ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটে সম্পর্কের টানাপড়েন চলছে। টানা দ্বিতীয় মেয়াদে মন্ত্রিসভা গঠনের পর থেকেই শরিকদের মূল্যায়ন না করা, জোটকে সুসংগঠিত না করা, নামকাওয়াস্তে বৈঠক করে আশ্বাসের ঝুলি বাড়ানোসহ বিভিন্ন কারণে জোটে অসন্তোষ ছিল। গত বুধবার আওয়ামী লীগকে নিয়ে জাসদ সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর এক বক্তব্যে টানাপড়েনের বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়েছে। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সেই টানাপড়েনে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে বলে মনে করছেন রাজনীতি বিশ্লেষকেরা। জোটের শীর্ষপর্যায়ের নেতার মুখে এ ধরনের বক্তব্যও ভালোভাবে নেয়নি জোটপ্রধান আওয়ামী লীগ। ফলে বিষয়টি দেখভাল করার জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জোটের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিমকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
তবে জোটের শীর্ষপর্যায়ের কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে এমন বক্তব্যকে অনাকাক্সিক্ষত বলেও অভিহিত করেছেন আওয়ামী লীগের অন্যতম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান। তিনি বলেন, জাসদ সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু যে বক্তব্য দিয়েছেন, এটা অনাকাক্সিক্ষত। তার কাছ থেকে এটা আমরা আশা করি না। এ প্রসঙ্গে প্রবীণ রাজনীতিবিদ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, যারা বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে তাদের সম্পর্কে আর কী মন্তব্য করব। ৭ নভেম্বরের তাদের ভূমিকা কী ছিল তা সবাই জানেন। তিনি বলেন, তথ্যমন্ত্রী অদৃশ্য কিছু দেখতে পেলেন কি না জানি না। অতীতেও দেখা গেছে তারা বক্তব্য পাল্টাতেও সময় নেন না। আগামীতেও যে বক্তব্য পাল্টাবেন না তার নিশ্চয়তা নেই। ফলে তাদের জীবনচরিত্র বিশ্লেষণ করলে সহজেই বোঝা যায় তারা কী। এর বেশি কিছু মন্তব্য করতে চাই না।
গত বুধবার কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগকে উদ্দেশ করে জাসদ সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘আপনারা ৮০ পয়সার মালিক, এক টাকার মালিক না। যতক্ষণ এক টাকা হবে না ততক্ষণ ক্ষমতা পাবেন না। আপনারা ৮০ পয়সা। এরশাদ, দিলীপ বড়ুয়া, মেনন এবং ইনু মিললে তবেই এক টাকা হবে। আমরা যদি না থাকি তাহলে আপনারা ৮০ পয়সা নিয়ে রাস্তায় ঘুরবেন। এক হাজার বছরেও ক্ষমতার মুখ দেখবেন না।’ এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ইনুকে উদ্দেশ করে বলেন, তিনি নিজেও জানেন আওয়ামী লীগকে ছাড়া নির্বাচন করলে এর ফলাফল কী হবে। সেটা তিনি আগেও ‘টেস্ট’ করেছেন। তিনি অভিমান থেকে এমন বোমা ফাটিয়েছেন। আমরা বিষয়টি আমাদের ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিমকে জানিয়েছি। এটা নিয়ে আর বেশি কিছু এখানে না বলাই ভালো। ইনু সাহেব হয়তো এমন বক্তব্য দিয়ে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে চাচ্ছেন।
এরশাদ, দিলীপ বড়ুয়া, মেনন ও ইনু মিললে তবেই এক টাকা হবে, তথ্যমন্ত্রীর এমন বক্তব্যে জোটের অন্য শরিকের মধ্যে মিশ্রপ্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। ন্যাপের সহসাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন বলেন, ১৪ দলের কারণে ইনু ভাই আজ মন্ত্রী। তিনি জাসদেরও মন্ত্রী নন, জোটের মন্ত্রী। তিনি বলেন, জোটেনয়া দির অন্য শরিক দলগুলোর প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ কাম্য নয়। কাউকে বেশি দেবেন কাউকে একেবারে বঞ্চিত করবেন, এটা শোভনীয় নয়। এ ধরনের আচরণ জোটকে দুর্বল করে।
জানা গেছে, আগামী একাদশ জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। এক বছরের কিছু বেশি সময় বাকি থাকলেও জোটের শরিক দলগুলোর সাথে এখনো আসন বণ্টন নিয়ে কোনো আলাপ-আলোচনা হয়নি। আসন দরকষাকষির ক্ষেত্রে এ ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য কাজে আসবে এমন ধারণা নিয়েই জোটের শরিক দলগুলো তীর্যক বক্তব্য দেয়া শুরু করেছে। জোটের শরিক দলের একজন শীর্ষ নেতা এ প্রতিবেদককে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এ ধরনের মন্তব্য সামনে আরো আসবে। বিগত দিনগুলোতে জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও সাম্যবাদী দলকে মূল্যায়ন করা হয়েছে। যেটা তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্যেও ফুটে উঠেছে। তবে কুষ্টিয়ায় বক্তব্য দেয়ার পর থেকে জোটপ্রধান আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায় থেকে মন্ত্রী বেশ চাপে রয়েছেন বলে জানা গেছে। এ ধরনের বক্তব্য কেন দেয়া হলো তারও কারণ নির্ণয় করা হচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
জানা গেছে, নবম জাতীয় সংসদে টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী দিয়ে শরিকদের সন্তুষ্ট রাখলেও বিতর্কিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের বাদ দিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়েছে। এমনকি মহাজোট সরকারে সংরক্ষিত আসনের এমপি পদ পেলেও এবার তা কেড়ে নেয়া হয়েছে। আশা জিইয়ে রাখায় জোটের বেশির ভাগ শরিক দলের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। এতে জোটের অনেক নেতা বৈঠকে অংশগ্রহণ করা বাদ দিয়েছেন; আবার অনেকেই বৈঠকে উপস্থিত হয়ে ক্ষমতাসীনদের ওপর ক্ষোভ ঝাড়েন। এ দিকে ক্ষমতাসীনদের আশ্বাসে আশ্বস্ত হতে না পেরে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সাথে জোট বাঁধছেন। আবার কেউ কেউ তৃণমূলের চাপ মাথায় নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছেন। শরিকদের যথাযথভাবে মূল্যায়ন না করায় সামনে আওয়ামী লীগের জন্য আরো হুমকি হিসেবে দেখা দিতে পারে।
দল হিসেবে ছোট হলেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট গঠনের শুরুর দিকে সেই ২০০৪ সাল থেকে সব আন্দোলন-সংগ্রামে সমর্থন দিয়েছে গণতন্ত্রী পার্টি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোট সরকার গঠন করলে একমাত্র সংরক্ষিত নারী আসনে একজন প্রার্থী মনোনয়নের সুযোগ পায় গণতন্ত্রী পার্টি। গত ৫ জানুয়ারির বিনা ভোটের নির্বাচনে কয়েকজন এমপি প্রার্থী থাকলেও তাদের মূল্যায়ন করা হয়নি। একমাত্র নারী এমপির পদটিও এবার কেড়ে নেয়া হয়েছে। জোটের আরেক শরিক সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়–য়া। মহাজোট সরকারের আমলে তিনি টেকনোক্র্যাট শিল্পমন্ত্রী ছিলেন। বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে সক্ষম হলেও এবার মন্ত্রিসভা থেকে ছিটকে পড়েন দিলীপ বড়ুয়া।
নির্বাচনে দুইজন এমপি প্রার্থী থাকলেও তাদের মূল্যায়ন না করায় দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল দেখা দেয়। একপর্যায়ে একটি অংশ ইতোমধ্যে ২০ দলীয় জোটে ভিড়েছে। ২০১৪ সালের ১৮ জুলাই আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে ক্ষমতাসীন জোটের বৈঠকে অনির্ধারিত আলোচনায় উঠে আসে শরিকদের মূল্যায়নের বিষয়টি। জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও তরিকত ফেডারেশনের মতো শরিকদের অন্যরাও সরকারে প্রতিনিধিত্ব করতে চান। মূল্যায়ন না করায় তোপের মুখে পড়েন জোটের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম। তখন তিনি রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আরেকটু ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান জোট নেতাদের। আরেক শরিক ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। গত নির্বাচনে ছয়জন এমপি প্রার্থী থাকলেও কাউকেই মূল্যায়ন করা হয়নি। সংরক্ষিত নারী আসনে একটি এমপি পদ দিয়ে ঠাণ্ডা রাখা হয়েছে দলটিকে। একইভাবে বঞ্চিত হয়েছে বাসদ, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, গণ আজাদী লীগ ও গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি। এসব দল ভঙ্গুর অবস্থায় থাকলেও সরকারে ভাগ বসাতে আগ্রহী ছিল। দরকষাকষি করেও এ পর্যন্ত কোনো লাভ হয়নি।
গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ১৪ দলের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি একজন মন্ত্রীসহ ছয়জন এমপি এবং জাসদে একজনমন্ত্রীসহ কয়েকজন এমপি রয়েছেন। জোটে নতুন যুক্ত হওয়া জাতীয় পার্টি-জেপি মঞ্জু ও তরিকত ফেডারেশন মন্ত্রীসহ কয়েকটি এমপি পদ ভাগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। বঞ্চিত অন্য শরিকেরা টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা পদে কিংবা জেলা পরিষদে অন্তর্ভুক্তির দাবি জানালেও আজ অবধি উপেক্ষিত রয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, উপজেলা নির্বাচনে মাত্র ২৮টি উপজেলায় প্রার্থী দিতে সক্ষম হয় ওয়ার্কার্স পার্টি।
এর মধ্যে নড়াইল সদর, বরিশাল সদর, রাজশাহীর পবা ও দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলায় একজন পুরুষ ও তিনজন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী জয়লাভ করেন। শতাধিক উপজেলায় প্রার্থী দিতে সক্ষম হয় জাসদ। এর মধ্যে কুলাউড়ায় একজন নারী ভাইস চেয়ারম্যান, কুষ্টিয়া মিরপুরে ভাইস চেয়ারম্যান ও রাজশাহীর বাঘায় ভাইস চেয়ারম্যানÑ এই তিন প্রার্থী জয়লাভ করেন। এসব দল প্রার্থীও খুঁজে পায় না, আর বড় বড় বুলিও আওড়ায়। অথচ জোট করে এমপি-মন্ত্রীর পদ ভাগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। সারা দেশে তাদের অবস্থান কী তারা আগেও ভোটের রাজনীতিতে টের পেয়েছে।
এ প্রসঙ্গে রাজনীতি বিশ্লেষক গোলাম মাওলা রনি বলেন, ইনু সাহেব যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটা ছিল কুষ্টিয়া জেলায়। এটা দলের বিরুদ্ধে না গিয়ে ব্যক্তি মাহবুবউল আলম হানিফকে উদ্দেশ করে বলেছেন বলে আমি মনে করি। তার কারণ হলো, প্রথমত ওই এলাকায় তাদের মধ্যে বেশ দ্বন্দ্ব রয়েছে। ইনু সাহেব যদি এ ধরনের বক্তব্য না দেন তাহলে তার দলের নেতাকর্মীরা চাঙা থাকবেন না। দ্বিতীয়ত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মনে করছেন, ইনুর মতো উটকো ঝামেলা টেনে নেয়ার দরকার কী। আমরাই এক শ’। ওরাও ঠিক একই রকম মনে করছে যে, আমাদের ছাড়া আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেতে পারবে না। আমাদেরকে উপযুক্ত সম্মান দিতে হবে। এটা বোঝানোর জন্য এ ধরনের বক্তব্য দিতে পারেন।
গোলাম মাওলা রনি বলেন, আসলে তারা তো জোট বেঁধেছে একে অপরের স্বার্থে। যদিও কিছু সাময়িক সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে প্রকৃতপক্ষে নিজেদের স্বার্থের বাইরে গিয়ে আগামীতে কোনো কাজ তারা করবে বলে আমার মনে হয় না।নয়া দিগন্ত