানিয়েছেন শুক্রবার সকালে (বাংলাদেশ সময়) সিঙ্গাপুর থেকে কানাডা যাওয়ার আগে পদত্যাগপত্রে সই করেছেন এস কে সিনহা। পদত্যাগের বিষয়ে রাত ২টার দিকে বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেল প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন’ বলে ব্রেকিং নিউজ’ প্রচার করে।
এসকে সিনহার পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে, তিনি দেশে ফিরে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরিবারের সদস্যদের অনুরোধে সিঙ্গাপুরে বসেই পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করেন। এ বিষয়ে তার স্ত্রী, দুই মেয়েসহ পারিবারের অন্য সদস্যরা বেশি ভূমিকা রেখেছেন। জানা গেছে, বাংলাদেশ সময় দুপুর পৌনে ১২টায় বিচারপতি এসকে সিনহা সিঙ্গাপুর থেকে কানাডার উদ্দেশে রওনা দেন। ভোরে তিনি কানাডায় পৌঁছেছেন। সেখানে তার ছোট মেয়ে আশা সিনহার বাসায় থাকবেন।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ এ বিষয়ে বলেছেন, নিয়মানুযায়ী তিনি পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন। রাষ্ট্রপতি তা গ্রহণ করে দ্রুত সময়ে পরবর্তী প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেবেন। কারণ প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য থাকতে পারে না। তাই পদত্যাগের পর ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি দিয়ে দায়িত্ব পালনেরও কোনো সুযোগ নেই।
বিচারপতি এস কে সিনহা ছুটিতে গেলে গত ২ অক্টোবর থেকে সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আপিল বিভাগের প্রবীণতম বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞাকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়, প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য হইলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোন কারণে প্রধান বিচারপতি তার দায়িত্ব পালনে অসমর্থ বলিয়া রাষ্ট্রপতির নিকট সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হইলে ক্ষেত্রমত অন্য কোন ব্যক্তি অনুরূপ পদে যোগদান না করা পর্যন্ত কিংবা প্রধান বিচারপতি স্বীয় কার্যভার পুনরায় গ্রহণ না করা পর্যন্ত আপীল বিভাগের অন্যান্য বিচারকের মধ্যে যিনি কর্মে প্রবীণতম, তিনি অনুরূপ কার্যভার পালন করিবেন।
এর আগে ১ আগস্ট উচ্চ আদালতের বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে নিয়ে করা ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় প্রকাশিত হয়। এ রায়ে প্রধান বিচারপতির দেয়া বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছিলেন মন্ত্রী, দলীয় নেতা ও আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীদের সংগঠন বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের আইনজীবীরা। তারা প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের দাবিও তোলেন। সমালোচনার মধ্যেই ১ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কাছে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা হঠাৎ করেই এক মাসের ছুটির কথা জানিয়ে চিঠি দেন।
পরের দিন আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিয়াকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়। আইনমন্ত্রী জানান, প্রধান বিচারপতি ক্যান্সারে আক্রান্ত। পরে ১১ অক্টোবর চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতির এক আবেদনের প্রেক্ষিতে তার ছুটি ১০ নবেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
গত ১৩ অক্টোবর রাতে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন প্রধান বিচারপতি। দেশ ছাড়ার আগে প্রধান বিচারপতি তার বাসভবনের সামনে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি অসুস্থ নই। বিচার বিভাগের স্বার্থে ফিরে আসব। ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে একটি মহল প্রধানমন্ত্রীকে ভুল বুঝিয়েছেন।’ তিনি একটি লিখিত বিবৃতিও সাংবাদিকদের দিয়ে যান। পরের দিন ১৪ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন পাল্টা একটি বিবৃতিতে জানায়, প্রধান বিচারপতির বক্তব্য বিভ্রান্তিমূলক। বিবৃতিতে বলা হয়, প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ১১টি অভিযোগ ওঠার পর তার কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। এ কারণে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বসতে চাননি আপিল বিভাগের বিচারপতিরা। এ অবস্থায় প্রধান বিচারপতির দেশে ফেরা নিয়ে ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়।
গত সপ্তাহের প্রথম দিকে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা একাই অস্ট্রেলিয়া থেকে সিঙ্গাপুরে আসেন। সেখানে উদ্ভূত পরিস্থিতির সমাধানের জন্য দফায় দফায় সমঝোতা বৈঠক করেন। বৈঠকে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাসহ তৃতীয় একটি পক্ষও ছিল। বৈঠকে এসকে সিনহা ১১ অভিযোগের বিষয়টি নিষ্পত্তি করে সম্মানজনকভাবে দেশে ফিরে বিচারকার্য পরিচালনার জন্য এজলাসে বসতে চেয়েছিলেন।
সূত্রটি আরও জানায়, কিছু দিন আগে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা তার এক ঘনিষ্ঠ সহযোগীর মাধ্যমে এ দেশ থেকে ই-মেইলযোগে পদত্যাগপত্রের খসড়া নেন। এর পর পদত্যাগপত্র তিনি নিজেই চূড়ান্ত করেন। পদত্যাগপত্রটি সঙ্গে করে তিনি সিঙ্গাপুরে আসেন।
ষোড়শ সংশোধনীর পর্যবেক্ষণ নিয়ে তোপের মুখে
উচ্চ আদালতের বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করার সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় প্রকাশিত হয় গত ১ আগস্ট। ওই রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে সরকারের মন্ত্রী, এমপি ও সরকার সমর্থক আইনজীবীরা প্রধান বিচারপতির তীব্র সমালোচনা শুরু করেন। সরকার সমর্থক আইনজীবীরা পদত্যাগের আল্টিমেটামও দেন। পাশাপাশি রায়ে প্রধান বিচারপতির দেয়া পর্যবেক্ষণও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রত্যাহারের দাবি জানান।
ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি বলেন, দেশ মানবাধিকার ঝুঁকিতে, দুর্নীতি অনিয়ন্ত্রিত, সংসদ অকার্যকর, কোটি মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত।’ ৭৯৯ পৃষ্ঠার রায়ে সরকার, সংসদ, রাজনীতি, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, সামরিক শাসন এবং রাষ্ট্র ও সমাজের বিষয়ে অনেক পর্যবেক্ষণ উঠে আসে। রায়ে কড়া সমালোচনা করেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘আমি ও আমিত্ব’র সংস্কৃতির। তিনি বলেন, “আমাদের সংবিধানের ভিত্তি হচ্ছে, ‘আমরা জনগণ’ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। ১৯৭১ সালে আমরা যে অলঙ্ঘনীয় ঐক্য গড়ে ছিলাম, তা শত্রুরা নস্যাৎ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। আজ আমরা একটি মুক্ত, স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশে বাস করি। অথচ আজ ঔদ্ধত্য এবং অজ্ঞতাকে আমরা প্রশ্রয় দিয়ে চলছি। কোনো একজন ব্যক্তি দ্বারা কোনো একটি দেশ বা জাতি তৈরি হয়নি। আমরা যদি সত্যিই জাতির পিতার স্বপ্নে সোনার বাংলায় বাঁচতে চাই, তা হলে এই আমিত্বের আসক্তি এবং আত্মঘাতী উচ্চাভিলাষ থেকে আমাদের মুক্ত থাকতে হবে। এই আমিত্ব হলো কেবল এক ব্যক্তি বা একজন মানুষ সবকিছুই করতে পারেন এমন ভাবনা।’’
রায়ে প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন যদি নিরপেক্ষভাবে এবং কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বাধীনভাবে না হতে পারে, তা হলে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে না। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অনুপস্থিতিতে একটি গ্রহণযোগ্য সংসদও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। সে কারণে আমাদের নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং সংসদ শিশু অবস্থায় রয়ে গেছে। জনগণ এ দুটি প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা অর্জন করতে পারছে না। এ দুটি প্রতিষ্ঠান যদি জনগণের আস্থা এবং শ্রদ্ধা অর্জনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ থেকে বিরত থাকে, তা হলে কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে না। একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অভাবে বিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের দিয়ে সংসদ গঠিত হতে পারে না, বরং তা সংসদের নিজের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণকে ব্যাহত করতে পারে।’
প্রধান বিচারপতি রায়ে বলেন, ‘সংসদ যদি যথেষ্ট পরিপক্বতা অর্জন না করে, তা হলে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ করার ক্ষমতা সংসদের কাছে ন্যস্ত করা হবে একটি আত্মঘাতী উদ্যোগ। সংসদের কাছে বিচার বিভাগের জবাবদিহি করা উচিত নয়; বরং রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে জাতীয় নির্বাচনে তাদের প্রার্থী বাছাইয়ে সতর্ক হওয়া’।
হেয়ার রোডের বাসায় ওবায়দুল কাদের, গওহর রিজভী : রায় নিয়ে এক রকম অস্থিরতার মধ্যেই ১২ আগস্ট রাতে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার বাসায় নৈশভোজে অংশ নেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সূত্রমতে, ওই দিন রাত ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত আলাপ হয় এসকে সিনহা ও ওবায়দুল কাদেরের। প্রধান বিচারপতি ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে কোথাও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জাতীয় সংসদকে অসম্মান করে বক্তব্য লেখেননি বলে কাদেরকে জানান। প্রধান বিচারপতি বলেন, যারা এগুলো বলছেন, তারা পূর্ণাঙ্গ রায় নয় কয়েকটা লাইন পড়েই এসব সমালোচনা করছেন। এ ছাড়া প্রধান বিচারপতি কাদেরের সঙ্গে আলাপকালে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং আইন সচিবের বিভিন্ন কর্মকান্ডে নিজের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার কথা জানান। পরবতীতে প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টাও এস কে সিনহার সঙ্গে দুই দফায় সাক্ষাৎ করেন।
হঠাৎ ছুটির আবেদন
সমালোচনার মধ্যেই সুপ্রিম কোর্টের অবকাশ চলাকালে ৮ সেপ্টেম্বর রাতে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা অসুস্থ মেয়ে আশা সিনহাকে দেখতে কানাডার উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। এর পর ১৮ সেপ্টেম্বর জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠিত এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার রাষ্ট্রগুলোর প্রধান বিচারপতিদের সম্মেলনে যোগ দেন। এর পর ২৪ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি দেশে ফেরেন। এর পর অবকাশ শেষে ৩ অক্টোবর থেকে সুপ্রিম কোর্টের কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগের দিন ২ অক্টোবর হঠাৎ করেই এক মাসের ছুটিতে যান। তিনি আবেদনে ৩ অক্টোবর থেকে ১ নবেম্বর পর্যন্ত ছুটিতে যাওয়ার কথা জানান রাষ্ট্রপতিকে। পরে ৪ অক্টোবর এক সাংবাদিক সম্মেলনে আইনমন্ত্রী বলেন, তিনি অসুস্থ, ক্যান্সারে আক্রান্ত। এটা নিয়ে রাজনীতির কিছু নেই। আসুন আমরা সবাই মিলে প্রধান বিচারপতির সুস্থতার জন্য দোয়া করি।
এরপর ১০ অক্টোবর প্রধান বিচারপতির ব্যক্তিগত সহকারীর বরাত দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার জাকির হোসেন আইন মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি লিখেন। তাতে বলা হয়, প্রধান বিচারপতি মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত। শ্রান্তির জন্য ১৩ অক্টোবর থেকে ১০ নবেম্বর পর্যন্ত বিদেশে থাকতে চান। ১১ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ওই ছুটি বৃদ্ধির আবেদনে সই করেন। পরদিন আইন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। এতে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার ১০ নবেম্বর দেশে ফেরা অথবা স্বীয় কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত আপিল বিভাগের কর্মে প্রবীণতম বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞাকে প্রধান বিচারপতির কার্যভার পালনের দায়িত্ব প্রদান করেন।
আমি অসুস্থ নই
গত ১৩ অক্টোবর রাতে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে দেশ ছাড়েন। ওইদিন রাতে তার হেয়ার রোডের বাসভবনের সামনে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, আমি অসুস্থ নই। আমি চলে যাচ্ছি। আমি পালিয়ে যাচ্ছি না। আবার ফিরে আসব।
বিবৃতিতে প্রধান বিচারপতি বলেছেন- আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি। কিন্তু ইদানীং একটা রায় নিয়ে রাজনৈতিক মহল, আইনজীবী, বিশেষভাবে সরকারের মাননীয় কয়েকজন মন্ত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে ব্যক্তিগতভাবে যেভাবে সমালোচনা করেছেন এতে আমি সত্যিই বিব্রত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সরকারের একটি মহল রায়কে ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করে পরিবেশন করায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার প্রতি অভিমান করেছেন। যা অচিরেই দূরীভূত হবে বলে আমার বিশ্বাস। সেই সাথে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে আমি একটু শংকিতও বটে। কারণ গতকাল (বৃহস্পতিবার) প্রধান বিচারপতির কার্যভার পালনরত দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রবীণতম বিচারপতির উদ্ধৃতি দিয়ে মাননীয় আইনমন্ত্রী প্রকাশ করেছেন যে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি অচিরেই সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনে পরিবর্তন আনবেন। প্রধান বিচারপতির প্রশাসনে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কিংবা সরকারের হস্তক্ষেপ করার কোনো রেওয়াজ নেই। তিনি শুধুমাত্র রুটিনমাফিক দৈনন্দিন কাজ করবেন। এটিই হয়ে আসছে। প্রধান বিচারপতির প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করলে এটি সহজেই অনুমেয় যে, সরকার উচ্চ আদালতে হস্তক্ষেপ করছে এবং এর দ্বারা বিচার বিভাগ ও সরকারের মধ্যে সম্পর্কের আরো অবনতি হবে। এটি রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না।
সুপ্রিম কোর্টের পাল্টা বিবৃতি
পরদিন পাল্টা এক বিবৃতি দেয় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। বিবৃতিতে বলা হয়, ছুটি ভোগরত প্রধান বিচারপতি ১৩ অক্টোবর বিদেশ গমনের প্রাক্কালে একটি লিখিত বিবৃতি উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের নিকট হস্তান্তর করেন। বিবৃতিটি বিভ্রান্তিমূলক। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য নিম্নরূপ : উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য নি¤œরূপ-
গত ২০ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে ব্যতীত আপিল বিভাগের ৫ জন বিচারপতিকে বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ চানান। বিচারপতি মো. ইমান আলী দেশের বাইরে থাকায় আমন্ত্রণে উপস্থিত থাকতে পারেন নাই। অপর চারজন অর্থাৎ বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপদি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। দীর্ঘ আলোচনার এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, নৈতিক স্খলনসহ আরো গুরুতর সুনির্দিষ্ট অভিযোগের তথ্য হস্তান্তর করেন। এরমধ্যে ১ অক্টোবর বিচারপতি মো.ইমান আলী ঢাকা ফিরে আসেন এবং অপর চার বিচারপতিকে নিয়ে বৈঠক করেন। বৈঠকে ১১টি অভিযোগ নিয়ে বিশদ পর্যালোচনার পর তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন, এসব গুরুতর অভিযোগ প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে অবহিত করা হবে। তিনি যদি এসব অভিযোগের সন্তোষজনক জবাব দিতে ব্যর্থ হন তাহলে তার সঙ্গে বিচার কাজ করা সম্ভব জবে না। এই সিদ্ধান্তের পর ওইদিন বেলা সাড়ে ১১ টায় প্রধান বিচারপতির হেয়ার রোডের বাসভবনে পাঁচ বিচারপতি সাক্ষাৎ করে অভিযোগগুলো নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করেন। কিন্তু দীর্ঘ আলোচনার পর তার কাছ থেকে কোনো গ্রহণযোগ্য ব্য্যখ্যা বা জবাব না পেয়ে আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতি সুস্পষ্ট জানিয়ে দেন. এমতাবস্থায় এই অভিযোগগুলোর সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত তার সঙ্গে একই বেঞ্চে বসে তাদের পক্ষে বিচার কাজ পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা সুস্পষ্টভাবে বলেন, সেক্ষেত্রে তিনি পদত্যাগ করবেন। তবে এ ব্যাপারে পরদিন ২ অক্টোবর তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবেন। এরপর ২ অক্টোবর পাঁচ বিচারপতিকে কিছু না জানিয়ে প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্্রপতির কাছে এক মাসের ছুটির দরখাস্ত দিলে রাষ্ট্রপতি তা অনুমোদন করেন। তাৎক্ষণিকভাবে রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতির অনুপস্থিতিতে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি মো.আবদুল ওয়াহহাব মিঞাকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির অনুরূপ কার্যভার পালনের দায়িত্ব প্রদান করেন।
উল্লেখ্য, প্রধান বিচারপতির পদটি একটি প্রতিষ্ঠান। সেই পদের ও বিচার বিভাগের মর্যাদা সমুন্নত রাখার স্বার্থে ইতঃপূর্বে সুপ্রিম কোর্টের তরফ থেকে কোন প্রকার বক্তব্য বা বিবৃতি প্রদান করা হয়নি। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে নির্দেশক্রমে এই বিবৃতি প্রদান করা হলো।
Check Also
সাতক্ষীরায় ৪ গ্যালন ফরমালিন পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার
নিজস্ব প্রতিনিধি: সাতক্ষীরা থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৪ গ্যালন ফরমালিন পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করেছে। তবে এসময় …